ইহসান অর্থে কোরআন কারীমে অন্যান্য শব্দের সাথে আরও একটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তা হলো ‘বির’ শব্দটি। এ ‘বির’ শব্দটির বিস্তৃত পরিমন্ডলে কাফির ও মুসলিম সকলেই অন্তর্ভুক্ত আছে।
এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘যে সকল লোক তোমাদের সাথে ধর্মের ব্যাপারে যুদ্ধ করে না এবং তারা তোমাদেরকে তোমাদের গৃহ হতে বহিষ্কার করে না তাদের সাথে ইহসান করা এবং ন্যায়ানুগ ব্যবহার করা থেকে আল্লাহপাক তোমাদেরকে নিষেধ করেননি। অবশ্যই আল্লাহপাক ন্যায়ানুগ ব্যবহারকারীদের ভালোবাসেন। (সূরা মুমতাহানা: রুকু ২)।
সাহাবীদের মাঝে এমন কিছু লোকও ছিলেন, যারা অমুসলিমদের দান-খয়রাত করাকে পুণ্যের কাজ বলে মনে করতেন না। এর প্রেক্ষিতে এ নির্দেশ নাজিল হয় যে, হেদায়েত দান করা তোমাদের কাজ নয়; বরং তা হচ্ছে আমার কাজ। তোমাদের উচিত প্রত্যেক মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের প্রতি সদ্ব্যবহার করা এবং নিজেদের নিয়ত ও উদ্দেশ্যকে ঠিক রাখা। তোমরা তোমাদের নিয়ত অনুসারে পুণ্যের অধিকারী হবে। (ইবনে জারীর, ইবনে কাছীর, নাসাঈ)
ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের হেদায়াতের ভার তোমার ওপর অর্পিত নয়; বরং আল্লাহপাকই সৎপথে আনয়ন করেন এবং তোমরা যা কিছু খয়রাত দেবে, তা নিজের মঙ্গলের জন্যই দেবে এবং তোমাদের তা কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য করা হবে, এমনকি তোমাদের ওপর জুলুম করা হবে না।’ (সূরা বাকারাহ: রুকু ৩৭)। যদিও এটা হচ্ছে ইহসানের একটি খাস সুরত, কিন্তু বিস্তৃতির মাঝে সমগ্র বিশ্ব অন্তর্ভুক্ত আছে।
পুণ্য ও সদাচারের বিনিময় পুণ্য ও সদাচারের মাধ্যমে দান করা ইসলামের সেই বিধান যার ওপর সওয়াব ও আজাবের মানদন্ড নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি পুণ্যকর্ম করবে, আল্লাহপাকের নিকট সে পুণ্যময় বিনিময় লাভ করবে। আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘পুণ্যময় কর্মের বিনিময় পুণ্য ছাড়া কিছুই নয়।’ (সূরা আর রাহমান: রুকু)। যদিও এ আয়াতের পূর্ব সূত্রতার সম্পর্ক অনুসারে আখেরাতে পুণ্যকর্মের বিনিময় লাভের প্রতিই ইঙ্গিত প্রদান করে, কিন্তু তবুও শাব্দিক অর্থ ও মর্ম সেই বিধানের পরিব্যপ্তি দুনিয়া এবং আখেরাত উভয় জগৎকেই সম্পৃক্ত করেছে।
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো ঋণের বোঝা হাল্কা করা। বিশ্বের বুকে ইসলামই হচ্ছে একমাত্র ধর্ম যা এ বোঝাকে হাল্কা করে দিয়েছে। ঋণগ্রস্তদের প্রতি ইহসান করা, অভাবী লোকদের ঋণ দান করা, রিক্তহস্ত ঋণগ্রহীতাদের অবকাশ দেয়া এবং যারা একেবারেই ঋণ আদায়ে অক্ষম, তাদের ঋণ মাফ করাকে ইসলাম পুণ্যের কাজ বলে উল্লেখ করেছে।
আরবে সুদখোরী ও কুসিদ প্রথার আসর ছিল জমজমাট। তা তাদের এতখানি নির্দয় ও কঠিন প্রাণে পরিণত করেছিল যে, যারা ঋণ আদায় করতে পারত না, তাদেরকে ক্রীতদাসের মত বিক্রয় করা হত। এর দ্বারা যে মূল্য পাওয়া যেত তা দ্বারা ঋণ আদায় করা হত। বর্তমানকালের এ সসুভ্য যুগেও ঋণের জিঞ্জির ঋণগ্রহীতাদের ওপর ততখানিই ভারী হয়ে আছে। বরং পুঁজিবাদের বর্তমান নিয়ম-নীতি তাকে আরও ভারী করে তুলেছে। কোরআনুল কারীমের একটি মাত্র আয়াতেই এই সকল নিয়ম-নীতির অসারতা ও কদর্যতাকে এভাবে তুলে ধরেছে।
ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং যদি কোনো অভাবী লোক তোমাদের ঋণগ্রহীতা হয়, তাহলে সক্ষমতা অর্জন পর্যন্ত অবকাশ দাও; আর যদি মনে কর যে, তা তোমাদের পক্ষে খুবই উত্তম ও উপযোগী, তাহলে মূল ঋণের অংকও মাফ করে দাও।’ (সূরা বাকারাহ: রুকু ৩০)। রাসুলুল্লাহ সা. এক হাদীসে স্বয়ং আল্লাহপাকের জবানীতে বর্ণনা করেছেন যে, ‘কিয়ামতের দিন আমি স্বয়ং তিন শ্রেণীর লোকের বিপক্ষ অবলম্বন করব। তন্মধ্যে একদল হচ্ছে, যে স্বাধীন ও আজাদ ব্যক্তিকে বিক্রয় করেছে এবং এর মূল্যও হজম করে ফেলেছে।’ (সহীহ বুখারী: কিতাবুল বুয়ু, ফাতহুল বারী)।
এ বিষয়টিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করা হয়েছে এবং ঋণের ব্যাপারে রিক্তহস্তদের ওপর ইহসান করার বিভিন্ন সুরত বাতলে দিয়েছেন। অর্থাৎ অবকাশ দেয়া, ঋণ মাফ করা, মানবতার সাথে তাগাদা করা ইত্যাদিকে এমন এক পুণ্যের কাজ বলা হয়েছে যে, যদি কেউ এছাড়া নেকীর অন্য কোনো কাজ না করে, তবুও কেবল এ একটি কাজ তার মাগফিরাতের কারণ হতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন