নরম ও প্রাণস্পর্শী বাক্য : দার্শনিক দলিল প্রমাণ হোক, অথবা ওয়াজ নসিহত হোক, অথবা বিতর্ক ও মোনাজারা হোক, এর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে এই যে, আহ্বানকারী নম্রতা ও সদাচারের মাধ্যমে যেন কথা বলে। রুঢ়তা ও কঠোরতা সুলভ পন্থা অবলম্বন করলে অন্যের অন্তরে ঘৃণা এবং শত্রুতার অনুপ্রেরণা পয়দা করে, চাই তা যতই ভালো এবং যতই সত্য হোক না কেন। কিন্তু এই শ্রেণীর অনুপ্রেরণা তা গ্রহণ করার যোগ্যতা তার নিকট হতে দূরীভ‚ত করে দেয় এবং শ্রবণকারী মাঝে স্বীয় ভুলের জন্য জিদ এবং অনড়ভাব পয়দা করে নেয়া। যার ফলে আহ্বানের উপকারিতা এবং নসিহতের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে নিষ্প্রভ হয়ে যায়। এ জন্য কুরআনুল কারীম স্বীয় পয়গাম্বরদেরকে বিরুদ্ধবাদী দুশমনদের সাথে বিনম্র ও প্রাণস্পর্শী ভাষায় কথাবার্তা বলার তাকিদ করেছেন। হযরত মূসা আ. ও হযরত হারুন আ.কে ফেরাউনের মতো দুষ্টমতির সামনে পয়গামে ইলাহি নিয়ে যাওয়ার হেদায়েত দেয়া হয় এবং সাথে সাথে এই ইরশাদও করা হয়, ‘তোমরা উভয়ে ফেরাউনের কাছে যাও, সে অবিশ্বাস ও বিরুদ্ধাবাদিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে, তার সাথে নরম ও সহিষ্ণুতার সাথে কথাবার্তা বলবে, হয়তো সে নসিহত কবুল করবে অথবা আল্লাহকে ভয় করবে।’ (সূরা ত্বাহা : রুকু ২) দাওয়াত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে নম্রতা ও সহৃদয়তা এবং প্রেম ও ধৈর্যের এর চেয়ে উত্তম উদাহরণ আর কী হতে পারে? এমনকি কোনো আহ্বানকারী ও নসিহতকারী পয়গাম্বরদের থেকে উত্তমও হতে পারে। তা ছাড়া ফেরাউনের চেয়ে অধিক বড় অপরাধীও কেউ হতে পারে না। তারপরও এমন কট্টর অপরাধীর সামনে এহেন নম্রতা ও স্নেহ-মমতাসুলভ ওয়াজ এবং নসিহতের হুকুম ও তালিম যখন পয়গাম্বরদের দেয়া হয়েছে, তখন সাধারণ আহ্বানকারী, মুবাল্লিগ এবং ওয়াজকারীদের সাধারণ বিরুদ্ধবাদীদের, অপরাধীদের এবং দুই দুরাচারদের সাথে উত্তম ব্যবহার ও আচরণ করা এবং নম্রতা প্রদর্শন অবশ্যই কর্তব্য। সুতরাং তাদের উচিত এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।
ক্ষমাসুন্দর ও দৃষ্টি মার্জিত কথা : যে সকল মুনাফিক নাফরমানীর কারণে অপরাধী বলে সাব্যস্ত হয়েছিল, মহান আল্লাহপাক তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা.কে নির্দেশ করেছেন, ‘তাদের প্রতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাকান, তাদেরকে নসিহত করুন এবং তাদের সাথে এমন কথা বলুন, যা তাদের প্রাণস্পর্শী হয়।’ (সূরা নিসা : রুকু ৯) এই তালিমে তিনটি হেদায়াত আছে। প্রথমত, দাওয়াত ও তাবলীগের ব্যাপারে বিরুদ্ধবাদীদের দুর্ব্যবহার বরদাস্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদেরকে নসিহত করতে হবে, বুঝাতে হবে। তৃতীয়ত, কথা বলার বাচনভঙ্গীকে প্রাণস্পর্শী করে তুলতে হবে। যেন সহজেই তা তাদের অন্তরের মণিকোঠায় স্থান করে নিতে পারে।
নমনীয়তা ও শুভ সংবাদ : আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়াতের বিকাশ ও পরিপূর্ণতার লক্ষ্যে নমনীয়তা ও শুভ সংবাদ প্রদান একটি উত্তম পন্থা। রাসূলুল্লাহ সা. হযরত মোয়াজ বিন জাবাল রা. এবং হযরত আবু মূসা আশয়ারী রা.কে ইয়েমেনে ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের জন্য মনোনীত করেন এবং তাদেরকে বিদায় দেয়ার সময় এই নসিহত করেন, ‘তোমরা সহজ সরল ও নমনীয় ব্যবহার করাবে, কখনো কঠোরতা অবলম্বন করবে না এবং তোমরা সেখানকার অধিবাসীদের শুভ সংবাদ দেবে। কোনোক্রমেই তাদের সাথে বিরক্তিকর কোনো পদচারণা করবে না। দ্বীনে ইলাহিকে সহজ ও নমনীয়তার সাথে মানুষের মাঝে শুভ সংবাদের বাণী পৌঁছাতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. সাহাবীদের সামনে এবং সাহাবীগণ সাধারণ মুসলমানদের সামনে এই নিয়ম-নীতি মোতাবেক দ্বীনে ইলাহিকে পেশ করেছেন এবং সফলতা অর্জন করেছেন। ধর্মের সহজ ও সরলতাকে প্রকাশ করা এবং তাকে কঠিন ও মুশকিল হিসেবে উপস্থাপন না করার মাঝেই রয়েছে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্যতার মর্মকথা। একই সাথে আল্লাহপাকের দয়া, অনুকম্পা, ক্ষমা ও করুণা এবং স্নেহ ও মায়ার প্রাণবন্ত অনুরাগ সম্পর্কে মানুষের মনে সুদৃঢ় আশার সঞ্চার করা এবং মানুষকে প্রসন্ন চিত্তের অধিকারী করা ও ভীতির উল্লেখ করলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বীতশ্রদ্ধ ও নিরাশ হয়ে পড়ে। তাই তাবলীগ ও দাওয়াতের কাজে আল্লাহর দেয়া বিধানসমূহ অনুসরণ করা একান্ত অপরিহার্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন