বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইতিহাসের উল্টো ব্যাখ্যা

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৩ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

নির্বাচনের পূর্বে সংলাপের কোনো প্রয়োজন নাই, এ মর্মে সরকার অত্যন্ত আপোসবিমুখ থাকলেও সম্প্রতি বিএনপিসহ সকল দলের সাথেই সংলাপ করেছে এবং ক্ষুদ্র পরিসরেও আরো আলোচনা হচ্ছে ও হবে বলে জানিয়েছে। স্বাধীনতাপূর্বকাল থেকেই এ দেশের সংলাপের ইতিহাস অনেক রূঢ়, অনেক কণ্টকময়। ব্যর্থ হয়ে ছিল মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক বা সংলাপ। স্বাধীনতার পর যে কয়টি সংলাপ রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে হয়েছে তাও সফলকাম হয় নাই। জাতি মাঝে-মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বটে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন ছাড়া এর স্থায়ীত্ব ঘটে নাই। যেমনটি নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সাংবিধানিক সংশোধনকে আরও একটি সংশোধনের মাধ্যমে বাতিল করে সরকার এখন বলছে, সংবিধান থেকে একচুলও আর নড়বেন না। এ ‘নড়ানো’ বা ‘না নড়ানো’ থেকেই জাতির দ্বিধাবিভক্তি। তবে নড়ানোর পক্ষেই বেশি মানুষ। এক সময় সরকার বলতো, পাকিস্তানপন্থী, আগুনসন্ত্রাসী বিএনপি-জামায়াত নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় না, কিন্তু এখন দেখা যায়, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে যারা বীর যোদ্ধা ছিল তারাও ৬ নভেম্বর সোরোয়ারর্দী উদ্যানে বিএনপি’র সভাপতিত্বে জনসভা করেছেন। তাদের প্রধান দাবি ছিল, বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ রাজবন্দিদের মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। এখানে জোর গলায় দাবি তুলেছেন জনসভার প্রধান অতিথি ড. কামাল হোসেন, প্রধান বক্তা আ.স.ম আব্দুর রব যারা এক সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ ও দক্ষিণহস্ত ছিলেন। যদিও আওয়ামী ঘরনার বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ড. কামালকে রাজাকার বলেছেন। অন্যদিকে সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় কাদের সিদ্দিকীকে ইতোপূর্বেই বহুবার রাজাকার বলে সম্বোধন করা হয়েছে, যা তিনি নিজের মুখেই প্রকাশ করেছেন। যারা শেখ মুজিবকে অশালীন ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন তারাই এখন সরকারের মন্ত্রিসভায়। এখন মেরুকরণ যা হচ্ছে তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকারের চেতনা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে যখন স্বাধীনতার যোদ্ধারা ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপির মঞ্চে অবস্থান নিয়েছেন? এখন বিষয়টি সহজেই অনুমেয় যে, ‘স্বাধীনতার চেতনার’ একমাত্র সোল এজেন্ট আওয়ামী ঘরনার বুদ্ধিজীবী ও সরকার এ চেতনার কতটুকু বাজারজাত করতে সক্ষম হবেন? ফলে এটাই সাবস্ত করা যায় যে, সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী যারা তাদের পক্ষে থাকবে তারাই ‘স্বাধীনতার চেতনাধারী’ বাকীরা সব পাকিস্তানী রাজাকার (!)
পূর্বেই বলেছি, এ দেশে সংলাপ সফল হওয়ার ইতিহাস খুবই মলিন। কারণ যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের ক্ষমতাকে ধরে রাখার কামনা-বাসনা অনেক তীব্র। সে কারণেই সংলাপ সফল না হলেও কিছু কথা বেরিয়ে আসে, যা থেকে ক্ষমতাসীনরা দেশবাসীকে কতটুকু ওজনে মাপে বা কতটুকু জ্ঞানী বা বোকা মনে করে তা অনুমান করা যায়। প্রথম দিন সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের নিকট যে ব্রিফিং করেছেন তাতে বুঝা যায় যে, সকল রাজনৈতিক মামলার একটি তালিকা তার (ওবায়দুল কাদের) কাছে জমা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। যদি তাই হয় তবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দেশব্যাপী মৃত ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থানরত, অসুস্থ্য, পঙ্গু এমন কি অন্য মামলায় কারাগারে আছে তাদেরসহ হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে যে গায়েবি মামলা হচ্ছে সে সম্পর্কে সরকার অবহিত নয়। এখানে উল্লেখ্য যে, রাজনীতি কোনো সংবিধানিক বা ফৌজদারী অপরাধ নয়, ফলে রাজনীতি করার অপরাধে বিচারের কোনো আইন আমাদের দেশে নাই। তবে প্রতিপক্ষকে দমানোর উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাসিল করার জন্য সরকারের দায়েরকৃত মামলাই রাজনৈতিক মামলা। প্রতি জেলায় প্রতি মাসে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ২৫-৩০-৪০টি গায়েবি মামলা হচ্ছে, যার সাথে সত্যতার লেশমাত্র সম্পর্ক নাই। একদিকে সরকার বলছে রাজনৈতিক মামলার তালিকা দেন, অন্যদিকে প্রতিদিনই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ হাইকোর্টে আগাম জামিন নিতে এসে হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ দ্বিমুখী বাস্তবতায় কি বোঝা যায় যে, সরকার সত্যিই কি কোনো সমাধান প্রত্যাশা করে? রাজনৈতিক মামলার বিষয়ে জ্ঞান দেয়া সমীচীন নয়; প্রধানমন্ত্রীকে তো নয়ই। কারণ তিনি একটি রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে প্রধানমন্ত্রী যদি রাজনৈতিক মামলা মনে করেন, তবে গায়েবি মামলাগুলিও রাজনৈতিক। তফাৎ শুধু এটুকুই; আগরতলা মামলা সাজিয়েছিল পাকিস্তানী পুলিশ, এখন দেশব্যাপী গায়েবি মামলা সৃজন করছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন পুলিশ; যারা আইনের ঊর্ধ্বে নিজেদের মনে করে।
সরকার রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ সরকারের কাজই রাষ্ট্রীয় কর্ম বলে গণ্য হবে। রাষ্ট্র কি মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে? রাষ্ট্র একদিকে বিরোধীদের মামলা দিয়ে অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে ‘গায়েবি’ মামলা দেবে, অন্যদিকে সরকার প্রধান তালিকা চাইবেন, তা কি উপহাসের নামান্তর নয়? সরকার নিজ অবস্থাকে পাকাপোক্ত করার জন্য সংবিধান বা আইন তাদের মন মতো ব্যাখ্যা করে, কিন্তু এখন সে ব্যাখ্যা আর বাজারজাত হচ্ছে না। সরকারের মুখপাত্র প্রেস ব্রিফিং বা সভা-সমাবেশে সরকার বিরোধীদের ‘স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী’ বলে প্রমাণের কম চেষ্টা করেন নাই। তবে তার পারফরমেন্স জনগণ কতটুকু হজম করছে তা ক্ষমতা থাকা অবস্থায় বুঝা যাবে না। জাতিকে দ্বিখন্ডিত করে রাখতে পারলে সরকার হয় লাভবান। ব্রিটিশের ‘ভাগ কর এবং শাসন কর’ নীতি এখন স্বাধীন দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে, যা নিশ্চয় স্বাধীনতার চেতনা হতে পারে না।
জাতিকে বোকা মনে করলেও সরকার যে স্বস্তিতে আছে তা মনে করার দরকার নেই। সরকার যদি আরো একটি একতরফা নির্বাচন করে তখন খুনাখুনী-মারামারি হবে সরকার দলীয়দের মধ্যে, ইতোমধ্যে যা শুরু হয়ে গেছে। সরকারি দল থেকে প্রতি আসনে ডজন খানেক এম.পি প্রার্থী রয়েছেন যারা হাল নাগাদ ভোটার। এমনিতেই বাংলাদেশের রাজনীতি ‘মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা’র মতো ব্যাপার। অন্যদিকে বিরোধীদের নির্যাতনের জন্য একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তা হলে ‘গায়েবি’ মামলা। ‘গায়েব’ থেকে ‘গায়েবি’ শব্দের উৎপত্তি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যদি কোনো দিন গণতন্ত্র ফিরে আসে, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক অবয়য়ে স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানিকগুলির চেতনার উদ্ভব ও জবাব দিহিতার আওতায় আসে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট এই গায়েবি মামলার যুগটি যখন একটি ‘আইনী বর্বরতার’ যুগ হিসাবে চিহ্নিত হবে।
বিএনপি’র তাগিদে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলেও বিএনপি লাভবান হওয়ার দৃশ্যমান অগ্রগতি নাই। কারণ দলীয় চেয়ারপার্সন এখনো কারাগারে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারপক্ষ। কারণ এতোদিন যারা জয় বাংলা বলে বক্তৃতা করতেন তারা এখন বিএনপি’র সভাপতিত্বে বক্তৃতা করে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বক্তব্য রাখছেন। ফলে বিএনপি-জামায়াত স্বাধীনতা বিরোধী চক্র সরকার উৎখাতের চেষ্টা করছে এই ভাঙ্গা রেকর্ড আর বিকাবে না। নীতি-আর্দশের বালাই নাই, টাকা হলেই হলো। এখন এম.পি হওয়ার বড় যোগ্যতা টাকা। টাকা উপার্জনের উৎস ব্যাংক লুট না ভ‚মি দস্যুতা, না ঘুষ ও ঘুষের দালালী তা জনগণ বিচার বিবেচনা করে না, যার টাকা আছে (রাজনীতিতে অবদান থাকুক বা না থাকুক) সেই ব্যক্তিই এম.পি হতে চান, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলিও টাকাওয়ালাদের সম্মান করে। কারণ টাকার অভাবী তারাও। ফলে জাতীয় সংসদ হয়ে উঠেছে কোটিপতিদের ক্লাব এবং এ জন্যই এম.পি প্রার্থী হওয়ার হিড়িক লেগেছে।
জনমতের চাপে সরকার এখন নিশ্চয় বেকায়দায় পড়েছে। ৫ মে শাপলা চত্বরের সমাবেশে হেফাজতের কর্মী হত্যার অভিযোগ হেফাজতের পক্ষ থেকেই করা হয়েছিল। নিহতের সংখ্যা ৬৫ দাবি করায় আই.সি.টি এক্টে ‘অধিকার’ নামক সংগঠনের কর্মকর্তা একজন আইনজীবী জেলে ছিলেন দীর্ঘদিন। অল্প কিছুদিন পূর্বেও মন্ত্রী ও আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা তেঁতুল হুজুর বলে হেফাজত প্রধানের সমালোচনায় মুখরিত ছিল। কালের বির্বতনে তেঁতুল হুজুরের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রী ‘কাওমী জননী’ উপাধিতে ভ‚ষিত হয়েছেন। আওয়ামী ঘরনা হেফাজত প্রধানকে এখন আর তেঁতুল হুজুর বলবেন না, কারণ টক তেঁতুল এখন মিষ্টি লাগছে। তাই দৃঢ়তার সাথে পুনরায় বলছি, রাজনীতি এখন ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’, ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের জন্য যে কোনো এক চেয়ারে বসতে পারলেই হলো। কিন্তু জনগণকে এতো বোকা ভাবা সমীচীন নয়। জনগণ অসহায় এ কারণে যে, ঘরে-বাইরে কোথাও গণতন্ত্র নাই।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Sk Shamim Hossain Narail ১৩ নভেম্বর, ২০১৮, ২:০৮ এএম says : 0
ধন্যবাদ দৈনিক ইনকিলাব
Total Reply(0)
Mahbub Rahman ১৩ নভেম্বর, ২০১৮, ২:০৮ এএম says : 0
মূল্যায়ন ধর্মী লেখা টি পড়ে ভাল লাগল। গণতন্ত্র এর জয় হোক।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন