সম্প্রতি চট্টগ্রামে ডাক্তার দম্পতির যে করুণ পরিণতি হয়েছে, সে জন্য কিছু লোক ও কতিপয় মিডিয়া অনেক বাজে কথা বলছে। এসব কথা শুনে সাধারণ মানুষ, সরল সহজ নাগরিক বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কোমলমতি ছেলে-মেয়েরা বিভ্রান্ত হতে পারে। তাই তাদের এ ভুল কথাবার্তার জবাব দেয়া দ্বীনি দায়িত্ব মনে করছি। ডা. আকাশ বিয়ের আগে থেকেই কমপক্ষে ছয় বছর তার স্ত্রী ডা. মিতুর সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক শুরু করে বলে মিতু বলেছে। ছয় বছর পর তারা বিয়ে করে। বিয়ের বয়স হয়েছিল ১০ বছর। এর মধ্যে আকাশের কথামতো সে ভালো হয়ে গেলেও স্ত্রী মিতু ভালো হয়নি। সে একাধিক লোকের সাথে অবৈধ মেলামেশা চালিয়ে যেতে থাকে।
ঈমান, ইসলাম, নামাজ, বন্দেগি, হালাল, হারাম তথা দ্বীনদারি না থাকায় এরা ডাক্তার হয়েও ভালো মানুষ হতে পারেনি। চরিত্রবান হতে পারেনি। দায়িত্বশীল হতে পারেনি। সংসারে সুখ আনতে পারেনি। জীবনকে পবিত্র উপায়ে উপভোগ করতে পারেনি। যদি তারা কোনো আল্লাহওয়ালার সান্নিধ্য পেত, তাহলে জীবন তাদের এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না। তারা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ধ্বংস হয়ে যেত না।
দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা তাদের সুশিক্ষিত করতে পারেনি। কারণ, এ শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ নয়। যদি ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে তাদের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকত, তাহলে এ দু’জন মানুষ এভাবে অকালে ধ্বংস হয়ে যেত না। তাদের পরিবার মহাবিপদে পড়ত না। তাদের আত্মীয়স্বজন এমন বিপর্যস্ত হতো না। তাদের বাবা-মা জীবন্মৃত হয়ে পড়তেন না। এরপরও আমাদের দেশের সব শিক্ষিত ছেলে-মেয়ে এমন হয় না।
তারা স্কুল-কলেজের শিক্ষার পাশাপাশি মসজিদ-মকতব কিংবা বাসায় হুজুরের কাছে দ্বীন, ঈমান, চরিত্র, নৈতিকতা, সওয়াব ও গুনাহের শিক্ষা লাভ করে। বাড়িতে দাদী-নানী বা অন্য মুরব্বিদের কাছে আল্লাহ, রাসূল, আখেরাত, ভালো-মন্দ, নেকি-বদি প্রভৃতির কথা শোনে। পারিবারিক মূল্যবোধ তাদেরকে মানুষ হতে শেখায়।
ডা. আকাশ ও মিতুর বেলায় সম্ভবত এমনটি হয়নি। তাদের ভাগ্য ভালো ছিল না। এত অশান্তির মধ্যেও আকাশ মিতুকে ভালোবাসা বন্ধ করেনি। এত অনৈতিকতা জানা সত্তে¡ও সে একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের ভ‚মিকা রাখতে পারেনি। একতরফা প্রেম বা অপাত্রে প্রেম তাকে নিষ্কর্মা, অথর্ব, নির্লজ্জ ও ব্যর্থ মানুষে পরিণত করেছিল। সে স্ত্রীর গোপন কথা সব ফাঁস করে দিয়ে কাপুরুষের মতো আত্মহত্যা করেছে। এর নাম প্রেম নয়। এ হচ্ছে কারো মিছে মোহে পড়ে নিজের ব্যক্তিত্ব, অস্তিত্ব ও পরিচয় বিনষ্ট করে দেয়া। এমনকি মহামূল্যবান জীবনটিও বেঘোরে হারানো।
মিতুর ব্যাপারে আমার কিছু বলার রুচি হচ্ছে না। তার উচিত ছিল দাম্পত্য জীবনে বিশ্বস্ত থাকা। তার বিষয়ে মানুষ ও সংবাদমাধ্যম যেভাবে আলোচনা চালাচ্ছে, তাতে সমাজের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বরং বেশি হচ্ছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সম্ভবত এ ধরনের দম্পতির জন্যই বলেছেন, বেপরোয়া ব্যভিচারী, ব্যভিচারিণী ও মুশরিক নারী ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না এবং বেপরোয়া ব্যভিচারিণীকে একজন অভ্যস্ত ব্যভিচারী কিংবা মুশরিকই বিবাহ করবে। এদের সাথে বিয়েশাদি ঈমানদারদের জন্য হারাম। আল কোরআন, সূরা নূর : ০৩।
অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন, খারাপ নারীরা খারাপ পুরুষের জন্য আর খারাপ পুরুষেরা খারাপ নারীদের জন্য এবং ভালো নারীরা ভালো পুরুষের জন্য আর ভালো পুরুষেরা ভালো নারীদের জন্য। মানুষ যাই বলুক, এরা তা থেকে পবিত্র। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা এবং সম্মানজনক রিজিক। আল কোরআন, সূরা নূর : ২৬।
যে কথা বলছিলাম, এক শ্রেণীর লোক যুক্তি দেখাতে চাইছেন যে, ৩৫ লাখ টাকা দেনমোহর দেয়ার ভয়েই নাকি আকাশ মিতুকে ডিভোর্স দিতে পারেনি। যদি দেনমোহর কম হতো তাহলে আকাশকে মরতে হতো না। দু-একটি টিভি চ্যানেল গোটা ঘটনাটিকে ইসলামের দেনমোহর প্রথার ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেও কসুর করেনি। তাদের বুদ্ধিজীবী অতিথি ও অ্যাংকরদের কথাবার্তা শুনে মনে হবে আকাশ-মিতুর চরিত্র ফুলের চেয়েও পবিত্র। তাদের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো ভুলই নেই। মিতু যা করেছে ভালোই করেছে।
আকাশ আত্মহত্যা করেও মন্দ করেনি। তবে দোষ তারা একটু খুঁজে পেয়েছেন একটি জায়গায়। আর সেটি হচ্ছে দেনমোহর কেন বেশি? এদের আক্কেল দেখে মানুষ থ খেয়ে যায়। এত বুদ্ধি নিয়ে তারা ঘুমান কেমনে, তা ভেবে মানুষ ক‚ল পায় না। ব্যভিচারী স্ত্রী বেহায়া অত্যাচারী নারী ত্যাগ করতে হলে আদালতের আশ্রয় নেয়া যায়, এ কথা কি তারা জানেন না? এমন বিপদে কী কী করা যায় তা কি ডা. আকাশ জানত না? দুনিয়াতে এমন কি কেউ ছিল না, যার কাছে সে পরামর্শ চাইতে পারত?
দেনমোহর বেশি বা কম কোনো কথা নয়। যে যেমন নারী বিয়ে করবে, যে পরিবারে বিয়ে করবে, যে স্ট্যাটাসে কুফু মেলাবে, সে অনুযায়ীই তাকে দেনমোহর দিতে হবে। এমন পরিবারে কেউ যাবে কেন, যে পরিবারের মেয়ের উপযুক্ত দেনমোহর সে দিতে পারবে না। এ মেয়েটির জীবন তার বাবার বাড়িতে যেভাবে কেটেছে, ঠিক তেমন স্ট্যান্ডার্ডে তাকে রাখতে পারবে না। তেমন বাড়ি, তেমন আসবাবপত্র, পরিবেশ, খোরপোষ, চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পারবে না।
ইসলাম বিয়েশাদিতে এই সমকক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। শরীয়তে যাকে কুফু বলে; তো দেনমোহর কম বা বেশি শরীয়ত নির্ধারিত করে দেয়নি। পরিবার ও পরিবেশ অনুযায়ী এটা নির্ধারিত হওয়াই নিয়ম। বিয়ে ভাঙতে হলে দেনমোহর দিতে হয় তা না জানা যেমন অজ্ঞতা, তেমনি অসমর্থ হয়েও মোটা অঙ্কের দেনমোহরে রাজি হওয়া কিংবা সাইন করা ডাবল অজ্ঞতা। এর সাথে আত্মহত্যার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের বলব, জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান জেনে নিয়ে জীবন যাপন করো। শান্তি পাবে। অন্য পথে শান্তি নেই, মুক্তিও নেই। ইহকাল-পরকাল দুটোই বরবাদ।
বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াকর্মীদের বলব, আরো বেশি পড়াশোনা করুন। বিদগ্ধ ও প্রজ্ঞাবান মানুষদের সান্নিধ্য নিন। সামান্য পুঁজি নিয়ে সবজান্তার ভাব ধরে আত্মপ্রবঞ্চনায় ডুবে থাকবেন না। সমাজকেও ডোবাবেন না। জ্ঞানের পৃথিবী কত যে বড় তা একমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেরা আন্দাজ করতে পারে না। অন্তত সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ৯২ শতাংশ মানুষের দৈনন্দিন জীবনবিধান সম্পর্কে বিশদ পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকুন। কথায় ওজন আসবে। পেশায় পূর্ণতা আসবে। মানুষ হিসেবে সমৃদ্ধ হবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন