সরকার বলছে, দেশ উন্নয়নের সাগরে ভাসছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ দেশের অর্থনীতির যে অগ্রগতি তার সুফল পাচ্ছে না। দেশের মোট জনশক্তির বড় অংশ প্রবৃদ্ধির সুফল থেকে বঞ্চিত। উন্নয়ন হলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। জিডিপির প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে সে অনুসারে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। দেশে যে আর্থিক বৈষম্য বিরাজমান রয়েছে তা অর্থনীতি, পরিবেশ, সমাজ ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। অন্যদিকে শিক্ষার ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়েছে এর প্রভাব পড়ছে সার্বিক কর্মসংস্থানের উপর। প্রায় এক কোটি প্রবাসী যদি আর্থিক খাতে সকল লেনদেন বন্ধ করে দিতো তাহলে বাংলাদেশের এক থেকে দুই মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম হতো না।
আমাদের দেশে মানহীন শিক্ষ কর্মসংস্থানে রাষ্ট্রের উন্নতির বড় বাধা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত সামাষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে বিশিষ্টজনদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে আসে। গত ৪ নভেম্বর অর্থনীতিবিদ আবদুর গফুর স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য দেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিএড) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য, বিআইডিএসের রিসার্স ফেলো ড. বিনায়ক সেন, সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। সকলেরই বক্তব্যের সারাংশ হলো, দেশের অর্থনীতিতে বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এটি শুধু সম্পদের ক্ষেত্রে নয় আয় ও ভোগের ক্ষেত্রেও। সম্প্রতি যোগ হয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা ও আঞ্চলিক বৈষম্য। তারা আরো বলেছেন, বছরে ৯৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বাজার ব্যবস্থায় আয় অনুপাতে ব্যয় বাড়ছে। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। একটি ইতিবচিক দিক হলো, শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে একটি বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গড়ে তোলা। বাংলাদেশের বয়স ২০২১ সালে ৫০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। তখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণার ওয়েলথএক্সের সর্ব সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে যে কথাটি বলতে হয় তা হলো, গত ৫ বছরে বিশ্বে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হারের বিবেচনায় সর্বশীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যয়ের বোঝা বেড়েছে আর কমেছে আয়। এক কথায়, টাকা এখন ব্যাগে করে নিয়ে যাবেন আবার ঐ ব্যাগেই পণ্য কিনে ঘরে ফিরবেন। আমাদের অর্থনীতির মূল কাঠামোটা যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে মনে হচ্ছে দেশের চেহারার চেয়ে মানুষের চেহারার পরিবর্তন দ্রুত গতিতে বাড়ছে। বিগত এক মাসে প্রায় কয়েক শত প্রকল্প অনুমোদনের যে হিড়িক লক্ষ করা গেছে তা অন্য কোনো দেশে লক্ষ করা যায় বলে আমাদের জানা নেই। নির্বাচনকে টার্গেট করে জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে এসব প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) কাজই হলো নতুন নতুন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া। পদ্মাসেতু প্রকল্প শেষ হতে এখনো এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ একটি প্রকল্প শেষ হতেই সময় লাগছে যেখানে ৪ থেকে ৫ বছর সে ক্ষেত্রে দেশের চলমান মেগা প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে, তা ৫০-এর উপরে বয়সী মানুষেরা চোখে দেখে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ।
নভেম্বর ২০১৮ সালে খোলা বাজারে এলপি গ্যাস কিনতে হচ্ছে ১২ লিটার (যার অর্ধেকই হাওয়া) ১২৫০ টাকায়। তিন মাস আগে এর দাম ছিল ১০০০ টাকা। ২ মাসের ব্যবধানে বেড়ে গেল ২৫০ টাকা। নালিশ করার জায়গাটা পর্যন্ত এখন খোলা নেই। বুকের ব্যাথা শুধু বুকের মধ্যে চেপে রাখা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। ৭ নভেম্বর ২০১৮ এক মন্ত্রীর কথা পত্রিকায় উঠেছে এভাবে: ৩৮ বছরের কাজ ৭ বছরে করেছি। বর্তমান অর্থনীতির আকার ২৭৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নতি হয়েছে, যা ৩৮ বছরের সরকারেরা পারেনি। কিন্তু বাস্তবে জনগণ এসব উন্নয়নের কতটুকু অংশীদার হতে পেরেছে এবং এদের শতাংশ হার কত, এসব বিবেচনায় রাখতে হবে। এখন ৫ শত টাকা বাজারে নিয়ে গেলে শুধু সবজি কিনে বাসায় ফিরতে হয়। সরকার বলছে, প্রায় ১ হাজার ৮ শত মার্কিন ডলার মাথাপিছু গড় আয় ২০১৮ সালে অর্জন সম্ভব হয়েছে। ঘুষখোর, লুটেরা এবং দুর্নীতিবাজদের টাকা যোগ করলে মাথাপিছু গড় আয় যথার্থ বলা যায়। কিন্তু তাদের টাকা বাদ দিলে ৭ শত ডলার মাথাপিছু গড় আয় হবে বলে মনে হয় না। আয়-রোজগার ভালো হলে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে ভিক্ষুক-মিসকিনদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে কেন? এখনতো পরিবহনে চলাই যায় না এদের যন্ত্রণায়। এর পাশাপাশি হকারদেরও জ্বালাযন্ত্রণা বাড়ছে। ফুটপাত দখল এমনকি পরিবহন, মসজিদ, মাদরাসা সব জায়গায় এদের উৎপাত লক্ষনীয় মাত্রায় বেড়েছে। বর্তমানে সরকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছে কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সেই হিসাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা তাকিয়ে থাকে প্রতিবছর বেতন কত বেড়েছে। যদি দেখে শতকরা ২০ শতাংশ বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তখন ব্যবসায়ীরা যৌথ উদ্যোগে শলাপরামর্শ করে বাজারে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। এর সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী মহল জড়িত থাকে বিধায় অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
৭ নভেম্বর ২০১৮ একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, আমদানি ব্যয় যেভাবে বেড়েছে রেমিটেন্স ও রফতানি আয় সেভাবে বাড়েনি। ফলে গত দুই বছরে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর ধাক্কা লেগেছে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে। ফলে ক্রমবর্ধমান রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে বেশি, রাষ্ট্রের রেমিটেন্স ও রফতানি আয়ের তুলনায় অনেক দিন যাবৎ কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স সরকারের ঘাটতি বাণিজ্য নিয়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে দেশের আমদানি ব্যয় হয়েছে ৫৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থ বছরের জুলাই ও আগস্টে আমাদানিতে আট দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি মাসেই দেশের আমদানি ব্যয় হচ্ছে গড়ে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার। গত সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ৫৬৯ মিলিয়ন ডলার। ঐ সময়ে আমাদনি ব্যয় হয়েছে রফতানি আয়ের প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪ হাজার ৭৪৫ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার। চলতি হিসাবের দীর্ঘদিনের এই ঘাটতি নেতিবাচক ধারায় নিয়ে গিয়েছিল ব্যলেন্স অব প্যামেন্টের। অর্থনীতির এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা অর্থাৎ বৃদ্ধি এবং কমে যাওয়া বাংলাদেশের ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্জ নিয়ন্ত্রণ করে।
সম্প্রতি সরকারি রাজস্ব বিভাগ আয়কর বাড়ানোর জন্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মাইকিং করে জনগণের বাসাবাড়িতে জানান দিচ্ছে বিদেশ থেকে আর ঋণ গ্রহণ নয় নিজের আয়ে দেশ চালাবো। কর দিলে ঋণ কমবে, মানুষ স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করতে পারবে। সাধারণ মানুষের যে আয় সে তো আয়করের আওতায় পড়ে না। কর যারা দেবেন তারা দিচ্ছেন ফাঁকি। এদের ধরুন। কর ফাঁকি দেওয়ার নানা ফন্দিফিকির এরাই করছেন। উপার্জিত কালো টাকা তারা কোথায় বিনিয়োগ করছেন তা অনুসন্ধান করুন। কর মেলা করে কর ফাঁকি রোধ করা সম্ভব নয়। উদীয়মান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে করের আওতায় আনুন। অবৈধ আয়ের উৎসগুলো বন্ধ করুন এবং কালো টাকার উপর কর ধার্য করুন। আমদানির এবং রফতানির মধ্যে ভারসাম্যযুক্ত একটি অর্থনীতি দেশের জন্য অতীব জরুরি। সে দিকে নজর দিন। তাহলেই বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে যাবে।
লেখক: গ্রন্থকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন