টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যানদের খেলা। যাার উৎপত্তিই দর্শকদের বিনোদনকে প্রাধান্য দিয়ে। সেই বিনোদনে বোলারদের কারিকুরি থাকবে না তা নয়, কিন্তু বড় অংশের মানুষেরই প্রত্যাশা কুড়ি ওভারের খেলায় হবে চার-ছক্কার ঝড়। হাইস্কোরিং টক্করে উত্তেজনা ছড়াবে টানটান। তবেই না পয়সা উশুল। বিপিএলে নেই সেই ধামাকা। গ্যালারিতেও তাই উঠছে না দর্শকদের উথাল পাতাল ঢেউ।
২০১৩ সালে ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলশ ক্রিকেট বোর্ড এই ফরম্যাটকে ক্রিকেটে পরিচিত করলেও দু’বছর পর মেলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। প্রতিযোগীতামূলক ক্রিকেটকে আরো আকর্ষনীয় করতেই এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ২০০৫ সালে ছোট্ট এই ফরম্যাটকে বিশ্ব দরবারে হাজির করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল। মূলত ক্রিকেটকে বিনোদনে রূপ দিতেই আইসিসি’র এই প্রয়াস। সেই একই লক্ষ্য মাথায় নিয়ে বাংলাদেশে এই ফরম্যাটের পথচলা শুরু হয় সাবেক আইসিসি প্রেসিডেন্ট আ হ ম মুস্তফা কামালের হাত ধরে। চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছুটিয়ে দর্শক বিনোদনের জন্যই টি-২০ ক্রিকেটের উদ্ভাবন। কিন্তু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) এবারের আসরে
কোথায় সেই উত্তেজনা, কোথায় সেই বিনোদন?
গায়ে টি-টোয়েন্টির ধুমধাড়াক্কা লেবাস থাকলেও এবারের বিপিএল শুরু হয়েছে লো স্কোরিং ম্যাচ দিয়ে। এ পর্যন্ত মাঠে গড়ানো ১৭টি ম্যাচের মধ্যে (গতরাতের রংপুর-সিলেট ম্যাচ বাদে) সর্বনিম্ন ৬৩ রানে অলআউটের ঘটনাও ঘটেছে আবার সর্বোচ্চ ৬ উইকেটে ১৯২ রানের দলীয় সংগ্রহও সাক্ষী হয়েছে এবারের বিপিএল। ম্যাচে দুইশর কাছাকাছি রান হয়েছে মাত্র দুই ইনিংসে। দুটিই ঢাকা ডায়নামাইটসের। শতরানের নিচে ইনিংস হয়ছে তিনটি। তবে এই ১৭ ম্যাচের গড় সত্যিই শঙ্কার-১২১.৬! টি-২০ ক্রিকেটের সঙ্গে যা অসম্ভব রকমের বেমানান। আর এর রেশ পড়েছে গ্যালারিতে। আগে যেখানে টিকিটের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তো ক্রিকেটপ্রেমী বাংলাদেশিরা সেখানে আজ প্রতিটি ম্যাচেই হচ্ছে দর্শকশূণ্য অবস্থায়! এমনকি, বিনামূল্যে টিকিট দিয়েও দর্শক টানা যাচ্ছে না মিরপুরে!
সিলেটে যাবার আগে অনেকেই ভেবেছিল এবার বুঝি সেই অবস্থার উন্নতি হবে। কিন্তু কোথায় কি? সেই একই লো স্কোরিং ম্যাচ দিয়েই শুরু হয়েছে বিপিএলের সিলেট যাত্রা। প্রথম দিনে হওয়া দুটি ম্যচের প্রথমটিতে খুলনা আগে ব্যাট করে ৯ উইকেটে তোলে ১২৮, জবাবে মাত্র ১০৩ রানেই গুটিয়ে যায় রাজশাহী। সন্ধ্যার ম্যাচের অবস্থা ছিল আরো সোচনীয়। আগে ব্যাট করে কুমিল্লার বোলিং তোপে স্বাগতিক সিলেট গুটিয়ে যায় ৬৮ রানে! এমনকি আসরের সবচেয়ে তারকাসমৃদ্ধ একমাত্র অপরজিত দল ঢাকাও গতকাল রাজশাহীর দেয়া ১৩৬ রানের জবাবে ২০ ওভারে করতে পেরেছে মাত্র ১১৬ রান!
বিশ্বজুড়ে ঘরোয়া, আন্তর্জাতিক কিংবা আনঅফিশিয়াল টি-২০’র সংখ্যা ১৫ হাজার ৫৩৫টি (সিলেট-রংপুর ম্যাচসহ)! যার মধ্যে আসিইসি স্বীকৃত ৭১৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচেই সেঞ্চুরি হয়েছে ৩১টি। সেখানে দ্রুততম মাত্র ৩৫ বলের শতকও আছে দুটি! ২০ ওভারের ম্যাচে দুইশ’ রানের ম্যাচের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। যার মধ্যে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সর্বোচ্চ দলীয় ২৬৩ রানের ইনিংস খেলেছে অস্ট্রেলিয়া! আবার নিউজিল্যান্ডের দেয়া ২৪৫ রানের লক্ষ্যও ৭ বল হাতে রেখে এই অস্ট্রেলিয়ারই পেরিয়ে যাবার ইতিহাসও কথা বলবে ধুন্ধুমার টি-২০র পক্ষে। অথচ এবারের বিপিএলে ওয়ানডের আমেজও নাই, যেন পুরোপুরি টেস্ট ম্যাচের আদলেই হচ্ছে টি-২০।
বিপিএলের পথচলায় পুরনো সঙ্গী ব্যাটিং দানব ক্রিস গেইল। বোলারদের যম হিসেবে ক্যারিবীয়ান মারমুখী ক্রিকেটারের জুড়ি মেলা ভার। ব্যাট হাতে একাই ম্যাচ জেতানোর ইতিহাস আছে ভুরি ভুরি। টি-২০ বিনোদনের রসদ হিসেবে আরো আছেন আন্দ্রে রাসেল, কায়রন পোলার্ড, আন্দ্রে ফ্লেচার। নিয়মিত মুখ পাকিস্তানী বুমবুম তারকা শহীদ আফ্রিদী। এবার সেই তালিকায় নতুন করে যোগ হয়েছে আরো বিদ্ধংসী কিছু ব্যাটসম্যানের নাম। অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ার্নার-স্টিভেন স্মিথ, দক্ষিণ আফ্রিকান ৩৬০ ডিগ্রী খ্যাত তারকা এবি ডি ভিলিয়ার্স, ইংলিশ ওপেনার ইয়ান বেল। এখন পর্যন্ত নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেন নি তাদের একজনও। বিদেশী তারকাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, দেশি তারকাদের মধ্যে মারমুখী ব্যাটসম্যান হিসেবে খ্যাতি আছে তামিম ইকবালের। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের ড্যাশিং এই ওপেনার এখন পর্যন্ত ৫ ম্যাচ খেলে দুটিতে মেরেছেন ‘ডাক’, বাকি তিন ম্যাচে খেলেছেন ৪, ২১ আর ৩৫ রানের ইনিংস! পত্র-পত্রিকায় যেখানে ম্যাচ উইনার হিসেবে ব্যাটসম্যানদের ছবি ছাপা হবার কথা সেখানে প্রতিদিনই ঠাঁই করে নিচ্ছেন কোন না কোন বোলারের প্রতিচ্ছ্ববি। এমনকি টি-২০তে বোলাররা হ্যাটট্রিকসহ তুলে নিচ্ছে ওভারে মেডেন উইকেটও! তাহলে দায়টা কার?
মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের উইকেটের অবস্থা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। চার-ছক্কার বৃষ্টি হয় না, টি-টোয়েন্টির ধামাকা মেলে না, ব্যাটসম্যানরা ধুঁকে মরেন, ম্যাচ হয় ম্যাড়ম্যাড়ে। রহস্যের জাল বিছিয়ে রাখা মিরপুরের বাইশ গজের তাই অনেক বদনাম। বিশেষ করে বিপিএল এলেই শুরু হয় উইকেট নিয়ে হাহাকার। প্রায় প্রতিদলই জানিয়ে যায় রান করা, শট খেলা কতটা কষ্ট এখানে। ইতিহাসই বলে শীতের এই সময়ে লো স্কোরিং ম্যাচ হবেই। যেহেতু পিচটা কালো মাটিতে করা, ভালো উইকেট বানানো কঠিন। শীতকাল, প্রতিদিন খেলা হচ্ছে ফলে কিউরেটরদের জন্য ভালো উইকেট বানানো কঠিন। আবার রাতের বেলা পানি দিয়ে উইকেটটা তৈরি করতে হয়, একটু কঠিনই। ভালো উইকেটের আশা তারাও করেন না।
তবে বিসিবি কিংবা কিউরেটরের এমন দায়সারা মন্তব্যে খুশি হতে পারছে না ক্রীড়ামোদীরা। তাদের অভিযোগ, ধুন্ধুমার ক্রিকেটের যুগে টি-২০ মানেই ব্যাটসম্যানের খেলা। ব্যাটিং সহায়ক উইকেটই যার উৎকৃষ্ট উপকরণ। বিশ্বে চলমান প্রতিটি ফ্রাঞ্চইজিভিত্তিক ক্রিকেট রাজত্ব করে ব্যাটসম্যানরাই। বর্তমানে তাই অনেক বোলারকে আক্ষেপের সঙ্গে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আমাদের দিন শেষ’। ঠিক সেই সময় মারদাঙ্গা ক্রিকেটে বদলে ম্যাড়ম্যাড়ে টি-২০তে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ ক্রীড়াপ্রেমীরা। তাদের মতে শীতকাল, কুয়াশা কিংবা উইকেট তৈরির মাটি কেবল বাহান, সব কিছু জানা সত্বেও ব্যাটিং উপযোগী উইকেট তৈরি না করে দর্শকদের সঙ্গে ‘প্রতারণা’ করেছে বিসিবি।
অল্প সময়ে রোমাঞ্চকর, উত্তেজনা ছড়ানো ব্যাটিং বিনোদন নিতেই টি-২০ ম্যাচে দর্শক সমাগম হয় সবচেয়ে বেশি। সেই বিনোদন দিতেই কারি কাড়ি টাকা খরচ করে বিদেশী মারমুখী ব্যাটসম্যানদের দলে ভেড়ায় ফ্রাঞ্চাইজিগুলো। অথচ বিসিবির এমন কান্ডজ্ঞানহীনতায় হতাশার পাশাপাশি ক্ষোভও ঝরেছে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের কণ্ঠেও।
এ ব্যপারে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান সরাসরি বলেন, ‘আমার মনে হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড যথাযথভাবে উইকেটগুলো তৈরী করতে পারেনি। টি-২০ ফরম্যাটের কথা এবং বাংলাদেশের বর্তমান শীতকালীন আবহাওয়ার কথা চিন্তা করে অনেক আগে থেকেই এ ব্যপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল, যেটা বিসিবি করেনি। উইকেটের কারণেই ব্যাটসম্যানরা এবার রান পাচ্ছে না।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন