যুগে যুগে ইসলামের প্রচারে নতুন ও যুগোপযোগী কৌশল দেখা গেছে। প্রায় এক শতাব্দী আগে উপমহাদেশে জনগণের কাছে তাদের দীন ঈমানকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিল্লী থেকে একটি নতুন ধারার কাজ শুরু হয়। প্রথমে কান্ধালা, পরে দিল্লীর অধিবাসী মাওলানা ইসমাঈল রহ.-এর পুত্র মাওলানা ইলিয়াস রহ. এ ধারার কাজ শুরু করেন। যদিও এর আগে মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. একই ধারার গণমুখী এই কাজ দিল্লীর একই এলাকায় শুরু করিয়েছিলেন। কিন্তু বহুমুখী কাজের চাপে তাবলীগের এ কাজ তিনি ব্যাপক করতে পারেননি। তার প্রিয় পাত্র মাওলানা ইলিয়াস রহ.-কে তাবলীগের কাজ অতুলনীয় আবেগ ও ত্যাগের সাথে করতে দেখে তিনি খুবই প্রীত হন এবং এর উপদেষ্টা ও শুভার্থী হিসাবে আজীবন সমর্থন দিয়ে যান। পাশাপাশি তার ঈমানী দূরদৃষ্টি ও অতুলনীয় প্রজ্ঞায় এ কাজের ব্যাপারে হাজারো আশঙ্কাও অন্তরে পোষণ করেন।
দাওয়াত বিষয়টি মূলত অমুসলিমদের জন্য। তাবলীগ অর্থ দীন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। মূলত এর ক্ষেত্রও অমুসলিমরা। পরিভাষায় এর প্রয়োগ যাই হোক, আসলে মুসলিম সমাজে দীন পৌঁছানোর অর্থ হচ্ছে, তাদের ঈমান একীনের উন্নয়ন, আত্মশুদ্ধি ও তাদের দীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করা। শরীয়ত যাকে দাওয়াত, তাজকিয়া, তা’লীম ও তারবিয়াত বলে উল্লেখ করেছে। এ সম্পূর্ণ কাজটিই ছিল হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর তাবলীগ। তাবলীগি জামাত তার দেওয়া নাম। প্রচলিত নাম দাওয়াত ও তাবলীগ। বাস্তবে যেটি তা’লীম ও তারবিয়াত।
তাবলীগ জামাতে তা’লীম অর্থ দীনের প্রতিটি বিষয় জানার গুরুত্ব ও আগ্রহ মানুষের মনে তৈরি করা। তারবিয়াত মানে ঘর বাড়ি থেকে দূরে একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশে মানুষকে নিয়ে কিছু দিন রাখা ও তার অন্তরকে আখেরাতমুখী বানানো। হাতে কলমে আমল শেখানো। ইসলামের হাজার বছরে এমন কর্মসূচি নিয়ে কোনো জামাত ছিল কি না, এ ধরনের কাজ শুরু করা ভালো হবে কি না, এ নিয়ে মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর দ্বিধা সংশয় জীবনে এক সেকেন্ডের জন্যও দূর হয়নি। তিনি এ কাজের জন্য হযরত থানভীর দরবারে গিয়ে তার বিহিত মর্জি লাভের চেষ্টা করলে হযরত থানভী তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনার লোকেরা তাবলীগ করবে মানে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। এটা তো আলেমদের কাজ। কারণ তারা কিছু জানেন, যা অপরকে পৌঁছে দিতে পারবেন। যারা কিছু জানে না, একান্তই সাধারণ মানুষ কিংবা সাধারণ শিক্ষিত হলেও দীনি শিক্ষায় অজ্ঞ। তারা মানুষের কাছে কী পৌঁছাবে? কী তাবলীগ করবে? তাবলীগ অর্থ তো পৌঁছে দেওয়া।
তখন হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. এককথায় উত্তর দিলেন, হযরত আপনার যে জ্ঞানভান্ডার, আপনার ইলমী ও ইসলাহী নির্দেশনা, আপনার মালফুজাত এসবই তারা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে। হযরত থানভী এ কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলেন।
মাওলানা ইলিয়াস রহ. এ প্রচারকার্যের ৬টি মূলনীতি তৈরি করলেন। তার মনে অনেক প্রশ্ন। এসব কি ঠিক আছে? গেলেন দেওবন্দের প্রধান মুফতি মাওলানা কিফায়াতুল্লাহ সাহেবের কাছে। ছয় নাম্বার তাকে দেখালেন। মুফতি কিফায়াতুল্লাহ সাহেব সব ওকে করলেও বিনয় ও ভদ্রতার খাতিরে মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর প্রস্তাবিত একটি নীতি সামান্য বদলে দিলেন। সম্ভবত এ বিনীত পরিবর্তনটিই সময়ে তাবলীগি প্রজন্মের জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। তাদের এক শ্রেণির মধ্যে আলেম-ওলামা বিদ্বেষ যেন মজ্জাগত। নিজেদের বড় মনে করা, নবীওয়ালা কাজের একমাত্র ঠিকাদার মনে করা, নিজেদের কাজকেই আল্লাহর রাস্তা বলা, নায়েবে রাসূলদের হেয় জ্ঞান করা ইত্যাদি। হতে পারে এ নীতিটি বদলে দেওয়ারই ফসল। ভদ্রতার ফলাফল এমনই হয়। নীতিটি ছিল ‘ইকরামুল ওলামা’। মানে, ওলামায়ে কেরামের খাতির তাওয়াজু ও সম্মান। মুফতি সাহেব রহ. নিজের কলমে এ কথাটি কেটে লিখে দিলেন, ‘ইকরামুল মুসলিমীন’। মানে, সব মুসলমানের প্রতি খাতির তোয়াজ ও সম্মান।
মাওলানা ইলিয়াস তাবলীগের ছয় ওসূলের একটি বানিয়েছিলেন, ওলামাদের সম্মান। তিনি বলতেন, যেদিন ওলামায়ে কেরাম এ কাজটি নিয়ে যাবে সেদিনই আমার তাবলীগ সফল। তিনি তাবলীগের লোকদের বলতেন, তোমরা কোথাও গিয়ে কখনোই ওলামায়ে কেরামকে নিজেদের কাজের দিকে ডাকবে না, তাদের সাথে দেখা করে দোয়া চাইবে।
একদিন গভীর রাতে বর্ণিত মুফতি সাহেবের কাছে গিয়ে ঘরের দরজা আটকে দিলেন মাওলানা ইলিয়াস রহ.। একটি বড় ছুরি হুজুরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, হয়তো আমার এ নতুন ধারার কাজটিকে আপনি শরীয়তের আলোকে সঠিক বলে ফতোয়া দিন, নয়তো এই ছুরি দিয়ে আমাকে জবাই করে ফেলুন। উম্মতের দুরবস্থা দেখে এমন একটি জামাত তৈরি না করে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হয় এ কাজ আমি করব, না হয় জীবন দিয়ে দেব। এর কিছুদিন পর মাওলানা ইলিয়াস অতি দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে ইসলামের শিক্ষা প্রচারের কাজ শুরু করেন। প্রথম কেউ তার ডাকে সাড়া দিত না। তিনি নিজ পকেট থেকে শ্রমিকদের মজুরী দিয়ে তাদের কিছু সময় নিজের কাছে রেখে দীনি শিক্ষা দিতেন। দিল্লীর পার্শ্ববর্তী একান্ত অবহেলিত এলাকা মেওয়াতে এ কাজ শুরু হয়। নিজামুদ্দিন এলাকার বাংলাওয়ালী মসজিদ ছিল এর মারকাজ। এ জায়গাটি মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর পৈত্রিক সম্পত্তি। ওয়াকফ সূত্রে যার মুতাওয়াল্লি এখন মাওলানা সা’দ সাহেব।
তাবলীগ তার প্রাথমিক সময় অতিক্রম করছে। এসময় হযরত থানভী রহ. এর ইন্তিকাল হয়। মাওলানা ইলিয়াস শোকে ভেঙে পড়েন। তিনি ময়দানের সব জামাতকে খবর পাঠান। তোমরা কোরআন খতম করে করে আমার এ কাজের আদর্শ হযরত থানভী’র রুহে সওয়াব রেসানী কর। তার ফয়েজ লাভ করতে পারলে এ কাজ বেশি বরকতময় হবে। হযরত থানভী’র কিতাবাদি পাঠ ও তা’লীম কর।
মাওলানা ইলিয়াস তার শেষ সময়ে খুব অস্থিরতায় ভুগছিলেন। এসময় মাওলানা মুফতি শফী রহ. নিজামুদ্দিনে গেলে তিনি মুফতি সাহেবকে বললেন, ইসলামে এ নতুন ধারার একটি কাজ শুরু করে গিয়ে আমি কি বড় কোনো ভুল করলাম? ভবিষ্যতে কি এটি অভিনব কোনো ফিতনার রূপ নেবে? আমার এ ব্যাপারে ভয় হচ্ছে। মুফতি শফী জবাব দিলেন, আপনার মনের এ ভয় ও সংশয় প্রশংসনীয় বিষয়। আপনার জীবদ্দশায় তো কাজ ঠিকই আছে। এ পর্যন্তই আপনার চিন্তা। পরে যদি নষ্টও হয়ে যায়, তাহলে এর দায় আপনাকে নিতে হবে না। মাওলানা ইলিয়াস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তখন তিনি বলতে গেলে মৃত্যুশয্যায় ছিলেন।
মাওলানা ইলিয়াস রহ. এ নতুন কাজে নিজ পুত্র দ্বিতীয় হযরতজী মাওলানা ইউসুফ রহ. কে কিছুতেই লাগাতে পারছিলেন না। তখন তিনি এ ব্যাপারে মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গোহীর নিকট সাহায্য চাইলেন। আশা করলেন, তিনি যেন মাওলনা ইউসুফকে পিতার কষ্টের কথাটি বুঝিয়ে বলেন। মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গোহী রহ.-এর মুখ থেকে আমি নিজে এ ঘটনাটি শুনেছি। তিনি বলেন, আমার কথায় মাওলানা ইউসুফ তাবলীগে যোগ দিলেন। আমি বিস্মিত হলাম যে, কিছুদিন পর তিনি আমার সাথে একটি রেল জংশনে এসে এসময় দেখা করলেন, যখন আমি এ পথ দিয়ে রেলে যাচ্ছিলাম। বন্ধু মানুষ যোগাযোগ করে দেখা করতে এলে আমি খুশি হই।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি মাসআলা নিয়ে বিপাকে পড়েছি, আপনাকে ছাড়া আর উপায় দেখছিলাম না। মুফতি গাঙ্গোহী এ ফতোয়া বা সমাধানটি দিলেন। এরপর মাওলানা ইউসুফের একটি কথায় তিনি খুবই আশ্চর্যান্বিত ও হতভম্ব হয়ে গেলেন। যখন মাওলানা ইউসুফ তাকে বললেন, ভাই আল্লাহর রাস্তায় আপনিও কিছু সময় লাগান।
মুফতি গাঙ্গোহী আমাকে বলেন, একজন আলেম ওই কাজে যোগ দেওয়ার পর পরিবেশ থেকে এত দ্রুত প্রভাবিত হবে, তা আমার কল্পনায়ও ছিল না। কিছুদিন আগেও যে তার পিতার এ নতুন প্রয়াসকে জ্ঞানের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করত, আমার অনুরোধে সে পিতার আশা পূরণের জন্য সে কাজে যোগ দেয়। কিছুদিন পরই তার আলেমানা বিবেচনাবোধ ক্ষুন্ন না হলে সে কী করে আমাকে বলে যে, আল্লাহর রাস্তায় কিছু সময় লাগান। আমি তখন কথা বাড়াইনি। ট্রেনও ছাড়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। শুধু বিদায়ের বেলা বললাম, আল্লাহর রাস্তায় তুমিই থাকো ভাই। আমাদের মত মানুষদের ইলমে নববীর রাস্তায় থাকতে দাও। নতুবা তোমরা আটকে গেলে কার কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করবে?
এরপর মুফতি গাঙ্গোহী দক্ষিণ আফ্রিকায় কড়া তাবলীগিদের সাথে তার আলাপ আলোচনার অনেক কথাই আমার সামনে তুলে ধরেন। বলেন, শুরু থেকেই তাবলীগের আবেগ আর সামগ্রিক ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ প্রজ্ঞা, এ দু’টি বাস্তবতা মুখোমুখি একটি দ্বা›িদ্বক বৃত্তে অবস্থান করছিল। মাওলানা ইউসুফ ও মাওলানা ইনআমুল হাসান এ দু’টি বিষয়কে কোনো রকম সমন্বিত রেখে সঠিকভাবে এগোচ্ছিলেন। বর্তমানে এ দু’টি ধারা সত্যিকার অর্থেই দুই মেরুতে চলে গিয়েছে। পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। আমি জানি না, এ কাজ আর কতদিন গ্রহণযোগ্য ও সঠিক রাস্তার ওপর থাকবে। এর কিছুদিন পরই হযরত মাহমুদুল হাসান গাঙ্গোহী ইন্তিকাল করেন।
তাবলীগের সঙ্কট যদিও নতুন নয়, কিন্তু এটি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় মাওলানা সা’দ এর একক আমীরত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টার পরে। সিনিয়র প্রায় সবাই বৈশ্বিক এ আন্দোলনের প্রধান হিসাবে তাকে মেনে নিতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। ব্যবস্থাপনার দ্ব›দ্ব একসময় জনগণ পর্যায়ে প্রকাশিত হয়। আলেমগণ মাওলানা সা’দের চিন্তাধারা ও কর্মনীতিকে তাবলীগের প্রথম দিককার মুরব্বীদের নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে জানিয়ে দেন।
তাবলীগ দু’টি ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। বাংলাদেশে এ দূরত্ব ও বৈপরীত্ব অধিক প্রকট হয়ে ওঠে। একসময় এটি খুন, জখম ও মারামারির পর্যায়ে চলে যায়। লজ্জার মাথা খেয়ে তাবলীগ এখন মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রণালয়ে ঘুরে। হাইকোর্টে যায় নালিশ নিয়ে। বিচারকরা বলেন, দীনের কাজ নিয়ে আপনারা কোর্টে আসেন, আমাদের লজ্জা লাগে। বাংলাদেশের বিবেচনায় এর নিরসন কেবল ওলামায়ে কেরামের মতামত ও সিদ্ধান্তের ওপরই ন্যস্ত। বিশ্ব তাবলীগের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য।
যেহেতু মাওলানা ইলিয়াস রহ. তার উস্তাদ, শায়েখ, পীর ও মুরব্বীদের কথা মেনে এ কাজ চালিয়ে গেছেন, পরের দুই হযরতজীও একইভাবে তাদের পূর্বসূরীর পথ অনুসরণ করেছেন, মাওলানা সা’দ সাহেবকেও নিজের অভিজ্ঞতা, পছন্দ, বুঝ জ্ঞান ইত্যাদির ওপর ভরসা ছেড়ে নিঃশর্তভাবে সময়ের সেরা ওলামায়ে কেরামের শরণ নিতে হবে। ওলামা-মাশায়েখের কথা চোখ বুজে মেনে নিয়ে তাবলীগের ব্যবস্থাপনায় জুড়ে থাকতে হবে। তিনিও আলেম, তার সাথেও আলেমরা আছেন, তার কথাবার্তাও যুক্তি ও প্রমাণ নির্ভর ইত্যাদি বক্তব্য তাবলীগের বর্তমান সঙ্কটের সমাধান নয়। শুরু থেকে এর তাত্তি¡ক ও নীতিগত যে নির্দেশনা বিশেষজ্ঞ ওলামা ও বুযুর্গানে দীন দিয়ে এসেছিলেন, সে ধারায়ই তাবলীগ চলতে পারে। স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ধারায় নিজেকে ওলামায়ে কেরামের অমুখাপেক্ষী মনে করে যদি এর নেতৃত্ব চলতে চায়, তাহলে ইতিহাসের আরও অনেক পরিচিত অথচ গোমরাহ ফেরকার ভাগ্য বরণ করতে এই তাবলীগ জামাতেরও বেশি দিন সময় লাগবে না।
দেশের তাবলীগ নির্ভর ধর্মীয় সমাজে এখন চরম বিপর্যয়। মসজিদে মসজিদে দু’টি করে দল। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী পর্যায়ে ব্যাপক মতানৈক্য হিংসা বিদ্বেষ ও মারাত্মক বিভেদ। বছরের পর বছর মিল মহব্বতের সাধনা করে যে শত্রুতার জন্ম হয়েছে, তা দূর হতে কত জীবন লাগবে আল্লাহই ভালো জানেন। ভালোবাসার চর্চা থেকে ঘৃণা সৃষ্টি হয়, এমনটি আর শোনা যায়নি। এখানে বুঝতে হবে, পদ্ধতিগত কোনো ত্রুটি ছিল। যার ফল বৈশ্বিক পর্যায়ে এত তিক্ত ও বিষময় হতে চলেছে।
সমাজ বিজ্ঞানের জনক আল্লামা আবদুর রহমান ইবনে খালদুন রহ. বলেছেন, ‘একটি সভ্যতারও একটি হায়াত থাকে। আমার অভিজ্ঞতায় ১০০ বছর পর সভ্যতারও কঠিন বাঁকবদল হয়। অনেক সময় মৃত্যুও ঘটে।’ এর ব্যাখ্যায় আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আন্দোলন, রাষ্ট্র, জাতি, সংগঠন ইত্যাদিরও কমবেশি ১০০ বছরে একটি পরিণতি আসে। যেমন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ১৯১৭ থেকে ১৯৯২, এ সময়ের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছে। তুরস্কের নাস্তিক্যবাদী সেক্যুলারিজম ১৯২৪ থেকে ২০০২ পর্যন্ত হায়াত পেয়েছে। গড়ে ৭০-৮০ বছরের বেশি বড় কোনো শক্তিই তার মূল রূপ ধরে রাখতে পারে না।
স্বয়ং অমর ও চিরস্থায়ী জীবনব্যবস্থা ইসলামেরও শতাব্দীতে নতুন মোজাদ্দেদের প্রয়োজন হয়। কারণ, মানুষ ও সমাজ বদলে যায়। নীতি আদর্শ পালনে উদাসীনতা নেমে আসে। নতুন সংস্কারক সব ঝেড়ে মুছে আবার শুরু করেন। সমাজের শরীরে নতুন রক্ত প্রবাহিত করেন। তাবলীগ জামাতের ক্ষেত্রেও ইলম ও ইহসানের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যে নির্দেশনা দিবেন, তা মেনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে চলতে হবে। যদি কেউ এ সত্য অস্বীকার করে, তাহলে অস্বীকার করতে পারে, কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের ঊর্ধ্বে সে যেতে পারবে না। ইসলামের নামে জন্ম নেওয়া শত বছরের পুরোনো এ কাজও কাঙ্খিত প্রজন্ম তৈরি করতে পারবে না।
ইসলামের নামে চললেও এ কাজের ফলে তৈরি সমাজটি হয়ে যাবে ইসলামী আখলাক শূন্য। যেভাবে বহু দীনি জামাত একসময় পথ হারিয়েছে। বড় আশা আকাঙ্খার কাজ পরিণত হয়েছে নতুন ফেরকায়। গোমরাহ জামাতে। মিল মহব্বতের তাবলীগ, ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের তাবলীগ অন্তত বাংলাদেশে যে মতান্তর, বিরোধ, বিদ্বেষ, হানাহানি, রক্তারক্তির নজির স্থাপন করছে, এমন কল্পনাও কি সাধারণ মানুষ করেছিল? এদেশের জনগণ স্বপ্নেও কি ভেবেছিল, দীনদার লোকেরা ওলামায়ে কেরামকে এভাবে দুশমন মনে করবে? তাদের হাতে অপর মুসলমান হতাহত হবে?
দেশব্যাপী দুঃখ ও বেদনার শৈত্যপ্রবাহ বইছে। সারাদেশে উভয় গ্রুপের মনে জ্বলছে তুষের আগুন। তাবলীগি একটি শ্রেণী ও ওলামায়ে কেরামের অনুসারী দীনদার পরহেজগার মানুষের পরস্পরের অন্তরে কল্পনাতীত দ্বিধা-সংশয়, ভয়, শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা। এত কিছুর জন্য যারা দায়ী, তাদের কী যে পরিণতি হবে তা নিয়ে আমরা খুবই ভাবিত ও চিন্তিত। শুধু আবেদন রাখতে চাই, সবাই আল্লাহকে ভয় করুন। বিবেক জাগ্রত করুন। সব কিছুর জন্য একদিন প্রত্যেককেই জবাবদিহি করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন