সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নদী ও পার্ক উদ্ধারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

ঢাকা শহরের যানজট, পানিবদ্ধতাসহ নানাবিধ নাগরিক সংকটের কার্যকারণ ও সমাধান খুঁজতে গেলে প্রথমেই বেরিয়ে আসে নদীদখল, দূষণ,পয়ো: ও বর্জ্যব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনাহীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো। বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারাপাশের নদী দখল, দূষণ ও খাল ও জলাভ‚মি দখল ও ভরাটের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত এবং পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও দাবী-দাওয়ায় এসব বিষয়ই ঘুরপাক খাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে চলা নদীদখল, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ-শিল্পায়ণের ফলে ঢাকা নগরীর পরিবেশ বিপর্যয় ও নাগরিক জীবনের সংকট ক্রমে ঘনীভ‚ত হওয়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিকভাবেও ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য নগরীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এহেন বাস্তবতায় নাগরিক সমাজের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের আবেদনে হাইকোর্ট নদীরক্ষা ও দূষণের বিরুদ্ধে সরকারের প্রতি বিভিন্ন সময়ে সুনির্দ্দিষ্ট গাইডলাইনসহ নির্দেশনা জারি করেছে। তবে চলমান বাস্তবতাই বলে দেয়, সে সব নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। কোর্টের নির্দেশনা অনুসারে নতুন আইন প্রণয়ন এবং নদীরক্ষা কমিশন গঠন এবং ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নদীতীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও কিছুদিনের মধ্যেই উদ্ধারকৃত জমি আবারো দখল হয়ে গেছে। একইভাবে নদীতে শিল্পকারখানা ও নগরীর বর্জ্য ফেলার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারের তরফ থেকে শত শত কোটি টাকার প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়েছে। তবে কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। এ অবস্থাটিকে নদী নিয়ে কানামাছি খেলা বলে উল্লেখ করে তা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
তুরাগ নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও দখলমুক্ত করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে করা এক রীট পিটিশনের শুনানিশেষে বিচারপতি মইনুল আসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো: আশরাফুল কামালের যৌথ বেঞ্চের রায়ে নদ-নদী নিয়ে কানামাছি খেলা বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। রবিবার রীটের পূর্নাঙ্গ রায়ে নদ-নদী দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে আদালত একটি মাইল ফলক রায় বা নির্দেশনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে দেয়া আদালতের রায় ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দফতরগুলোর গৃহিত পদক্ষেপ এবং সে সব পদক্ষেপের আইনগত দুর্বলতা ও ফাঁকফোঁকড়গুলো চিহ্নিত করেই আদালত নতুন নির্দেশনা দেবে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছে। আদালতের আংশিক রায় ঘোষণায় নদীর অস্তিত্বকে একটি জীবন্ত সত্তা বা লিগ্যাল(জুরিসটিক) পারসন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নদ-নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করা না গেলে আগামীতে আমাদের জনপদ ও নাগরিক সভ্যতা যে বিপর্যয় সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তার তাৎপর্য উল্লেখ করে তুরাগ নদীর দখল উচ্ছেদের রীটের রায় একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। একইভাবে ঢাকা শহরের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও নাগরিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর সমাধানেও স্থায়ী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবী। চারটি নদীর দ্বারা বেষ্টিত প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সম্পদে সমৃদ্ধ ঢাকা নগরীকে আগামী দিনের জন্য বাসযোগ্য রাখতে নদ-নদী, খাল, জলাভূমি, পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠ পুনরুদ্ধার, সংরক্ষণ ও পরিবর্ধনের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
সুবে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য অন্তত ৫শ বছরের পুরনো হলেও পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকার নগর পরিকল্পনা ছিল মাত্র ২০-৩০ লাখ মানুষের উপযোগী। ষাটের দশকের শুরুতে গৃহিত ঢাকার প্রথম নগর পরিকল্পনায় ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রেখে প্রণয়ন করা হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকার নগরায়ন ও অপরিকল্পিত ডেমোগ্রাফিক বিস্তৃতি যে কোনো ধারণাকে হার মানায়। বর্তমানে দুইকোটির অধিক জনসংখ্যা অধ্যুসিত রাজধানী ঢাকা অপরিকল্পিত, বিশৃঙ্খল ও সমন্বয়হীনভাবে গড়ে উঠেছে। অপরিকল্পিত আবাসন, অবকাঠামো উন্নয়ন, পয়ো:নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে ওঠার সাথে সাথে চারপাশের নদনদী, অর্ধশতাধিক খাল, অসংখ্য পুকুর ও জলাভ’মি ভরাট ও বেদখল হয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে নাগরিক পরিবেশকে বিপর্যস্ত ও বসবাসের অযোগ্য করে তোলা হয়েছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ ও বালুনদীর স্রোতধারা ঢাকা নগরীকে নানাভাবে প্রাকৃতিক সুরক্ষা সুবিধাদিতে সমৃদ্ধ করেছিল, বেপরোয়া দখল, দষণ ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে একেকটি নদনদী এখন বর্জ্যরে নহর বা বিষাক্ত ও দুর্গন্ধময় ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে। অন্যদিকে নগরীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে রাস্তা, পার্ক, খোলা উদ্যানসহ জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন নতুন পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠ গড়ে তোলা হয়নি। উপরন্তু, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুই অংশেই বেশকিছু পুরনো পার্ক, মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান বেদখল হয়ে গেছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমন অন্তত ১২ টি পার্ক ও খেলার মাঠ বেদখল হয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। অনুপুঙ্খ অনুসন্ধানে এমন আরো অনেক পার্ক, মাঠ ও উন্মুক্ত সরকারী ভ‚মি বেদখল হওয়ার তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। রেলওয়েসহ বিভিন্ন সংস্থার হাজার হাজার একর জমি বেদখলে থাকার রিপোর্ট বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকার চারপাশের নদনদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করার স্থায়ী উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। সেই সাথে, বেদখল হওয়া খাল, পার্ক, খেলার মাঠ পুনরুদ্ধার এবং নতুন নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তোলার পাশাপাশি শিল্পকারখানা সরিয়ে নেয়া এবং আধুনিক পরিবেশ বান্ধব বর্জ্য বাস্তুব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার মাধ্যমে ঢাকার নাগরিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন