মানুষ প্রকৃতগতভাবে সুখান্বেষী। সুখী হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই তার পথচলা। সুখ কোনো দ্রষ্টব্য বস্তু নয়। এটা নিতান্তই ইন্দ্রিয়ানুভূতির বিষয়। মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ, উত্তম-অধম, উচিত-অনুচিত, আনন্দ-নিরানন্দ পরিমাপ করার একটা মানদন্ড আছে। এই মানদন্ড ইন্দিয়ানুভূতি সৃষ্টি করে। এই ইন্দিয়ানুভূতিতে যা কিছুই ইতিবাচক হিসেবে প্রতিফলিত হয় এবং যা উপকারী ও আনন্দদায়ক, তাই সুখের উৎস। যেমন- ভালো কাজ বা পুণ্যকর্ম মানুষের মধ্যে সুখানুভূতি সৃষ্টি করে, যা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। এই মানসিক প্রশান্তিই সুখ।
সুখের উৎস অসংখ্য। ঘর বাঁধায় সুখ, উত্তম স্ত্রীতে সুখ, ভালো সন্তানে সুখ, বিত্তবৈভবে সুখ, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে সুখ, কারো কল্যাণে বা সেবায় সুখ, সৎ জীবনযাপনে সুখ, ক্ষমতায় সুখ, কারো আনুগত্যে সুখ, নিরাপত্তায় সুখ, শান্তিতে সুখ- এ রকম আরো নানা বিষয়ে সুখ বিদ্যমান। পবিত্র কোরআনে আছে, আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে। এটাই সুখ। পবিত্র হাদিসে আছে, সকল পুণ্যকর্ম শান্তি এনে দেয়। এই অনুভবই সুখ।
প্রশ্ন হলো, সুখ কি সবাই পায়? সুখের উৎস ও উপাদানগুলো কি সবাইকে সমান সুখী করতে পারে? এর উত্তর নিশ্চিত নয়। একজন মানুষ হয়তো বিত্ত-সম্পত্তিতে সন্তুষ্ট। অন্যরা তা নয়। অন্য কেউ হয়তো কষ্টের সঙ্গে জীবনযাপনে সন্তুষ্ট। কেউ বা আবার দারিদ্র্যেও সন্তুষ্ট। যেমন- কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান। তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।’
সুখী হওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা সত্তে¡ও কেউ সুখী হয়, কেউ বা হয় না। অন্য এক কবির ভাষায়- ‘সদায় সুখ সুখ করি আমি, সুখতো আমার হলো না।’ মধ্যযুগীয় এক কবি বলেছেন, ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল, অমিয়া সাগরে সিনন করিতে সকলি গরল ভেল।’
সুখসন্ধানী অনেকের ভাগ্যেই সুখের দেখা মেলে না। সুখের ঘর আগুনে পুড়ে যাওয়ার কিংবা সুখসাগর গরলে পরিণত হওয়ার নজিরও আমাদের সামনে ভূরি ভূরি। এই তো ক’দিন আগে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের একজন ডাক্তারের ঘরই শুধু পুড়ে ছাই হয়ে যায়নি, তার জীবনও চলে গেছে। তিনি আত্মহত্যা করে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। দীর্ঘ ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বিয়ে করা স্ত্রীর প্রতি তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। পরকীয়ার অভিযোগ ছিল তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে।
সেই স্ত্রী এখন জেলে। তার জীবনও বিষময়। সমাজে এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, সন্তান পিতা বা মাতাকে, পিতামাতা সন্তানকে এবং ভাই ভাইকে অবলীলায় হত্যা করছে। ধর্ষণের রীতিমতো উৎসব চলছে। মাদকের তান্ডব ও আগ্রাসন সর্বত্র। জানমালের নিরাপত্তা কোথাও নেই। এ অবস্থায় কোথায় সুখের সন্ধান মিলবে? ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এক গভীর অসুখে আক্রান্ত।
দেশে সুখ যে দিনে দিনে উঠে যাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট-১৮তে তার প্রমাণ রয়েছে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫। ২০১৭ সালে ছিল ১১০। অর্থাৎ এক বছরে ৫ ধাপ অবনমন ঘটেছে।
রিপোর্টে সুখের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়েছে- জিডিপি, সামাজিক সহায়তা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, দাতব্য সেবা ও দুর্নীতিহীনতাকে। রিপোর্টে দেখা গেছে, যেসব দেশে বৈষম্য ও ভেদাভেদ কম ও সহায়তা বেশি, সেসব দেশের মানুষই সুখী।
ইসলাম বলে, সুখের ভিত্তি বিশ্বাস, আস্থা, ভরসা, কৃতজ্ঞতা, ব্যাপক রিজিক ও ভাগ্যের ওপর সন্তুষ্টি, তৃপ্তি ও আশাবাদিতা। জীবনে যা পাওয়া গেছে তা নিয়ে ইতিবাচক ভাবনা, যা পাওয়া যায়নি তা নিয়ে না ভাবা। সব সময় নিজের চেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীকে দেখা, বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, পরিবার ও শ্রেণীকে না দেখা। এভাবে চললে মন বিচলিত ও নিক্ষিপ্ত হওয়ার বদলে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত হবে।
সেজন্যই বলা হয়, ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘আমি তোমাদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছি ও তার মধ্যে রিজিকের ব্যবস্থাও করেছি। তোমরা খুব অল্পই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।’ সূরা আরাফ : আয়াত ১০। রাসূল সা: বলেছেন, প্রকৃত সুখ ও ঐশ্বর্য হচ্ছে অন্তরের সুখ ও ঐশ্বর্য।
তিনি আরো বলেন, মানুষকে যত নেয়ামত দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে কৃতজ্ঞ অন্তর। তিনি এও বলেছেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ আন্তরিকতা সহকারে আল্লাহকে রব, ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা এবং মুহাম্মদ সা:-কে নবী হিসেবে কবুল করে নিয়েছে, সেই ব্যক্তি প্রকৃত ঈমানের সম্পদ লাভ করেছে। বস্তুত ঈমানই সুখের চাবিকাঠি। আল্লাহ আমাদের সকলকে ঈমানদার হওয়ার সুযোগ দিয়ে সুখী হওয়ার তৌফিক দান করুন, এই কামনা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন