মুসলমানদের ঈদুল আজহায় ঈদের নামাজ ও কোরবানি, প্রধান দুটি কাজ। এই দুই কাজের ওপর ভিত্তি করেই আনন্দ-উৎসব করা হয়। তাই ঈদুল আজহার আনন্দ-উৎসবকে ঈদের নামাজ ও কোরবানি থেকে পৃথক করে দেখার সুযোগ নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি ঈদের নামাজ ও কোরবানি করবে না (ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও), তার জন্য কোনোক্রমেই ঈদুল আজহার আনন্দ-উৎসব করার অধিকার নেই।
সে হিসেবে ঈদুল আজহার ব্যাপারে এখন কেউ যদি বলে, ধর্মীয় কাজগুলো মুসলমানদের হলেও এ উৎসবটা সকলের, স্পষ্টতই তা বাস্তবসম্মত হবে না। তাই তো কোনো ঈদের জামাতের আশেপাশে বা জাতীয় ঈদগাহ ইত্যাদিতে ব্যাপকভাবে কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা অন্য ধর্মের লোকদের সমবেত হতে দেখা যায় না। ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করে বোঝার জন্য ঈদুল আজহা নিয়ে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মানসিক অবস্থা বিচার করলেও যথেষ্ট হবে। তাদের কাছে গরু হলো পবিত্র পশু। এই গরু নিয়ে কত করুণ কান্ডই না ঘটে যাচ্ছে আমাদের প্রতিবেশী হিন্দু-প্রধান দেশে। সেখানে ক্ষমতাশালী লোকদের হাতে নিহত, নিগৃহীত হচ্ছে সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজ; শুধু গরুর গোশত রাখার অপরাধে বা অভিযোগে। এ হচ্ছে গরু সংক্রান্ত হিন্দুদের বিশ্বাস। অপর দিকে, মুসলমানরা সেদিন গরু জবেহের মাধ্যমে আল্লাহর হুকুম পালন করে আনন্দ করে থাকে। তা হলে দেখা যাচ্ছে, মুসলমানদের এই আনন্দের দিন ও উৎসবটা হিন্দুদের জন্য আনন্দের নয়। অপর দিকে, আমাদের জন্য ঠিকই আনন্দের। উট-দুম্বা-ছাগল-ভেড়া-মহিষ কোরবানির সুযোগ থাকলেও পাক-ভারত উপমহাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোরবানি দেয়া হয় গরু। এ জন্য এতদঞ্চলে কোরবানির ঈদকেও ‘বকরিদ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয। এখানে ‘বকর’ মানে গরু। এতে এ বিষয়টি স্পষ্ট হলো যে, এক ধর্মাবলম্বীদের ধর্মভিত্তিক উৎসবকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসব হিসেবে সাব্যস্ত করা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।
এ বিষয়ে মৌলিক ও দ্বিতীয় আরেকটি কথা হচ্ছে, ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের কথা বা আক্বীদায় বিশ্বাস করার কোনো সুযোগই নেই। কারণ, ঈমান ও ইসলাম হচ্ছে একক ও নিরঙ্কুশ বিষয়। এখানে কোনো প্রকারের মিশ্রণের ন্যূনতম সুযোগ নেই। আমরা যদি আমাদের দুই ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার পটভ‚মির দিকে তাকাই, তা হলে বিষয়টি আমাদের সামনে আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে। মদিনায় ইসলামপূর্বে দু’টি উৎসব চালু ছিল। নওরোজ (বর্ষবরণ) ও মেহেরজান (নবান্ন উৎসব) নামে। সাহাবিগণ ওই দুটি উৎসব পালন করতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পালনের অনুমতি দেননি। বরং এর উত্তম বিকল্প হিসেবে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র দুটি ধর্মীয় উৎসব- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উপহার দিয়েছেন। এ থেকে এ সত্যটি অনুধাবন করা যায় যে, যদি মুসলমানদের জন্য অন্যদের উৎসব পালন করার সুযোগ থাকত; তাহলে তিনি ওই উৎসব পালন করা থেকে সাহাবিদের বিরত করতেন না।
এ ক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ আমরা গ্রহণ করতে পারি। সেটি হচ্ছে- ১০ মুহাররম বা আশুরার রোজা। ইহুদিদের সাথে যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ বা সাদৃশ্যপূর্ণ না হয়ে যায় সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার রোজার সাথে আগে কিংবা পরে আরো একটি রোজা রাখতে বলেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্ম বা ধর্মানুসারীদের সাথে সাদৃশ্য বা সামঞ্জস্য হওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ হাদিস শরিফে বারবার দেয়া হয়েছে। ইহুদিদের সাথে সামঞ্জস্য অবলম্বন না করতে কিংবা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে বিভিন্নভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাদিস শরিফে বেশ কিছু ক্ষেত্রে (ইহুদিদের সঙ্গে ভিন্নতা অবলম্বন করো, মুশরিকদের কাজকর্মের সাথে ভিন্নতা অবলম্বন করো) বাক্যটি ধ্বনিত হয়েছে। নামাজে আহ্বানের ক্ষেত্রে ইহুদি, নাসারাদের ঘণ্টা বাজানো ও সিঙ্গায় ফুঁঁ দেয়ার প্রথা গ্রহণ না করা, অগ্নি উপাসকদের মতো দেখা যাবে অগ্নি প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে নামাজে আহ্বান নিষিদ্ধ হওয়া, অভিবাদনের ক্ষেত্রে মাথা ঝোকানো, কুর্ণিশ করা, হস্ত উঠানোর বিকল্প হিসেবে সালাম গ্রহণ করা, সপ্তাহের পবিত্র দিন হিসেবে শনি, রবির পরিবর্তে জুমাবারকে গ্রহণসহ এ ধরনের বহু ক্ষেত্র বিদ্যমান, যেখানে ইসলামের আচরণকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন