বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ সা. আল্লাহর দ্বীন বা ধর্মের সর্বশেষ আহ্বায়ক, নবী এবং রাসূল রূপে এই ধরার বুকে আগমন করেছিলেন। তিনিই ছিলেন আল্লাহর রাষ্ট্রের আমীর, শাসক, পরিচালক এবং রাষ্ট্রনায়ক। এ জন্য তার নির্দেশ মান্য করা মূলত আল্লাহর নির্দেশ মান্য করারই শামিল। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।’ (সূরা নিসা : আয়াত: ৮০)। হাবীবে কিবরিয়া মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর পর্যায়ক্রমে যারা তার স্থলাভিষিক্ত খলীফা পদে বরিত হয়েছিল, তাদের শাসনামলে ও ধর্ম এবং রাষ্ট্রের মাঝে পরিপূর্ণ অভিন্নতা এ একানুবর্তিতা বিদ্যমান ছিল। তারা একদিকে যেমন ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক, মুসলমানদের আমীর ও হাকিম, তেমনি অপর দিকে তারা ধর্মের ইমাম এবং মুজতাহিদও ছিলেন। এ জন্য তাদের নির্দেশ পালন ও বাস্তবায়ন মূলত আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ ও হুকুম প্রতিপালনই ছিল।
সুতরাং আজও এমনকি ভবিষ্যতেও মুসলমান রাষ্ট্রনায়ক বা বাদশাহের নির্দেশাবলি অবশ্যই পালনীয়, যদি তা আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশের খেলাপ না হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার আমীরের আনুগত্য করল, সে যেন আমারই আনুগত্য করল। এবং যে ব্যক্তি আমার আমীরের নাফরমানি করল, সে যেন আমারই নাফরমানি করল।’ (সহিহ বুখারি : কিতাবুল আহকাম, খন্ড ২, পৃ. ১০৫৭ এবং সহিহ মুসলিম : কিতাবুল এমারাত, খন্ড ২, পৃ. ২২৩, মিসরে ছাপা সংস্করণ)।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সবচেয়ে বড় মানদন্ড হচ্ছে রাষ্ট্র ও ধর্মের এই ইত্তেহাদ ও একানুবর্তিতা। আল্লাহপাকের নির্দেশ মোতাবেক ইসলামী রাষ্ট্রের যে কোনো কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রেজামন্দির উদ্দেশ্যে যদি সম্পন্ন করা হয়, তা-ই প্রকৃত ধর্ম ও যথার্থ ইবাদত। এই নিরিখে, আমীর উমারাহদের প্রজা সাধারণের খেদমত করা এবং প্রজা সাধারণ আমীরের নির্দেশাবলি পালন করাও আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের শামিল, যদি উভয়ের উদ্দেশ্যই হয় আল্লাহর নির্দেশের বাস্তবায়ন।
মোট কথা, ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র এবং ধর্মের মাঝে পার্থক্য কাজ কর্মের শ্রেণীভেদের দিক থেকে নয়, বরং তা কাজ কর্মের নিয়ত বা উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সূচিত হয়। ধর্ম হচ্ছে আইন ও বিধান এবং রাষ্ট্র হচ্ছে তার প্রয়োগ ক্ষেত্র। এ জন্য প্রয়োগক্ষেত্রের চাহিদা অনুসারে নিয়ত বা উদ্দেশ্যের মাঝে পার্থক্য দেখা দেয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। বস্তুত আল্লাহর জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক বিষয়ক যে কোনো কাজ যদি আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক সম্পন্ন করা হয়, তা-ই ধর্ম।
তাই ইমামের ইমামত, খলিফার খেলাফত, প্রজা সাধারণের প্রজায়িত্ব, গভর্নরের কর্তব্য ও কর্তৃত্ব, আমীরের নেতৃত্ব, বিচারকদের বিচার মীমাংসা, প্রজা প্রতিপালন, কাজীর কঠোরতা, কর্মচারীর কাজ-কর্ম, সৈনিকদের যুদ্ধবিগ্রহ, মুজাহিদগণের জিহাদ, খাজনা আদায়কারীদের আদায় কর্ম, উমারাদের আবশ্যিক আনুগত্য ইত্যাদি রাষ্ট্রের যে কোনো শাখার যে কোনো কাজ যদি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আল্লাহর জন্য সম্পন্ন করা হয়, এর সব কিছুই ধর্ম এবং আনুগত্য ও নৈকট্য লাভের জরুরি উপাদান।
রাষ্ট্রনায়ক নিজ রাষ্ট্রের উমারাগণ নিজ নিজ এলাকার এবং অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ নিজ নিজ দায়িত্ব, কর্তব্য ও খেদমত পরিহার করে যদি রাত-দিন কোনো প্রকোষ্ঠে বসে আল্লাহর স্মরণ ও জিকিরে নিমগ্ন থাকে, তবে তারা আল্লাহর নিকট নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হতে গাফেল বা সীমালঙ্ঘনকারী বলে বিবেচিত হবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন শাস্তি ও আজাবের ভাগী হবে।
এ জন্যই ইসলাম আল্লাহর আরোপিত ফরায়েজ, ওয়াজিবাত ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাত সংক্রান্ত নির্দেশাবলি পালন করার সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করাকে উত্তম ইবাদত হিসেবে গণ্য করেছে। যেন প্রত্যেকেই একান্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্য পালনে যত্মবান হয়। আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের শোকরিয়া আদায়ে তৎপর হয়। এ প্রসঙ্গে জামে তিরমিজিতে একটি হাদিস সঙ্কলিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে রাষ্ট্রনায়ক ও হাকিম অভাবী ও ফরিয়াদিদের থেকে নিজের দরজা বন্ধ করে দেয়, আল্লাহপাক তার প্রয়োজনের সময় আকাশের দরজা বন্ধ করে দেবেন।’ (জামে তিরমিজি : আবওয়াবুল আহকাম, খন্ড ২, পৃ. ২২৭, মিসরে ছাপা সংস্করণ)।
খোলাফায়ে রাশেদিন এই নির্দেশাবলিকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পালন করতেন। এ জন্য তারা নিজেদের গৃহদ্বারে ইট-বালির দ্বারা কোনো দেয়াল নির্মাণ করেননি, বরং গৃহদ্বারে একজন গোলাম বা চাকর নিয়োজিত করে রাখতেন, যারা ফরিয়াদির আবেদন তাদের নিকট পৌঁছে দিত। কিন্তু সাধারণ মজলিসে, মসজিদে ও আদালতে উপস্থিত ব্যক্তিরা নির্ভয়ে নিজেদের আবেদন পেশ করতে পারত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন