ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় এমন কিছু গুণাবলী রয়েছে যার ঔজ্জল্য মানব সমাজকে আলোকিত ও শান্তির দুয়ারে পৌঁছে দেয় এবং জীবন চলার পথে স্বস্তি ও নিরাপত্তার অমিয় বারি বর্ষণ করে। এর মধ্যে ইহসান বা অনুগ্রহ করার গুণটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। অসহায় ও দুর্বল লোকদের প্রতি, নিঃস্ব ও ক্ষুধার্তদের প্রতি, আশ্রয় প্রার্থী ও সাহায্য লাভের আকাক্সিক্ষদের প্রতি সাহায্য ও সহানুভূতির হাত প্রশস্ত করা জান্নাতি লোকদের স্বভাব।
দুর্বল, অসহায়, সম্বলহীন এবং অনাথজনদের প্রতি অনুগ্রহ করার মাধ্যমেই জান্নাতী লোকজন পরকালিন মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও ফযিলতের অধিকারী হয়ে থাকেন। যারা দুনিয়াতে ইয়াতিম, মিসকিন ও বন্দিদের প্রতি সহৃদয়তা প্রদর্শন করে তারা জাগতিক জীবনে যেমন স্বচ্ছলতা ও প্রাচুর্যের মাঝে অবস্থান করে, একই সাথে আখেরাতের জীবনেও তারা সফলতা ও কামীয়াবী হাসিলে সমর্থ হয়। কোরআনুল কারীমে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত এই শ্রেণীর লোকদের পরিচিতি তুলে ধরে ইরশাদ করেছেন: এবং তারা পার্থিব জীবনে খাদ্য বস্তুর প্রতি নিজেদের প্রয়োজন ও আকর্ষণ থাকা সত্তে¡ও ইয়াতিম, মিসকিন ও বন্দিদের প্রতি আহার্য্যবস্তু প্রদানে তৎপর থাকে। (সূরা আদ দাহর: আয়াত ৮)। এই আয়াতে কারীমায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুহসীন ও অনুগ্রহ প্রদর্শনকারী ব্যক্তিগণ ইয়াতিম, মিসকিন ও বন্দিদের জঠরজ্বালা নিবারণের জন্য নিজেদের প্রয়োজন ও আসক্তিকে অবদমন করত: দুস্থদের অভাব পূরণকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। বিশিষ্ট কবির কবিতায় এরই প্রতিধ্বনি এভাবে অনুরণিত হয়েছে। কবি যথার্থই বলেছেন: ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।’
পিয়ারা নবী মহাম্মাদুর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামগ্রিক জীবনাদর্শের মাঝে অনুগ্রহ করার গুণটি সর্বত্রই সমুজ্জল সুষমায় ভাস্মর হয়ে ফুটে উঠেছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিন বান্দার জাগতিক দুঃখ-কষ্ট ও যাতনা-বেদনা দূর করবে, আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত তার কিয়ামতের দিনের দুঃখ-কষ্ট ও বেদনা লাঘব করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো দুর্দশাগ্রস্ত ও সঙ্কটে জর্জরিত ব্যক্তির সঙ্কট ও মুসিবত নিরসন করবে, আল্লাহ জাল্লা শানুহু তার ইহলৌহিক ও পরলৌকিক যাবতীয় সঙ্কট ও দুর্দশা নিরসন করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুমিন বান্দার দোষ-ত্রুটি প্রচ্ছন্ন ও গোপন রাখবে, আল্লাহপাক তার দুনিয়া ও আখেরাতের দোষ-ত্রু টি গোপন ও প্রচ্ছন্ন রাখবেন। আর একথা সুনিশ্চিত যে, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার প্রতি সাহায্য ও সহায়তা করে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা স্বীয় ভ্রাতার সাহায্যে নিরত থাকে। (মিশতাকুল মাসাবিহ: পৃ. ৩১)। এই হাদীসে অনুগ্রহ প্রদর্শনের যে চারটি পর্যায় তুলে ধরা হয়েছে, তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ব্যক্তি জীবনকে যেমন সুউচ্চ মর্যাদার আসনে উন্নীত করে, তেমনি পরকালীন জীবনের সফলতা ও কামিয়াবী অর্জনের পথকে করে তোলে সুমসৃণ ও সহজতর এবং এরই ফলশ্রুতিতে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বত্র দেখা দেয় শান্তি, স্বস্তি প্রাচুর্যের মহাসমারোহ। এই বিশেষত্বটি হাদীস শরীফে এভাবে বিবৃত হয়েছে। হযরত মুসয়াব বিন সায়াদ রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত সায়াদ রা. মনে করলেন যে, দুর্বল ও অসহায় লোকদের ওপর তার পর্যাপ্ত অনুগ্রহ ও বদান্যতা রয়েছে, (ইহা অনুধাবন করে) রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, তোমাদের যে সাহায্য করা হয়েছে, তা কেবল দুর্বল লোকদের কারণে এবং তাদের কারণেই তোমাদের রিযিক ও সম্পদ দ্বারা শান্তি, স্বস্তি ও প্রাচুর্যের অধিকারী করা হয়েছে। (ওমদাতুল কারী: শরহে বুখারী; খন্ড ১৪, পৃ. ১৭৯)। অপর এক হাদীসে এসেছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন: যে ব্যক্তি আমাকে সন্তুষ্ট ও পরিতুষ্ট করতে চায়, তবে সে যেন আমার উম্মতের মধ্যে যারা দুর্বল ও অসহায় তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করে। কেননা, তোমাদেরকে সাহায্য ও রিযিক দেয়া হচ্ছে দুর্বল ও অসহায় লোকদের কারণেই। (সুনানে আবু দাউদ: খন্ড ২, পৃ. ১৮২) উপরোল্লিখিত হাদীসের আলোকে সহজেই বুঝা যায় যে, গরিব, অসহায় ও দুস্থ লোকদের সাথে সুন্দর ও অনুগ্রহ মূলত আচরণের মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহ সা. এর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও সম্পদ লাভের সৌভাগ্য ত্বরান্বিত হয়। কাজেই মুসলিম মিল্লাতের প্রত্যেক সদস্যদের মাঝে অনুগ্রহ প্রদর্শনের গুণটি মূর্ত হয়ে ফুটে উঠুক, এটাই আজকের একান্ত চাহিদা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন