প্লাস্টিক তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে কোটেড ক্যালসিয়াম কার্বোনেট লাগে। বর্তমানে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই এখন প্লাস্টিক। এখন কাঠ, লোহা, সিরামিক, কাঁচ ইত্যাদি পণ্যের পরিবর্তে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার হচ্ছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের দৌড়াত্ম্য দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে, যদিও বৈদেশি ডলার আয় হচ্ছে। বাংলাদেশের বিকাশমান শিল্পখাতের মধ্যে প্লাস্টিক অন্যতম। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সকল পণ্যই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা হয়। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রফতানি হচ্ছে প্লাস্টিক পণ্য। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের জুলাই-অক্টোবর পযর্ন্ত প্লাস্টিক পণ্য রফতানি করে প্রায় ৪ কোটি ডলার আয় হয়েছে, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৩ দশমিক ১৪ শতাংশ বেশি। সার্কভুক্ত দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে বেশি প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি হয়।
প্রশ্ন হলো, মানুুষের জন্য পৃথিবী, না প্লাস্টিকের জন্য পৃথিবী? প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছি ঠিকই কিন্তু যদি সেই অর্থ মানুষের কাজে না লাগে বা প্রাণিকূলের ক্ষতির কারণ হয়, অসুখ-বিসুখের কারণ ঘটে, পরিবেশের ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে আমাদের প্লাস্টিক পণ্য রফতানির প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন আছে কি ?
প্রাণিকূলের অনুকূলে যা মঙ্গলকর তাই আমাদের উৎপাদন করা আবশ্যক। তা নাহলে ভবিষৎ প্রজন্ম বিপদের সম্মুখীন হবে। পৃথিবী হবে বিষাক্তময়, দুর্গন্ধময়, হবে রোগ জীবাণু সংক্রামক ব্যাধি। রোগে আক্রান্ত মানেই কর্মক্ষমতা হারানো বিগত ২৮ অক্টোবর একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘মানুষের মলে প্লাস্টিক’ ওই খবরে। জানা যায়, বিভিন্ন গবেষণায় পশুর পরিপাকযন্ত্রে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক পাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমনকি এগুলোর রক্ত, নাসিকা ও যকৃতেও প্লাস্টিকের উপস্থিতির প্রমাণ মিলছে। তবে এবার নতুন তথ্য দিলেন গবেষকরা। তারা বলছেন, মানুষের মলে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। তা-ও আবার এক প্রকারের নয়, গুনে গুনে নয় প্রকার প্লাস্টিক শনাক্ত করেছেন গবেষকরা। খবর ডয়চেভেলের। গবেষণাটি করেছেন অস্ট্রিয়ার একদল গবেষক। দেশটির মেডিকেল ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনা ও ফেডারেল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সি যৌথভাবে গবেষণাটি করে। এই পাইলট গবেষণায় অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন, ফিনল্যান্ড, ইটালি, নেদারল্যান্ড, পোল্যান্ড, রাশিয়া ও জাপানের আটজনের এক সপ্তাহের খাবারের রুটিন পর্যবেক্ষণ করা হয়। ওই আটজনকে বলা হয়, নির্দিষ্ট সপ্তাহে তারা কী কী খেয়েছেন বা পান করেছেন, তার একটা তালিকা ডায়েরিতে লিখে রাখতে। পরবর্তীতে তাদের মলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, আটজনের সবাই প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভেতর থাকা খাবার খেয়েছেন কিংবা প্লাস্টিক বোতল থেকে পানি খেয়েছেন। তাদের কেউই নিরামিষভোজী ছিলেন না। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাদের প্রত্যেকের মলের নমুনায় প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। গবেষণাগারে করা এই পরীক্ষায় তাদের মলে নয় (৯) ধরনের প্লাস্টিক পেয়েছে। এগুলোর আকার ৫০ থেকে ৫০০ মাইক্রোমিটার। গবেষকদের ধারণা, প্লাস্টিকের রাসায়নিকের কারণে পরিপাকযন্ত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে, কিংবা প্লাস্টিক উপাদানের উপস্থিতির কারণে তা ফুলে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে মানুষের শরীরে আসলেই কী ধরণের প্রভাব পড়ার আশক্সক্ষা আছে- তা প্রকৃতভাবে নির্ণয়ের জন্য আরও গবেষণা দরকার। ঠিক কোন ধরনের খাবারে কোনো ধরনের প্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে তা অবশ্য বলতে পারেনি গবেষকরা। তবে তারা বলছেন, খাবার ছাড়াও মানব শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎস হতে পারে গাড়ির টায়ার, নির্মাণ সামগ্রী এবং কসমেটিকের উপাদান। অবশ্য ঝুঁকি নিরূপনের জন্য জার্মানির যে ফেডারেল ইন্সটিটিউট কাজ করে, তারা বলছে, প্লাস্টিক মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর কিনা কিংবা কতটা ক্ষতিকর তা নির্ধারণ করা এখনও সম্ভব হয়নি। প্লাস্টিক প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা থেকে আমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। অন্যথায় খুব শিগগিরই এদেশ মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।
উপর্যুক্ত আলোচনা ও পর্যালোচনা থেকে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মানুষের জন্য প্লাস্টিকের পাত্র, বোতল, প্লেট, গ্লাস, জগ, বালতি, পানির ট্যাঙ্ক, পাইপ, চামুচ, প্লাস্টিকের রাইস কুকার ইত্যাদি তৈরি থেকে প্লাস্টিক কোম্পানিগুলোকে বিরত রাখতে হবে। শুধুমাত্র দরজা, জানালা, র্যাক, টায়ার, টিউব ইত্যাদি তৈরি করার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক নীতি নির্ধারণ করা একান্ত প্রয়োজন। তা-নাহলে মানুষ তো বটেই অন্য প্রাণিকূল ধ্বংসের সম্মুখীন হতে পারে ভবিষৎতে বলে। বিষয়টি রাষ্ট্র এমনকি পরিবেশবাদীগণ একবার চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন কি?
লেখক: অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট জয়পুরহাট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন