সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক

| প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের একটি বড় অংশই ন্যায্য মজুরী, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ ও অনিরাপত্তাসহ নানা ধরনের বঞ্চনা ও প্রতারনার শিকার হচ্ছে। এটি কোনো নতুন তথ্য না হলেও নানাবিধ বঞ্চনা, নির্যাতন ও প্রতারনায় হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক প্রতিমাসে শুণ্য হাতে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে অতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রম করেও প্রত্যাশিত বেতন-ভাতা না পেয়ে মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে হাজার হাজার শ্রমিক বিদেশে মৃত্যুবরণ করে লাশ হয়ে দেশে ফিরছে। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স বিদেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের অস্বাভাবিক মৃত্যুহার নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যান মন্ত্রনালয়ের বরাতে গত বছর বিদেশ থেকে প্রায় ৩ হাজার ৮শ শ্রমিকের লাশ ফেরত আসার তথ্য জানিয়েছে। এটি শুধু বৈধপথে বিদেশ যাওয়া এবং বিমান বন্দর দিয়ে লাশ ফেরত আসার তথ্য। এর সঙ্গে অবৈধ পথে যাওয়া শ্রমিকদের সংখ্যা যোগ করলে বিদেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের মৃত্যুর হার আরো অনেক বেশী হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বিশ-ত্রিশ বছরের তরুণ-তরুনীরা অনেক প্রত্যাশা ও উদ্দীপনা নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর আশাভঙ্গ, প্রতারনা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন দেশ থেকে লাশ হয়ে ফেরত আসা ব্যক্তিদের বেশীরভাগই হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে বলে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়।
জাতীয় অর্থনীতির বুনিয়াদ অনেকাংশেই বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উপর নির্ভরশীল। লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের ঘামঝরানো শ্রমের বিনিময়ে পাঠানো বৈদেশিক মূদ্রায় দেশের অর্থনীতি ও সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের গতি সচল থাকলেও এসব শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারী কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বশীলদের ভ‚মিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ গমনে সরকারী নিয়ন্ত্রণ এবং নীতিমালা বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা না থাকায় আদম বেপারী ও দালালদের মাধ্যমে অবৈধ পন্থায়, কয়েকগুণ বেশী টাকা খরচ করে বিদেশ যাওয়ার কারণেই বেশীরভাগ শ্রমিক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। জমি-জিরাত বিক্রি করে, এনজিও থেকে চড়াসুদে ঋণ নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর প্রত্যাশিত মজুরী না পাওয়া, দু-চার বছরেও ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারা এবং নিয়োগকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে অমানবিক আচরণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়াকেই প্রবাসে স্ট্রোক ও হৃদরোগে মৃত্যুবরণের জন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন রিপোর্টের কেস স্টাডি থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। বিদেশ থেকে লাশ হয়ে ফেরত আসা শ্রমিকদের অধিকাংশই আসছে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় বাজার সউদী আরব ও মালয়েশিয়া থেকে। এছাড়া নানা ধরনের নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হয়ে মানবেতরভাবে দেশে ফেরত আসা শ্রমিকদের অধিকাংশই আসছে এসব দেশ থেকে। সউদী আরব থেকে প্রতিমাসে শত শত বাংলাদেশী নারী শ্রমিক নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হয়ে দেশে ফিরছে। এদের অনেকে অসুস্থ ও লাস হয়ে দেশে ফিরছে।
গত ৫ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের হার কমলেও বিমান বন্দর দিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের লাশ ফেরত আসার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। প্রবাসে বাংলাদেশী শ্রমিকদের সঠিক কর্মসংস্থান, উপযুক্ত কর্মপরিবেশ ও মজুরীসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যান মন্ত্রনালয় গঠিত হলেও এই মন্ত্রণালয় এসব বিষয়ে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশ গমনের ব্যয় কমিয়ে আনা, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, ন্যায্য বেতন-ভাতা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে প্রবাসী শ্রমিকদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর এই হার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। সহায়-সম্বল বিক্রি করে অথবা উচ্চসুদের ঋণ নিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে স্বজনদের বিদেশ পাঠানোর পর রিক্ত হাতে অথবা লাস হয়ে ফেরত আসার পর সেই সব পরিবারের কী অবস্থা দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমেয়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক থেকে মৃতের দাফন ও অনুদান হিসেবে যে টাকা প্রদান করা হয় তা খুবই অপ্রতুল এবং দায়সারা। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং সহজেই অনুদান প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশেষত যে সব পরিবারের সদস্যরা প্রবাস থেকে লাশ হয়ে দেশে ফিরছে, সে সব অসহায় পরিবারগুলোর দায়-দেনা এবং টিকে থাকতে প্রবাসী কল্যান ব্যাংক এবং মন্ত্রণালয়কে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে বিদেশে গিয়ে মজুরি বঞ্চনাসহ নানাবিধ সংকটে পড়া শ্রমিকদের চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। গত সপ্তায় কুয়েতে নিয়োগপ্রাপ্ত শত শত শ্রমিক বকেয়া বেতনের দাবীতে বিক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলা চালিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা দেশের ভাব মর্যাদা এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ মিশনগুলোকে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় আরো বেশী দক্ষ ও সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন