শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

আল্লাহর রাসূল (সা.)’র যেয়ারত ও তাঁর গুরুত্ব

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

পবিত্র মদিনায় শায়িত রয়েছেন আল্লাহ পাকের হাবীব সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (স.)। পবিত্র মদিনায় গমন করে নবী পাক (স.)’র রওজাপাকে সালাম দিতে পারাটা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার।
সেকালে নবী প্রেমিকেরা অনেক কষ্ট স্বীকার করে উটে চড়ে পায়ে হেঁটে পবিত্র মক্কা থেকে ১৩ দিনে পবিত্র মদিনায় পৌঁছতেন। হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) হজ্বের সাথে পবিত্র মদিনায় গমন করাকে যথাযথ তাজিম মনে না করে পৃথকভাবে অন্য সময় পবিত্র মদিনায় গমন করেছিলেন যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। আল্লামা জামী (রহ.) শুধুমাত্র যেয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদিনায় গমন করেন। এতে হজ্বকে একত্রিত করেন নি। ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) মতান্তরে অন্য ইমাম পবিত্র মদিনায় গমন করে ৩ দিনের বেশি অবস্থান করতে পারেন নি তাজিম রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না এ ভয়ে। অর্থাৎ এ সময় পবিত্র মদিনায় পেশাব পায়খানা করেন নি। হযরত ইমাম মালেক (র.) পবিত্র মদিনায় ওফাত পাওয়ার লোভে জীবনে মাত্র একবারই হজ্ব করেছেন এবং পবিত্র মদিনার বাইরে জরুরী প্রয়োজনে কোথাও গেলে দ্রæত ফিরে আসতেন। যেহেতু পবিত্র মদিনার বাইরে ওফাত ঘটতে পারে এ ভয় তাঁকে তাড়িত করত। বিশ্বের মহান ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণের অনেকে তাদের কিতাবে লিখেছেন নবীপাকের রওজা শরীফে যতবারই সালাম পেশ করা হউক না কেন মাত্র ১ বার যদি জবাব পাওয়া যায় তবে জীবন ধন্য মনে করতে হবে। মহান আলেমে দ্বীন হযরত আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী (রহ.) তাঁর প্রসিদ্ধ “জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব” গ্রন্থে বলেছেন, পবিত্র মক্কা শহর থেকে পবিত্র মদিনা শহর মর্যাদাবান। পবিত্র মদিনা শহর থেকে খানায়ে কাবা মর্যাদাবান। খানায়ে কাবা থেকে রওজাপাক মর্যাদাবান। অর্থাৎ নবী পাক (স.)-কে যে মাটি ধারণ করে আছে তার মর্তবা মহান আল্লাহ পাকের সমস্ত মাখলুকের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্তবাবান স্থান। মহান বুজুর্গানে দ্বীনগণ মন্তব্য করে গেছেন, বাইরের কেউ যাতে পবিত্র মদিনায় গিয়ে বসবাস না করেন। যেয়ারতের উদ্দেশ্যে অবস্থানের পর গন্তব্যে যেন ফিরে আসে। কারণ পবিত্র মদিনার স্থায়ী বাসিন্দাগণের পারিপার্শ্বিক অবস্থা গ্রহণযোগ্য ও বিবেচিত কিন্তু বাইরের কারও এদিক ওদিক হলে তার পরিণতি ভয়াবহ।
হযরত মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) বলেছেন, কতেক লোক ব্যতীত সারা বিশ্ব-মুসলিমের অভিমত হল নবী পাক (স.)’র যেয়ারত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং পুণ্যময় ইবাদত। এ যেয়ারতে কামিয়াবি সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছবার একটি মাত্র উপায়। যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্তে¡ও নবী পাক (স.)’র রওজা পাকে আসল না সে নিজের নফসের ওপর জুলুম করল। চার মাজহাবের প্রখ্যাত ইমামগণ এ বিষয়ে একমত যে, নবী পাক (স.)’র রওজা পাক যেয়ারতের নিয়ত করা মুস্তাহাব। কেহ কেহ ওয়াজিবও বলেছেন। শরহে কবীরে লিখিত আছে, হজ্ব করার পর নবী পাক (স.) এবং তাঁর দু’ সাথীর যেয়ারতের জন্য গমন করা মুস্তাহাব।
হযরত ওমর (র.) থেকে বর্ণিত, নবী পাক (স.) এরশাদ করেন আমার ওফাতের পর যে আমার যেয়ারত করল সে যেন জীবিত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল। (বায়হাকী, তীবরানি)
নবী পাক (স.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার যেয়ারত করবে, কিয়ামতের দিন সে আমার প্রতিবেশী হবে। আর যে (পবিত্র) মদিনায় বসবাস করে ওখানের দুঃখ কষ্টের ওপর ছবর করবে, তাঁর জন্য কিয়ামতের দিন আমি সাক্ষী থাকব এবং সুপারিশ করব। আর যে ব্যক্তি হারমে (পবিত্র) মক্কা অথবা হারমে (পবিত্র) মদিনায় ইন্তেকাল করবে সে কিয়ামতের দিন নিশ্চিন্তে থাকবে। (বায়হাকী)
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (র.) সিরিয়া থেকে উটের ছওয়ারি করে পবিত্র মদিনায় দূত তথা প্রতিনিধি প্রেরণ করতেন তাঁর পক্ষে রওজাপাকে সালাম পেশ করার জন্য।
ইহুদীদের বিখ্যাত পন্ডিত হযরত কা’বে আহবার যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন আনন্দিত হয়ে হযরত ওমর (র.) তাঁকে নবী পাক (স.)’র রওজা পাক যেয়ারতের উদ্দেশ্যে (পবিত্র) মদিনায় আসতে বলেন। তিনি এটা কবুল করে (পবিত্র) মদিনায় এসেছিলেন।
আল্লামা শিবলী (রহ.) লিখেছেন, সিরিয়া থেকে (পবিত্র) মদিনা পর্যন্ত যেয়ারতের জন্য হযরত বেলালের যেয়ারতের সফর মজবুত দলিল দ্বারা প্রমাণিত। বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের পর হযরত বেলাল (র.), হযরত ওমর (র.) এর কাছে অনুমতি চাইলেন, আমাকে (এখানে) বায়তুল মুকাদ্দাসে থাকতে দেয়া হউক। মূল কথা, নবী পাক (স.)’র ওফাতের পর (পবিত্র) মদিনায় অবস্থান করা এবং নবী পাক (স.)’র শূন্যস্থান দেখা তাঁর জন্য অসহ্য হয়ে গিয়েছিল। এতে হযরত ওমর (র.) অনুমতি দিলেন। একদিন হযরত বেলাল (র.) স্বপ্নযোগে নবী পাক (স.) এর যেয়ারত লাভ করেন। নবী পাক (স.) তাঁকে বললেন, হে বেলাল! এটা কত বড় জুলুমের কথা, তুমি একবারও আমার নিকট আসছ না। ঘুম থেকে উঠে তিনি (পবিত্র) মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। (পবিত্র) মদিনায় পৌঁছার পর একদিন হযরত ইমাম হাসান (র.) ও হযরত ইমাম হোসাইন (র.) তাঁকে আযান দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। নবী পাক (স.)’র অতি আদরের সম্মানিত নাতিগণের অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না। আযান দিতে আরম্ভ করলেন, আর সাথে সাথে কয়েক বছর পর নবী পাক (স.) জমানার আযানের শব্দ শোনা মাত্র সমগ্র (পবিত্র) মদিনায় এক মর্মস্পর্শী শোকের রোল পড়ে যায়। এমনকি পর্দানশীল মহিলারাও ঘর হতে বের হয়ে পড়েন। এখানে স্বপ্ন দ্বারা যেয়ারতের প্রমাণ নেয়া হয়নি। বরং হযরত বেলাল (র.)’র (পবিত্র) মদিনায় সফরের বর্ণনা পেশ করা হয়েছে।
উপমহাদেশে তথা এ ভারতবর্ষে উর্দু, ফারসি ভাষায় হজ্ব সম্পর্কে যত কিতাব লেখা হয়েছে, প্রত্যেকটিতে নবী পাক (স.)’র রওজা পাকে হাজির হওয়া এবং যেয়ারতের তরতীব ও আদব সমূহ লিপিবদ্ধ করা আছে। হযরত ইসহাক বিন ইব্রাহীম (রহ.) লিখেন : ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে আজ পর্যন্ত ক্রমাগত এ ধারা চলে আসছে, যে ব্যক্তি হজ্ব করবে তিনি পবিত্র মদিনায় হাজির হয়ে রওজা পাক যেয়ারত করে বরকত হাসিল করবে। সাথে সাথে মসজিদে নববীতে নামাজ পড়াসহ অন্যান্য বরকতময় স্থান থেকে উপকার হাসিল করবে।
শেখ ইবনে হুমাম ফতহুল কাদীরে লিখেছেন, পবিত্র মদিনায় গমন শুধুমাত্র নবী পাক (স.)’র রওজা পাক যেয়ারতে হওয়া চাই। এতে রাসূল (স.)’র প্রতি তাজিমও বেশি করা হল এবং “আমার যেয়ারত ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য নাই” এ হাদীস শরীফের ওপরও আমল করা হল।
ভারতবর্ষে উর্দু ও ফারসি ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলোতে পবিত্র মদিনায় গমন করে নবী পাক (স.)’র রওজাপাকে সালাম পেশ করা নিয়ে নিম্নলিখিত কয়েকটি হাদীস শরীফ উল্লেখ করা হল।
* যে আমার কবর যেয়ারত করবে, তাঁর জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হবে।
* আমার ওফাতের পর যে হজ্ব করে আমার রওজা শরীফ যেয়ারত করবে, সে যেন জীবিত অবস্থায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করল তদ্রƒপ গণ্য হবে।
* যে হজ্ব করল অথবা আমার যেয়ারত করল না সে আমার সাথে বেয়াদবি করল।
* যে আমার যেয়ারত করবে সে কিয়ামতের দিন আমার প্রতিবেশী হয়ে থাকবে।
উপমহাদেশে উর্দু ও ফারসি ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থগুলিতে এও উল্লেখ করা আছেÑযারা আশেকে রাসূল তারা হজ্ব করে পবিত্র মদিনায় গমন করে রওজা পাকে সালাম পেশ করাকে ওয়াজিবের চেয়েও বেশি মনে করবে।
যেয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা নিয়ে শেখ আলা উদ্দীন ইরাকী (র.) বলেন, “আমার পিতা শেখ জয়নুউদ্দীন ইরাকী (র.) এবং শেখ আবদুর রহমান (র.), ইবনে হযরত রজব হাম্বলী (র.) ফিলিস্তিনের হেবরনে হযরত ইব্রাহীম খলিল (আ.) যেয়ারতে রওনা হন। যখন হেবরনের নিকটবর্তী হলেন তখন ইবনে রজব হাম্বলী (র.) বলতে লাগলেন, আমি খলিলুল্লার মসজিদে নামাজ পড়ার নিয়ত করে নিলাম। যেন যেয়ারতের নিয়ত না থাকে, তখন শেখ আলা উদ্দীন ইরাকী বলেন, আপনি ত রাসূল (স.)’র বিপরীত করলেন। রাসূল (স.) ফরমাইয়াছেন, তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের জন্য সফর করা যায় না। অথচ আপনি চতুর্থ এক মসজিদের নিয়ত করে ফেললেন। আর আমি রাসূল (স.)’র এরশাদের ওপর আমল করে চললাম। রাসূল (স.) এরশাদ করেন তোমরা কবর যেয়ারত করতে থাকবে। এমন কোন হাদীস নেই যাতে নবীগণের কবরকে বাদ দেয়া হয়েছে সুতরাং আমি রাসূল (স.) ‘র’ এরশাদ মোতাবেক আমল করতেছি।”(জুরকানী)
পবিত্র মক্কা, পবিত্র মদিনা, জেদ্দা হল সৌদি আরবের হেজাজ-অঞ্চল। অপরদিকে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ হল নজদ এর কেন্দ্রস্থল। সৌদি আরবের বাদশা আবদুল আজিজ তাঁর নিকট আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবসহ ৬০ জন যোদ্ধা নিয়ে কুয়েত থেকে এসে রিয়াদ দখল করে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই নির্দেশে পুত্র বাদশা ফয়সাল পবিত্র মক্কা। পবিত্র মদিনাসহ হেজাজ অঞ্চল দখল করে নেয়।
বস্তুতঃ হেজাজসহ সৌদি আরবের বিচ্ছিন্ন অঞ্চল শত শত বছর ইস্তাম্বুলস্থ তুর্কি সুলতানগণের অধীনে ছিল। ব্রিটিশ ফ্রান্স নানা দিক দিয়ে তুর্কি সাম্রাজ্যে ক্ষতি করতে থাকায় ১ম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি সুলতান জার্মানিকে সমর্থন দেয়। এ যুদ্ধে জার্মানির সাথে সাথে তুরস্কেরও পরাজয় ঘটে। এ প্রতিক‚ল অবস্থায় বিশাল তুর্কি সাম্রাজ্যের আরব অঞ্চলগুলোতে ইস্তাম্বুল থেকে নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে। জেদ্দায় হেজাজের তুর্কি গভর্নর শরীফ হোসাইন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। হেজাজে এমনি প্রতিক‚ল অবস্থার সুযোগে বাদশা ফয়সাল তার পিতার নির্দেশে হেজাজ অঞ্চল দখল করে নেন। এরই মধ্যে আল্-কাসিম, আল্-পাশা, তায়েফ, হাইল ইত্যাদি ছোট বড় অঞ্চলও দখল করে নেন।
অতঃপর ১৩৫১ হিজরি মোতাবেক ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর বাদশা আবদুল আজিজ তাঁর অধিকৃত বিশাল অঞ্চলকে একত্রিত করে এর ফরমানের মাধ্যমে তার বংশের নামে, “সৌদি আরব” নামকরণ করেন এবং রাজতন্ত্র প্রবর্তন করেন।
উন্নত বিশ্বে স্থলপথে ইঞ্জিন চালিত যাতায়াত শুরু হলেও মরুভূমি প্রবণ সৌদি আরব অনেক পিছিয়ে ছিল। পিছিয়ে ছিল ইঞ্জিন চালিত গাড়িযোগে সড়ক যোগাযোগও। সৌদি আরবে তেল প্রাপ্তি শুরু হলেও তা ছিল পশ্চিমা বিশ্বের নিয়ন্ত্রণে। ফলে আর্থিকভাবে প্রতিক‚ল অবস্থায় ছিল নব প্রতিষ্ঠিত সৌদি আরব। এরপরও বাদশা আবদুল আজিজ মরুভূমি প্রবণ অঞ্চল হিসেবে সুবিধা নিয়ে বালি সরিয়ে ইঞ্জিন চালিত বাহন চলাচল এর অবস্থান করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে হাজীরা পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনা যেত ইঞ্জিনচালিত গাড়ি যোগে ২ দিন ২ রাতে। কিন্তু সৌদি সরকার হাজীরা পবিত্র মদিনা গমনকে গুরুত্ব দিয়ে রাস্তা উন্নত করতে অগ্রাধিকার দেয়। বর্তমান যাওয়া-আসা ৬ লাইন বিশিষ্ট মহাসড়কটি চালু হয় ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে।
মূলত বাদশা আবদুল আজিজ রিয়াদসহ অন্যান্য অঞ্চল দখল করার সময় ধর্মীয় উগ্রবাদীরা সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিলেন। পরবর্তীতে বিচক্ষণ দূরদর্শী বাদশা আবদুল আজিজ সশস্ত্র বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে দ্রæততার সাথে এগিয়ে যান। এতে এ ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে রাজতন্ত্রের মতবিরোধের সূচনা হয়। যেকোন দেশে সরকার ও ধর্ম বিষয়ে কম বেশি মতপার্থক্য থাকে। সৌদি আরবেও নেই বলা যাবে না।
১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে হজ্বের ক’দিন পর এ ধর্মীয় মতাদর্শের একটি অংশ তথা শ’ দুয়েক এর মত সদস্য ফজরের জামাতের পরপর পবিত্র মসজিদুল হারমের গেইটসমূহ বন্ধ করে দিয়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। প্রায় দু’ সপ্তাহ অবধি পবিত্র কাবায় জামায়াত ও তাওয়াফ বন্ধ হয়ে যায়। সৌদি সরকার এদের সাথে আলোচনা করাকে মোটেও গুরুত্ব না দিয়ে সামরিক বাহিনী ও কমান্ডো দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে। দরজা ভেঙ্গে মসজিদুল হারমের ভেতর ট্যাংক প্রবেশ করা হয়। অনেকে নিহত হন। যারা ধৃত হন তাদেরকে বিচারের মাধ্যমে শিরচ্ছেদ করা হয়।
সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের বাইরে ধর্মীয় উগ্রবাদী মতাদর্শ যে নেই তা বলা যাবে না। এরা নবী পাক (স.)’র যেয়ারতের নিয়তে পবিত্র মদিনায় গমন করাকে নাজায়েজ মনে করেন। কিন্তু সৌদি সরকার বিশ্বের দু’শ কোটি মুসলমানের অনুভূতি অনুধাবন করে কাজ করে যাচ্ছেন।
সৌদি সরকার হজ্ব ও ওমরাকারীগণ যাতে পবিত্র মদিনায় আরামে গমন করতে পারে, আরামে অবস্থান করতে পারে তার জন্য যাবতীয় সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন। বাদশা ফাহাদ বিশাল পরিকল্পনা হাতে নিয়ে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে কাজ আরম্ভ করেন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে সমাপ্ত করেন। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে পবিত্র মদিনাকে নতুনভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন। বাদশা আবদুল্লাহ্ পবিত্র মদিনাকে আরও সাজাতে, স¤প্রসারণ করতে নতুন মহা পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন।
সৌদি সরকারের মতাদর্শ যাই থাকুক না কেন উম্মতে মুহাম্মদীর শতকরা ৯৯ জনের অধিক যে শুধুমাত্র রওজাপাকে সালাম দিতে যেয়ারতের নিয়তে পবিত্র মদিনায় গমন করছেন তা বুঝে সম্মান দেখিয়ে পবিত্র মদিনায় অকাতরে টাকা খরচ করছেন। পবিত্র মদিনা বিমান বন্দরকে মাত্র ক’বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উন্নতি করেছেন। সাথে নির্মাণ করেছেন হজ্ব টার্মিনাল। হজ্ব, ওমরার পাশাপাশি যেয়ারতকারীগণ মদিনা মুনাওয়ারা বিমান বন্দরে অবতরণ করলে যাতে ন্যূনতম অসুবিধা না হয় সে জন্য ব্যাপক স¤প্রসারণের কাজ চলছে।
উম্মতে মুহাম্মদীর শতকরা ৯৯ জনের অধিক শুধুমাত্র যেয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদিনায় গমন করেন। সেই সুযোগে মসজিদে নববীতে এবং রেয়াজুল জান্নাহ তথা বেহেশতের বাগিচায় নামাজ পড়ে বরকত হাসিল করেন।
সৌদি আরবে তথা জজিরাতুল আরবে শত বছর আগেও শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসার লাভ করেনি আর্থিকসহ নানান প্রতিক‚লতার কারণে। সৌদিতে উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থা তথা প্রথম পবিত্র মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে। ঐ অঞ্চলের ছেলেদের মধ্যে যারা উচ্চতর শিক্ষা লাভ করতে আগ্রহী তারা হয়ত মিশরের কায়রো অথবা সুদানের খার্তুন অথবা সিরিয়ার দামেস্ক বা আলেপ্পু, ইরাকের বাগদাদ বা বসরা অথবা ভারতবর্ষে আসতেন শিক্ষা লাভ করার জন্য। অতএব বিশ্বের লক্ষ কোটি জ্ঞানীগুণীগণের মতাদর্শ উপেক্ষা করে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদিনায় গমন করাকে নাজায়েজ বলা ধৃষ্টতার শামিল।
প্রতি বছর হজ্ব ও ওমরাকারী সহ সৌদি আরবে অবস্থানকারী প্রবাসী মিলে কোটির কাছাকাছি নবীপ্রেমিক পবিত্র মদিনায় গমন করে থাকে যেয়ারতের নিয়তে। সৌদি পুলিশ ও খাদেমগণের দিক নির্দেশনা মেনে চলে সকলেই। মেনে চলে শরীয়তের অনুক‚লে দিক নির্দেশনাও। যেয়ারতকারীগণ রওজাপাকের দক্ষিণ পার্শ্বে সালাম পেশ করে বেরিয়ে যান। এখানে শিরক বেদায়াতের কি আছে বোধগম্য নয়। উম্মতে মুহাম্মদী পবিত্র মদিনায় গমন করা, পবিত্র মদিনার তাজিল রক্ষা করায় সচেষ্ট থাকা, রওজাপাকের দক্ষিণ পার্শ্বে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়া, সেখানকার ধর্মীয় উগ্রাবাদীদের গাত্রদাহ কেন ভাববার বিষয়।
আগেও উল্লেখ করেছি এ ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বিশ্বাস হচ্ছে নবীপাক (স.)’র যেয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদিনায় গমন করা শরীয়ত বিরোধী, শিরক বেদায়াতের শামিল। মাত্র ৫০-৬০ বছর তার কম বেশি সময়ের মধ্যে সৌদি আরবে উচ্চতর শিক্ষা লাভ দূরূহ ছিল। নতুন শিক্ষিত উগ্রবাদীরা বেপরোয়া আচরণ করে সৌদি সরকারকে এ রকম মাঝে মাঝে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে।
বিশ্বের শতকরা ৯৯ জনের অধিক আশেকে রাসূলের অন্তরে আঘাত দিচ্ছে। বিশ্বের লক্ষ কোটি ধর্মীয় জ্ঞানী গুণীজনের সিদ্ধান্তকে তোয়াক্কা করছে না। সৌদি সরকার সাবধান না হলে এ উগ্রবাদী ধর্মীয়গোষ্ঠী সৌদি সরকারের জন্য যে কোন সময় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
ভারতবর্ষে প্রায় ৫০ কোটি তথা ৫০০ মিলিয়ন মুসলমানের অবস্থান। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশের মত মুসলমান এখানে বসবাস করে। হাজারের অধিক বছর ধরে এখানে জ্ঞান অর্জনের অসংখ্য জংশন রয়েছে। এ ভারতবর্ষে ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে রয়েছে মতভেদ। কিন্তু শুধুমাত্র নবী পাক (স.)’র রওজাপাক যেয়ারত করতে পবিত্র মদিনায় গমন করার ব্যাপারে সকলেই একমত। দ্বিমত থাকলেও তা শতকরা একজনেরও কম।
মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে বারে বারে পবিত্র মদিনায় গমন করে রওজাপাকে সালাম পেশ করার তওফিক দান করুন। (আমিন।)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন