গীবত বা পরোক্ষ নিন্দা বলতে বোঝায় ‘কারো অগোচরে তার এমন দোষত্রুটি অন্যের নিকট প্রকাশ করা, যা শুনতে পেলে সে মনে কষ্ট পায়।’ আরবি অভিধানের বিশ্লেষণ অনুসারে গীবত বলা হয় কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ বয়ান করা। কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষা অনুসারে গীবতের জন্য সেই ব্যক্তির অনুপস্থিতির শর্তারোপ করার প্রয়োজনীয়তা নেই।
শব্দটির মূল ধাতুর সাথে সঙ্গতি রক্ষার্থে অভিধানকারগণ গীবত বলতে ওই সকল দোষ বর্ণনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, যা কারো অনুপস্থিতিতে করা হয়। তাদের দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষভাবে দোষ বর্ণনাকে গীবত বলা যাবে না ঠিকই, কিন্তু তা গালি-গালাজ বলে অভিহিত হবে। এই গালি-গালাজ ও দুর্গন্ধযুক্ত মৃতের গোশতের সমতুল্য।
অনুরূপভাবে গীবত শুধুমাত্র সুখের কথার সাথেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং হাত-পা এবং চোখের দ্বারাও গীবত করা যায়। যেমন এক ব্যক্তি পঙ্গু। তার এই পঙ্গুত্ব দোষটি প্রকাশ করার জন্য পঙ্গুর মতো চলাও গীবতের অন্তভর্‚ক্ত। একবার হযরত আয়েশা রা. কোনো এক ব্যক্তির চলন অনুকরণ করেছিলেন। এতে রাসূলুল্লাহ সা. অত্যন্ত অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। (আবু দাউদ : কিতাবুল আদব, গীবত অধ্যায়)।
একইভাবে চোখ ও ভ্রুর ইঙ্গিত ইশারায় কারো দোষ বর্ণনা করাও গীবতের সমতুল্য। কুরআনুল কারিমের বিভিন্ন আয়াতে এ জাতীয় প্রচ্ছন্ন ও লুক্কায়িত গীবতের ত্রুটিসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘পশ্চাতে নিন্দাকারী, যে একের কথা অপরের নিকট লাগিয়ে বেড়ায়।’ (সূরা কলম : আয়াত ১১)।
অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে।’ (সূরা হুমাজাহ : আয়াত ১)। গীবত সম্পর্কে মহান আল্লাহপাক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা একে অন্যের গীবত করো না।’ তোমাদের কেউ তোমাদের মৃত ভ্রাতার গোশত খেতে কি পছন্দ করো? নিশ্চয়ই তোমরা তা পছন্দ করো না এবং আল্লাহকে ভয় করো, অবশই আল্লাহ তাওবাহ কবুলকারী ক্ষমাশীল।’ (সূরা হুজরাত : আয়াত ১২)।
গীবতের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘গীবত হলো তোমাদের ভ্রাতাদের ওইসব কথা অসাক্ষাতে আলোচনা করা যা শ্রবণ করলে তারা মনে কষ্ট পাবে। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ভ্রাতাদের মাঝে যদি যথার্থই সে সব দোষ থাকে, যা আলোচনা করা যায়, তবুও কি তা গীবত হবে? প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তাদের মাঝে যদি প্রকৃতই সে সব দোষ থাকে তবেই গীবত হবে। আর যদি সে সব দোষ না থাকে, তা হলে তাদের ওপর মিথ্যার অপবাদ দেয়া হবে।’ (সহিহ মুসলিম : কিবাতুল আদব)।
ইসলামি শরিয়তের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমানদের ইজ্জত-আব্রু মাহফুজ রাখা এবং তাদরে পারস্পরিক সম্পর্ককে সুন্দর ও সুগঠিত রাখা। এ কারণে যে সকল দুশ্চরিত্রতা ও অসাদাচরণের দরুণ মুসলমানদের ইজ্জত এবং আব্রুর ওপর আঘাত লাগে এবং পরস্পর সম্পর্কের মধ্যে অশান্তি ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়, ইসলাম সেগুলোকে নিসিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহপাক সমষ্টিগতভাবে এগুলোকে এভাবে তুলে ধরেছেন।
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না।’ ঈমানের পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ হতে নিবৃত্ত না হয়, তারাই জালিম। হে মুমিনগণ, তোমরা বহুবিধ অনুমান হতে দূরে থাকো। কেননা, অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না, তোমাদের মধ্যে কি কেউ স্বীয় মৃত ভ্রাতার গোশত ভক্ষণ করতে চাইবে? বস্তুত: তোমরা একে ঘৃণাই মনে কর, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ তাওবাহ কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সূরা হুজরাত : আয়াত ১১-১২)।
এই আয়াতে বর্ণিত নৈতিক নির্দেশাবলির দ্বারা প্রমাণীত হয় যে, মুসলমানদের উচিত নিজের কথাও কাজ দ্বারা অন্য মুসলমানের দোষ প্রকাশ না করা। যে পন্থায় অন্যের ইজ্জত-আব্রু বিনষ্ট হয় তা হলো গীবত বা নিভৃতে পরদোষ চর্চা করা। এ প্রসঙ্গে ইমাম গাজ্জালী রহ. এহইয়াউ উলুমুদ্দিন গ্রন্থে য লিখেছেন, তা খুব প্রণিধানযোগ্য। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘অবজ্ঞা, অবহেলা, বেশি কথন, ইঙ্গিত, ইশারা লেখনী ও কিতাবতের মাধ্যমে এবং হাসি-তামাশার মাধ্যমে অন্যের দোষ বয়ান করা যায়।
এমন কি একজন লোকের বংশ, চরিত্র দ্বীন-দুনিয়া, অবায়ব, পরিধেয় বসন, মোটকথা প্রত্যেক বস্তুরই দোষ বের করা যায়। এ কারণে মহান আল্লাহপাক নেহায়েত দৃঢ়তা সহকারে এগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন এবং এ সকল কাজেকে মৃত ভ্রাতার গোশত ভক্ষণের সাথে তুলনা করেছেন।’ তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, গীবত বা পরোক্ষ নিন্দার ছোঁয়াচ হতে দূরে থাকা এবং নৈতিক পবিত্রতাকে অক্ষুন্ন রাখা। যেন মহান আল্লাহপাকের পরম দযার শামিয়ানার নিচে আশ্রয় লাভ করা সহজতর হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন