শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম

হতাশামুক্ত মৃত্যুহীন জীবন

উবায়দুর রহমান খান নদভী | প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

মহাবিশ্বের তুলনায় মানুষ এক নগণ্য প্রাণী। নগণ্য বললেও অনেক বেশি বলা হয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান অনুযায়ী, যেখানে পৃথিবীটাই খুঁজে পাওয়া যায় না, সেখানে মানুষ কোন ছাড়।
বিবেচক ও বুদ্ধিমান এ প্রাণীটি কত যে দুর্বল ও ক্ষুদ্র তা পবিত্র কোরআন তুলে ধরেছে। বলা হয়েছে, ‘মানুষের জীবনে কি এমন একটি সময় ছিল না? যখন সে উল্লেখ করার মতো কোনো বস্তু হিসেবে পরিগণিত হতো না’ (আল কোরআন ৭৬ : আয়াত ২)। অনত্র আল্লাহ বলেন, ‘আর মানুষ সৃষ্টিগত ভাবেই দুর্বল’ (আল কোরআন ৪ : আয়াত ২৮)। মানুষের মৃত্যুর চেয়ে তার বেঁচে থাকাটাই বরং বেশি বিস্ময়কর। মানুষের হায়াত যেমন সীমিত, তার কর্মশক্তি যেমন সীমিত ঠিক তেমনি সীমিত তার শ্রবণ, দৃষ্টি ও অনুভ‚তিশক্তি। বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, মানুষ তার চর্মচোখে যা কিছু দেখে তা তার চারপাশের প্রকৃতি ও জগতের তিন ভাগ। ৯৭ ভাগই সে খালি চোখে দেখে না। নানা যন্ত্র ও আলোকসম্পাতে আরো এক-আধ ভাগ সে দেখতে পারে বটে, তবে ৯৫ ভাগ সৃষ্টি দুর্বল মানুষেরা কোনোদিনই দেখে না।
মানুষের বোধ ও কল্পনা শক্তিও উপরোল্লিখিত শক্তিগুলোর চেয়ে কিছু বেশি হলেও মহাসৃষ্টির বিশালত্বের তুলনায় খুবই নগণ্য। যে জন্য আল্লাহর রাসূল সা. সৃষ্টিজগতের সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান হওয়া সত্তে¡ও বলেছেন, ‘অতি সামান্য জ্ঞানই আমাকে দেয়া হয়েছে’। অর্থাৎ সর্বজ্ঞ ও পরম জ্ঞানী মহান আল্লাহর সামনে সৃষ্টিজগতের সকলের সব জ্ঞান মহাসিন্ধুর তুলনায় সূচাগ্র বারি বিন্দুও নয়।
পবিত্র কুরআনে এক প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে হত্যা, খুনের বদলা খুন, আঘাতের সমপরিমাণ প্রত্যাঘাত ও সন্ত্রাসের সম প্রতি বিধান (কিসাস), এর ভেতর রয়েছে তোমাদের জন্য বাঁচার বার্তা।’ অর্থাৎ কিছু মৃত্যু এমন আছে যার মাঝে লুক্কায়িত আছে বহুপ্রাণ। চিন্তাশীলরা এ আয়াত থেকে শিক্ষাগ্রহণ কর।
অন্য জায়গায় বলেন, জুলুমের প্রতিকার সশস্র লড়াই। এতে ঈমানদাররা যেমন জীবন দেবে, জালিমদের জীবন নেবে। এ কাজটি মানবতার স্বার্থেই আল্লাহর বিধানের অন্তর্ভুক্ত। যার কোরআনী পরিভাষা হচ্ছে ‘কিতাল ও জিহাদ’। অবশ্য জিহাদের অর্থ আরো ব্যাপক। আল্লাহ তায়ালা এই কষ্টকর জিহাদের বা সশস্ত্র যুদ্ধের হুকুম দেয়ার পর বলেন, ‘এমন হতে পারে যে, একটি জিনিস তোমরা অপছন্দ করো অথচ সেটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর, আর এমনো হতে পারে যে, তোমরা একটি জিনিস পছন্দ করো, অথচ এটি তোমাদের জন্য মন্দ। (আর এর কারণ এই যে) আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না’ (আল কোরআন ২ : আয়াত ২১৬)।
এ আয়াতের সাধারণ ব্যবহার মুফাসসিরগণ করেছেন, জিহাদের ক্ষেত্রে তো এটি আছেই দার্শনিক অর্থে জীবনের প্রতিটি পছন্দ-অপছন্দের ক্ষেত্রেও দুর্বল ও স্বল্পজ্ঞানী মানুষ জানে না কিসে তার মঙ্গল। ভাগ্য তাকে সামান্য কষ্ট দিয়ে বড় যে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে এ কথাটি ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত, (ওয়াল ক্বাদরি খাইরিহি ওয়া শাররিহি মিনাল্লাহি তায়ালা) মানে ঈমানদারের একথা বিশ্বাস করতেই হবে যে, ভাগ্যের কাছ থেকে পাওয়া ভালো ও মন্দ দু’টোই আল্লাহ তায়ালার দেয়া।
পাশাপাশি এ বিশ্বাসও ঈামাদারের জন্য অপরিহার্য যে, আল্লাহ তার ঈমানদার বান্দার কোনা অমঙ্গল কখনোই করেন না। বান্দার দৃষ্টিতে যেটি অমঙ্গল আল্লাহর ফায়সালায় সেটিই মহা কল্যাণের দ্বারোদ্ঘাটন। আল্লাহর তরফ থেকে দেয়া ছোট্ট একটি ‘না পাওয়া’ বিশ্বাসী বান্দার জন্য জীবনের সেরা প্রাপ্তির মহা উদ্বোধন। এ জন্য নিজের মনের বিরুদ্ধে, স্বপ্ন ও কল্পনার বিরুদ্ধে, আশা ও অঙ্কের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া কোনো ‘কেয়ামত’কেও নিরেট মন্দ বলে ধারণা করা মুমিনের কাজ নয়। বিশ্বাসের আলোকে ভাবতে গেলে, এতেই নিহিত রয়েছে অনেক বড় কোনো বৈপ্লবিক বিজয়ের অঙ্কুর।
আল্লাহর প্রতি আস্থাবান ও নিজেকে অক্ষম ও দুর্বল বান্দা হিসেবে যারা ভাবতে পারেন তারা ধ্বংসের মাঝখানে বিধ্বস্ত অস্তিত্ব নিয়েও সাফল্য ও শক্তিমান উত্থানের স্বপ্ন দেখেন। কারণ, তারা মহানবী সা. এ হাদিসের আলোকে চলেন, যেখানে নবী করিম সা. বলেছেন, ‘হতাশা এক ধরনের কুফরি’।
তারা ঈমানের জোরে হতাশা নামক কুফরিকে দূরে সরিয়ে রাখেন। তারা আঘাতে বিচ‚র্ণ হন, ঘাতকের হাতে নিহত হন, সামগ্রিক লড়াইয়ে ধ্বংস হয়ে যান কিন্তু পরাজিত ও হতাশ হন না। তার বিশ্বাস ভাঙে না। তার সাহসে আঁচ লাগে না। তার লক্ষ্যে বাঁক আসে না। ঈমান ও তাওয়াক্কুল তাকে সটান, সুদৃঢ়, অমর, অক্ষর, অজেয় করে রাখে। ঈমানী হিরোরা ধ্বংস হন কিন্তু পরাজিত হন না। আল্লাহর পথে নিবেদিতরা মরে গেলেও মৃত্যুবরণ করেন না।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ যে কথাটি এভাবে বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর পথে জীবন দেয়, তাদের তোমরা অবশ্যই মৃত গণ্য করবে না। তারা জীবিত এবং নিজের রবের নিকট থেকে রিজিক পেতে থাকে’ (আল কোরআন ৩ : আয়াত ১৬৯)। অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাহে জীবন দেয়, তোমরা তাদের মৃত বলো না, তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা বোঝ না’ (আল কোরআন ২: আয়াত ১৫৪)। সুতরাং একথা বিশ্বাস করতেই হবে যে, বান্দা জানে না কিসে তার মঙ্গল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
Md Raja ৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫১ এএম says : 0
ইমাম সুফিয়ান আস-সাওরিকে একবার আল্লাহর কুরআনের বাণী, “মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে” সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, “দুর্বল বলতে কী বুঝানো হয়েছে?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “কোন পুরুষের পাশ দিয়ে একজন নারী গেলে সে নারীটির দিকে তাকানো থেকে নিজেকে সামলাতে পারে না এবং এতে (নারীটির দিকে তাকানোর মাঝে) তার কোনই উপকার নেই। এর চেয়ে বেশি দুর্বল আর কোন কিছু আছে কি?” [হিলইয়াহ আল-আউলিয়া, ৭/৬৮]
Total Reply(0)
Md Raja ৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫৩ এএম says : 0
শুকরিয়া। লেখককে আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিন। আমরা নিয়মিত এ ধরনের লেখা চায়।
Total Reply(0)
Zulfiqar Ahmed ৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫৪ এএম says : 0
* তিনিই তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর একটা কাল নির্দিষ্ট করেছেন। আর একটা নির্ধারিত সময়সীমা আছে, যা তিনিই জানেন। তবু তোমরা সন্দেহ করো। (সুরা আনআম : ২)।
Total Reply(0)
রুবেল ৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫৪ এএম says : 0
আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষ স্বভাবগতভাবে অস্থির এবং তাড়াহুড়া খুব পছন্দ করে। এ বিষয়টিও পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বিবৃত করেছেন- * মানুষ যেভাবে ভালো চায় সেভাবে মন্দও চায়। মানুষ তো খুব দ্রুততা ও তাড়াহুড়াপ্রিয়। (সুরা বনি ইসরাইল : ১১)
Total Reply(0)
তানভীর আহমাদ ৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫৫ এএম says : 0
মাঝে মাঝে যখন মহান আল্লাহর সৃষ্টিজগত নিয়ে ভাবি তখন নিজেকে একেবারেই নগন্য মনে হয়।
Total Reply(0)
করিম শেখ ৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫৬ এএম says : 0
ইনকিলাবকে ধন্যবাদ নিয়মিত ধরর্মীয় লেখা প্রকাশ করায় আল্লাহ আপনাদের কবুল করুন।আমীণ
Total Reply(0)
সরল পথ ৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৫৭ এএম says : 0
মানুষ সামান্য ছোট্ট একটা জায়গার ক্ষমতা পেলে যে অহংকার গর্ব করে অথচ মহান আল্লাহর অসীম সৃষ্টির দিকে তাকালে তাকে খুজেই পাওয়া যায় না।
Total Reply(0)
Hasan ৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ৯:০১ এএম says : 0
গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এই লেখাটির জন্য আল্লামা মুফতি উবায়দুর রহমান খান নদভী হুজুর ও সংশ্লিষ্ট সকলকে আল্লাহ তায়ালা উত্তম বিনিময় দান করুন...আ-মিন---।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন