বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অর্থের যোগানদাতা শিল্প হলো গার্মেন্ট। বিগত দিনে বিভিন্ন সমস্যার কারণে এ শিল্প কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও ইদানীং তার উজ্জীবন ঘটতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্যের চাহিদা বিশ্ববাজারে ব্যাপকমাত্রায় রয়েছে। গার্মেন্ট শিল্প নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার জরিপে তেমনটাই উঠে এসেছে। আমাদের অর্থনীতি এ শিল্পের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। এক বছরের ব্যবধানে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এ শিল্প। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তৈরি পোশাক রফতানিতে ৮১৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার আয় এসেছে। এই আয় গত অর্থবছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। দেশের পোশাক কারখানাগুলোতে ক্রয়াদেশ বৃদ্ধি পাওয়ায় রফতানি আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ, যা তার আগের ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরের অর্থবছর প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ দাঁড়ায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে সেটি বেড়ে ২১ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়। এটি নিঃসন্দেহে খুবই ভালো দিক। বাংলাদেশ গত বছর প্রায় চার থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ফেব্রিক আমদানি করেছে। ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে বাংলাদেশের হয়ত ১০ বিলিয়ন ডলারের ফ্রেবিক আমদানি করা লাগতে পারে। আমদানির এই খরচ কমাতে হবে। খরচ কমানোর জন্য পরিকল্পনা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া আরও বেশি প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। স্পেনে শ্রমিক বাবদ বাংলাদেশের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি। এরপরও দেশটি তৈরি পোশাক শিল্পের প্রতিযোগিতার বাজারে ভালভাবে টিকে আছে। এটা সম্ভব হচ্ছে শুধু উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। ইতালি, মেক্সিকোও প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের পণ্যের উৎপাদন খরচ কমাচ্ছে। চীন, ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের যেসব এলাকায় এখনও পোশাক উৎপাদন হয়, সেখানকার কারখানায় ব্যবস্থাপক খুবই কম। কারণ, উচ্চ বেতনের ব্যবস্থাপকদের পরিবর্তে ওইসব কারখানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে অনলাইনে কেনাবেচা বেড়েছে। দেশের কর্মসংস্থান তৈরিতে তৈরি পোশাক শিল্প বিশাল ভূমিকা পালন করছে। আমাদের এ বিরাট অর্জনের পেছনে কাজ করছে লাখ লাখ শ্রমিক, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ছাড়া এ অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। প্রতিবছর ২৫ লাখ মানুষ শ্রম বাজারে প্রবেশ করছে। ২০২১ সালের লক্ষ্য পূরণের জন্য আমাদের এই বিশাল জনগোষ্ঠির জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গার্মেন্ট শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। যেসব দেশের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতা করি যেমন কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ অনেকেরই অধিকাংশ বিনিয়োগকারী অন্য দেশের। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রায় সবাই এ দেশের, যা গোটা বিশ্বের মধ্যে একটি বিরল ঘটনা।
গার্মেন্ট খাতের সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে ২০২১ সালের মধ্যে আমরা যে মধ্যম আয়ের দেশের কথা বলছি, সেদিকে আরও অনেক বেশি এগিয়ে যেতে পারব। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের যে ঝুঁকিগুলো আছে, সেগুলোর মোকাবেলা কীভাবে করা যায় এ-সংক্রান্ত আলোচনা করা প্রয়োজন। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যে সংশয় থাকলেও কিছু ব্যয় স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়বে। যেমন শ্রমিকদের বছর বছর ইনক্রিমেন্ট ও সময়মতো মজুরি দিতে হবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিনমাসে ৮১৯ কোটি ডলারের পোশাক রফতানির মধ্যে ৪২০ কোটি ৬৮ লাখ ডলার নিট পোশাক থেকে এসেছে। আর ওভেন পোশাকের রফতানি ৩৯৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। ওভেনে ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও নিট পোশাকে তা ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার তৈরি পোশাক বাইরে যাচ্ছে। তথ্য মতে ভিয়েতনামের একটি কারখানার ব্যবস্থাপক পর্যায়ের অধিকাংশই বাংলাদেশি। তাহলে আমাদের ভাবতে হবে যদি বাংলাদেশিদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বিদেশি কোম্পানি চালানো সম্ভব হয়, তাহলে আমাদের দেশের কারখানা চালানোর জন্য কেন বিদেশি ব্যবস্থাপকদের কাছে যেতে হচ্ছে। তৈরি পোশাকে বাংলাদেশ এখন ‘সুপার পাওয়ার’। কিন্তু ইতিবাচক প্রচারণার অভাবে তার পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
তৈরি পোশাক শিল্পকে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বর্তমানে তৈরি পোশাক বাজারে চীন প্রথম অবস্থানে রয়েছে এবং আমরা দ্বিতীয় স্থানে। চীন তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজারের প্রায় ৩৬ শতাংশ সরবরাহ করে। বাংলাদেশ মাত্র ৬ শতাংশ সরবরাহ করে। আমরা এ অর্জনেই অনেক সন্তুষ্ট। এটা কিছুই না। বাংলাদেশের সামনে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য মেশিনারিজ, প্রযুক্তি এসব ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ করতেই হবে। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সমঝোতা স্মারকে সই করে। ইথিওপিয়াতে শ্রমিক অধিকার দেখা হয় না। কিন্তু তাদের কাছ থেকে ক্রেতারা পণ্য কিনছে। এমনকি চীনেও আইনের কিছু নেই। সেখান থেকেও তারা পণ্য কিনছে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন করছে। এগুলো ক্রেতাদের চাপে করা হচ্ছে তা নয়। উদ্যোক্তারা এগুলোর প্রয়োজন অনুভব করেই করছে। আমাদের ব্যবসা আমাদেরকেই টিকিয়ে রাখতে হবে। আমাদের ব্যবসাকে আমাদেরই সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য উদ্যোক্তা, শ্রমিক, সরকার, গণমাধ্যম, বিশেষজ্ঞ, উন্নয়ন সহযোগী সবাই মিলে কাজ করতে হবে।
বৈশ্বিক পর্যায়ে তৈরি পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জগুলো এখন আমাদের সবার সামনে পরিষ্কার। আগামী সাত থেকে আট বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে। তখন আমরা শুল্কমুক্ত পোশাক রফতানির সুবিধা পাব না। যখন আমরা জিএসপি সুবিধা পাব না, তখন তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হবে। কমপ্লায়েন্সের পাশাপাশি পরিবেশসহ ২৭টি ক্যাটাগরিতে আমাদের ফ্যাক্টরিগুলোকে নির্দিষ্ট মানোত্তীর্ণ হতে হবে। বিশ্বের তৈরি পোশাক শিল্পের বাজার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এ ব্যবসায় শীর্ষস্থান ধরে রাখা চীন ভবিষ্যতে এ ব্যবসা থেকে সরে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন চীনের এ বিশাল বাজার ধরার জন্য এ শিল্পখাত প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে।
ইতোমধ্যে মিয়ানমার ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ যেমন ইথিওপিয়া এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। বর্তমানে বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা অনুযায়ী কম দামের পোশাক থেকে বেশি দামের পোশাকের দিকে যাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের বড় উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে তা শুরু করেছেন। আর এখন কমপ্লায়েন্স শুধু শ্রমিকদের বিষয় নয় পরিবেশ, অবকাঠামো ইত্যাদিও রয়েছে।
আবার পোশাকের একদিকে দাম কমছে, অন্যদিকে খরচ বাড়ছে। এ অবস্থায় আগামী দিনের বড় কাজ হবে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানো। শ্রমিকের দক্ষতার চেয়ে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ জন্য প্রযুক্তিতে যেতে হবে। তবে প্রযুক্তির কারণে শ্রমিকরা যাতে বেকার না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সব ব্যবসায়ীকে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে গার্মেন্টস কারখানাগুলোর বেশিরভাগই ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশে অবস্থিত। শ্রমিক স্বল্পতা নিরসনকল্পে এ শিল্পের ভৌগোলিক বিস্তার প্রয়োজন। কারখানাগুলোতে বিরাজমান শ্রমিক সঙ্কট নিরসন এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বিশেষ করে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে পোশাক কারখানা স্থাপন ও অবকাঠামোগত সুবিধা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেই সাথে চট্টগ্রাম বন্দর, মহাসড়ক সুবিধার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, পণ্য পরিবহন দ্রুতায়িত করা এবং লিড টাইম নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। সাথে সাথে এ শিল্পকে আরও গতিশীল করার জন্য সরকারের পক্ষ হতে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যাবস্থা করা যেতে পারে। ঋণ সুবিধা থাকলে এখন যারা এ শিল্পের সাথে জড়িত আছে সাথে সাথে এ শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে আরও নতুন নতুন লোক এগিয়ে আসবে। এতে আমাদের অর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে কমবে দেশের বেকার লোকের সংখ্যাও।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন