আল্লাহতাআলা কোরআনে দশ প্রকারের পাখির উল্লেখ করেছেন এবং নানা প্রকারের জীব-জন্তুর কথাও বলেছেন। বাকশক্তিহীন এসব প্রাণী-জীব, কীট-পতঙ্গ আল্লাহতাআলার হামদ-প্রশংসা জিকির, তসবীহ পড়ে বলেও জানা যায়। জুমাবারের ফজিলত সম্পর্কে ‘এহিয়াউল উলুম’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, বিহঙ্গকুল এবং অন্যান্য জীব-জন্তু জুমার দিনে পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ, সালাম ও কুশল বিনিময় করে থাকে এবং বলে আজকের দিন খুবই উত্তম। আবুল কাসেম ইস্ফাহানী ‘আত-তারগীব ওয়াত তারহীব’ গ্রন্থে লিখেছেন, কাইস ইবনে উব্বাদা বলতেন, ‘আমি জেনেছি যে, হিংস্র পশুকুল আশুরা দিবসে রোজা পালন করে।’ ফাতহে ইবনে সনজর বলেন, ‘আমি প্রতিদিন পিপড়াদের জন্য রুটির টুকরো ছড়িয়ে রাখতাম। যখন আশুরার দিন হত, তখন পিপড়ার দল তা খেত না।’
উল্লেখিত বিবরণে দুই দিবসের মর্যাদা ও তাৎপর্যের কথা বলা হয়েছে, একটি জুমাবার এবং অপরটি আশুরা দিবস। এ দুই দিন জীব-জন্তু, বিহঙ্গকুল এবং পিপিলিকার আচরণ উল্লেখিত হয়েছে।
শহীদদের সম্পর্কে হাদীসে আছে, তারা সবুজ পাখি হয়ে বেহেশতে উড়বে। বেহেশতবাসীদের জন্য সেখানে অনেক কিছুর মধ্যে পাখিও রয়েছে। কিন্তু দুনিয়ার মানুষের ন্যায় পশু-পাখি, জীব-জন্তুর জন্যও জান্নাত-জাহান্নাম আছে কিনা এটি বহুল বিতর্কিত বিষয়। খালেদ ইবনে মাদান বলেছেন, ‘আসহাবে কাহাফের কুকুর, হজরত উজাইর (আ:) এর গাধা এবং হজরত ছালেহ (আ:) এর উটনী ব্যতীত আর কোন পশু বেহেশতে যাবে না।’ বাকি পশুকুল দোজখে যাবে একথাও বলা হয়নি। তবে জীব-জন্তুর হিসাব-নিকাশ হবে কিনা তা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। ওরা মানুষের ন্যায় বাকশক্তির অধিকারী নয়। ওদের স্বতন্ত্র আওয়াজ ও বুলি আছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে তা অনুভব করা সম্ভব নয়। তবে হজরত সুলাইমান (আ:) কে এ ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল এবং মহানবী (সা:) কে এ বিষয়ে বিশেষ মোজেযা দান করা হয়েছিল। কোন কোন নবীও এরূপ ক্ষমতা বা মোজেযার অধিকারী ছিলেন, তবে সংখ্যায় সীমিত।
হজরত সুলায়মান (আ:) এর মাধ্যমে যেমন পশু-পাখিদের বুলির কথা জানা যায়, তেমনি মহানবী হজরত রসূলুল্লাহ (সা:)-এর নবুওয়াত জীবনেও লক্ষ্য করা যায় যে, এই ক্ষেত্রে তিনি পশু-পাখির কথার জবাব দিয়েছেন, ‘ওস্তুনে হান্নানা’ এর মত বৃক্ষ খুঁটির কান্নাও নিবারণ করেছেন।
কোরআন দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহর মাখলুকাতের সব কিছুই তার জিকির করে, তসবীহ পড়ে। বিভিন্ন হাদীসেও এর সমর্থন রয়েছে। যেমন হজরত ওমামা বাহেলী (রা:) বর্ণিত একটি হাদীসের শেষ অংশে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, ‘জেনে রেখো! আল্লাহ তার ফেরেশতাগণ এবং জমিন ও আসমানের সৃষ্টি কুল (মাখলুকাত) এমন কি পিপিলিকারা ওদের বাসস্থানে এবং মৎস্যকূল সমুদ্রে সেসব লোকের জন্য রহমতের দোয়া করে, যারা মানুষের কল্যাণে শিক্ষা দানে নিয়োজিত।’ ‘বজ্জার’ হজরত আবু হোরায়রা (রা:)-এর বরাতে এক সহি হাদীসে হজরত ইউনুস (আ:) এর মাছের পেটে থাকা কালীন অবস্থা বর্ণনা করেন এবং রসূলুল্লাহ (সা:) কে উদ্ধৃত করে বলেন, মাছটি যখন ইউনুস (আ:) কে গিলে ফেলে, সমুদ্রের আবাসস্থলের দিকে যাত্রা করে এবং তার তলদেশে উপনীত হয়, তখন ইউনুস (আ:) কিছু শব্দ শুনতে পান। তিনি মনে মনে চিন্তা করেন, এটি কিসের শব্দ? আল্লাহর পক্ষ হতে তার কাছে বাণী পৌঁছে তখনো তিনি মাছের পেটে। এই শব্দ-ধ্বনি সমুদ্রের ‘মাখলুকাতের তসবীহ’। অর্থাৎ সমুদ্রে আল্লাহর যত প্রকারের জীব-জন্তু আছে সবই আল্লাহর তসবীহ পাঠ করে।
বিহঙ্গকুল ও জীব-জন্তুর বুলি বা স্বতন্ত্র আওয়াজ থাকলেও ওরা বাকশক্তিহীন। ওরা মানুষের ন্যায় কথা বলতে পারে না। কিন্তু ওদের নিজস্ব বুলি সাধারণ মানুষের পক্ষে বোধগম্য না হলেও আল্লাহর নবী রসূলগণের কারও কারও ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা ওদের বুলি অনুধাবন করার ক্ষমতা দান করেছেন। মহানবী (সা:)-এর এমন বহু মোজেযার কথা জানা যায় যে, তিনি ওদের বুলি বুঝতেন এবং ওদের সাথে কথা বলেছেন, এমনকি এক হরিণীর নালিশ শুনে ফয়সালা দিয়েছেন, ‘ওস্তুনে হান্নানা’ এর কান্নার শব্দ উপস্থিত সাহাবাগণও শুনেছেন।
হজরত সুলায়মান (আ:)-এর শাসন ব্যবস্থার অনন্য বৈশিষ্ট্যই ছিল- জীব-জন্তু, পশু-পাখি, জি¦ন, বাতাস ইত্যাদি তার অধীনে ছিল এবং ওদের সকলের বুলি তিনি বুঝতেন। কোরআনে সূরা ‘নমল’ এ পিপিলিকার সাথে তার কথোপকথনের বর্ণনা রয়েছে এবং তাঁর মাধমেও বিহঙ্গকুল ও জীব-জন্তুর নানা বুলির কথা জানা যায় এবং জানা যায় ওদের বুলি-আওয়াজ এবং আল্লাহর জিকির, তসবীহ পাঠের কথা। ওদের জন্য জান্নাত-জাহান্নাম নেই, কিন্তু ওরা মোমেনদের কল্যাণের জন্য দোয়া করে থাকে এবং অনেকে রসূলুল্লাহ (সা:) এর প্রতি ঈমান এনেছিল।
সুতরাং বলতে হয়, যদি হিংস্র পশু ও পিপিলিকাদের মত বাকশক্তিহীনরা আশুরা দিবস ও জুমাবার এর তাৎপর্য অনুধাবণ করে, দিবসদ্বয়ের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন করতে পারে, তাহলে বাকশক্তির অধিকারী মানুষেরা কেন স্রষ্টার প্রতি এবং তাঁর প্রিয় নবীর ওপর ঈমান আনবে না? পবিত্র দিনগুলোর প্রতি যথাযথ মর্যাদা প্রদর্শন করবে না?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন