রোববারের কথা। আফগানিস্তানের গজনি প্রদেশের একটি জেলা শহরের সদর দফতর। একটির পর আরেকটি পিকআপ ট্রাক এসে থামে এসে কমপাউন্ডে। গভর্নরের অফিসের পিছনে শহরের আতংকিত অধিবাসীদের চোখের আড়ালে লাশগুলো নিয়ে আসা হয়েছে।
সৈন্য ও অফিসাররা, অনেকেরই চোখে পানি, সহকর্মীদের মরদেহগুলো নামিয়ে আনেন। সেগুলো একর পর এক রাখা হয় নিচে বিছানো প্লাস্টিক শিটের উপর। মোট ২০ জন। নিহতদের সকলেই আফগানিস্তানের সেরা বাহিনির সৈন্য, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রশিক্ষণ প্রদান করা স্পেশাল ফোর্সেস কমান্ডোর মরু-বাদামি বুট পরিহিত। ৪ দিন আগে তালিবান বিদ্রোহীদের হাত থেকে জাঘোরি জেলাকে মুক্ত করার জন্য বিমানযোগে তাদের পাঠানো হয়েছিল। রোববার সকালের যুদ্ধে তাদের ৫০ জন সৈন্যের কোম্পানির প্রায় পুরোটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর ফলে তালিবানদের নিপীড়নের শিকার সংখ্যালঘু শিয়া জাতি গোষ্ঠি হাজারাদের নিরপাদ আশ্রয় বলে পরিচিত জাঘোরি সম্পূর্ণ রূপে তালিবান কবলিত হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দি নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিকদের একটি ছোট দল তালিবানদের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত প্রচন্ড লড়াইয়ের একটি প্রতীকী গুরুত্ব তুলে ধরতে রিপোর্ট করার জন্য রোববার সকালে জাঘোরির রাজধানী সাং-এ-মাশায় পৌঁছি।
তবে প্রতিরোধের পরিবর্তে আমরা হতাশাগ্রস্ত, ব্যান্ডেজ বাঁধা কমান্ডোদের রাস্তায় হাঁটতে দেখতে পেলাম। আর কর্মকর্তারা আলোচনা করছেন যে কীভাবে তারা তালিবানদের দ্বারা প্রায় ঘেরাও হয়ে পড়া শহর থেকে পালানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করছেন। দিনের শেষে আমরাও পলায়নপর হলাম।
কর্মকর্তারা আমাদের জানালেন যে কমান্ডোদের মধ্যে ৩০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে। আমরা রাস্তায় ও হাসপাতালে আরো ১০ জন আহত কমান্ডোকে দেখতে পেলাম। আমাদের দেখা হল মিলিশিয়া কমান্ডার নাজির হোসেনের সাথে। তিনি জানালেন, পূর্ববর্তী ২৪ ঘন্টায় ৫০ জন পুলিশ ও মিলিশিয়া নিহত হয়েছে। তিনি এখানে এসেছেন আরো সৈন্য সাহায্যের আবেদন নিয়ে। নাজির বললেন, এটা গণহত্যা। কর্তৃপক্ষ যদি শিগগিরই কিছু না করে তাহলে গোটা জেলাই তালিবানদের হাতে চলে যাবে।
জাঘোরির বিপর্যয়ের খবর পাবার পর কাবুলে তার বিরুদ্ধে হাজারারা বিক্ষোভ করেছে। তারা বলেছে, সরকারের দায়িত্বহীনতার কারণেই এটা ঘটছে। এটা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সোমবার তাদের বিক্ষোভের সময় এক আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৩ নারী ও ৩ পুরুষকে হত্যা করেছে। নিহতদের একজন পুলিশ অফিসার। জাঘোরির লোকসংখ্যা ৬ লাখ। তারা দরিদ্র। মধ্যাঞ্চলের উঁচু ভ‚মির বিচ্ছিন্ন অংশে তারা বাস করে। সেখানে কোনো পাকা রাস্তা বা বিদ্যুত লাইন নেই।
তবে এ জেলাটি শান্তিপূর্ণ জেলা হিসেবে খ্যাত ছিল। এখাকার লোকজন শেষ দস্যুতা বা হত্যার ঘটনা কবে ঘটেছে তা মনে করতে পারে না। জেলার শিক্ষার রেকর্ড দেশের বাকি অংশের জন্য অনুপ্রেরণামূলক। মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা প্রায় সর্বজনীন। আর ছেলেদের মধ্যে শিক্ষা গড় আফগান বালকদের মধ্যে সর্বোচ্চ। আফগানিস্তানের অধিকাংশ বিশিষ্ট নারীই জাঘোরির। এখানে মেয়েদের সাইকেল চড়া, গাড়ি চালানো স্বাভাবিক ব্যাপার যা অন্যান্য আফগান শহরে অজানা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাঘোরি জেলা দেশের বাকি অংশ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন, এর বেশির ভাগ অংশই নিয়ন্ত্রণ করে তালিবান। তারা সাং-এ-মাশা অভিমুখী প্রধান সড়কগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
তিন বছর আগে এখানে একটি ছোট বিমানক্ষেত্র নির্মাণ করা হয়। তবে আজো তা চালু হয়নি। যারা জরুরি কাজে জাঘোরির বাইরে যেতে চান তাদের দূরগামী ট্রাকের ড্রাইভাররা লুকিয়ে নিয়ে যায়। এ জন্য তারা জনপ্রতি নিত প্রথমে ৫০ ডলার। গত সপ্তাহে তা সাড়ে ৩৫০ ডলারে পৌঁছেছে।
এক সপ্তাহ আগে তালিবান এক দীর্ঘস্থায়ী শান্তি চুক্তি ভঙ্গ করে এবং জাখোরির উপর ত্রিমুখী হামলা চালায়। তারা জেলার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। ফলে সরকারি সৈন্যদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
জাঘোরিতে একটি এতিমখানা ও হাসপাতাল পরিচালনাকারী দাতব্য সংস্থা শুহাদায় কর্মরত মুবারেজ নদিজাদা বলেন, তালিবান এখানে হামলা করছে, কারণ এখানে সবচেয়ে বেশি স্কুল আছে এবং এখানে স্কুলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি।
জাঘোরি জেলায় সবচেয়ে জোর লড়াই চলছে হটকোলে। সাং-এ-মাশা থেকে কয়েক মাইল দূরে স্থানটি। ৫ নভেম্বর থেকে তালিবান হামলা শুরু করেছে। তারা ৮টি সীমান্ত চৌকিতে হামলা করে যেগুলোতে স্থানীয় মিলিশিয়ারা দায়িত্বরত ছিল।
সোভিয়েত বিরোধী লড়াইকালে খ্যাতি লাভকারী এক হাজারা কমান্ডার জেনারেল হাবিবুল্লাহ বাশি প্রথম দিনের হামলায় নিহত হন। তার ৩০ জন সশস্ত্র অনুসারী নিখোঁজ। তাদের মধ্যে তার ৩ ছেলেও রয়েছে। তার ছেলে ১৯ বছরের মোহাম্মদুল্লা বাশি জানান, সম্ভবত তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে।
তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী সাভিদ হোসেন পালিয়ে যান। রোববার পিকআপ ট্রাকের পিছনে মেশিনগানের পাশে তাকে দেখা যায়। স্থানীয় বহু হাজারার মত তিনিও ক্ষিপ্ত যে সরকার তাদের রক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। (অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন