আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় কুফরের চারটি শ্রেণীর বিষয়ে বিশদ বর্ণনা উপস্থাপন করেছি। বর্তমান নিবন্ধে অবিশষ্টগুলোর কথা তুলে ধরা হলো।
ঙ. কুফরে যিন্দিকাহ: প্রকাশ্যভাবে সকল জরুরিয়াতে দ্বীনকে মেনে নেয়। বাহ্যত তাদেরকে মুসলমান বলেও মনে হয়। কিন্তু তারা দ্বীনের সুস্পষ্ট অত্যাবশ্যকীয় কিছু বিষয়ের এমন অর্থ ও ব্যাখ্যা দেয়, যা দ্বীনের সর্বজনস্বীকৃত অকাট্য প্রমাণিত বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। যেমন- কাদিয়ানীরা জরুরিয়াতে দ্বীনের অনেক বিষয়ের ওপর এমন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে, যা বিশুদ্ধ ও অকাট্য প্রমাণিত বিষয়ের বিপরীত হয়। এ কারণে সকল যিন্দিক কাফের শ্রেণীভুক্ত।
এদের সম্পর্কে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কি কিতাবের এক অংশের প্রতি কুফরি করো?’ (সূরা বাকারাহ : আয়াত ৮৫)। মোট কথা, যদি কেউ ভেতরে ও বাহিরে তথা মনে ও মুখে জরুরিয়াতে দ্বীনের কিছু কিছু বিষয়ের এমন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে, যা সাহাবা ও তাবেয়িদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরিপন্থী এবং ওই মতের বিপরীত যার ওপর উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এরূপ ব্যক্তিকে যিন্দিক বলে।
উদাহরণস্বরূপ কেউ কোরআনকে আল্লাহর সত্য বাণী বলে বিশ্বাস করে, তাতে উল্লিখিত জান্নাত-জাহান্নামকে হক বলে বিশ্বাস করে, কিন্তু জান্নাত-জাহান্নামের ভিন্নতর অর্থ করে। সে বলে, জান্নাত হলো মানসিক প্রশান্তি উপকরণ প্রাচুর্য, যা প্রশংসিত যোগ্যতার মাধ্যমে লাভ করা যায় আর জাহান্নাম হলো নিন্দনীয় ক্ষমতাবলে অর্জিত লজ্জা ও সামাজিক সঙ্কোচন। বস্তবে প্রতিষ্ঠিত জান্নাত-জাহান্নামের কোনো অস্তিত্বই নেই। (ফয়জুল বারী : খন্ড ১, পৃ. ৭১)।
চ. কুফরে নি’মাত: এটা ‘শুকরে নিমাতে’র বিপরীত শব্দ। যার অর্থ অকৃতজ্ঞতা, কৃতঘ্ন হওয়া। (লিসানুল আরব: খন্ড ৫, পৃ. ১৬৯)। আর ঈমানের বিপরীত কুফর হলো, যে বিষয়ে ঈমান বা আন্তরিক বিশ্বাস থাকা দরকার, সেখানে ঈমান না থাকা। (শরহুল মাকাসেদ: খন্ড ৩: পৃ. ৪৭৫)। জেনে রাখা উচিত, আহলে কিবলা দ্বীনি বিষয়ের সংঘর্ষমুক্ত অর্থকারীদেরকে কাফের বলা যাবে না।
তবে আহলে কিবলা বলতে শুধু কিবলার দিকে মুখ করে নামাজ আদায়কারীদেরকেই বোঝায় না। বরং আহলে কিবলা বলতে ওই জনগোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা জরুরিয়াতে দ্বীনকে স্বীকার ও মান্য করে। কোনো বিষয়ের প্রতি অস্বীকৃতি জানায় না। আর সংঘর্ষমুক্ত অর্থ বলতে বোঝায়, দ্বীনি কোনো বিষয়ের এমন ব্যাখ্যা করা, যার দ্বারা জরুরিয়াতে দ্বীন বা দ্বীনের অকাট্য বিষয় প্রমাণিত হয় এবং সর্বজনস্বীকৃত বিষয়ের প্রতি আক্রমণ আনে না। এজাতীয় অর্থগ্রহণকারীকে কাফের বলা যাবে না। আর যদি অপব্যাখ্যাকারী অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অকাট্য প্রমাণিত বিষয়কে অস্বীকার করে, তবে অবশ্যই সে কাফের।
এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করো আর কিছু অংশ অস্বীকার করো। তোমাদের মধ্যে যে এ ধরনের আচরণ করবে, সে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা-গঞ্জনায় নিপতিত হবে, আর কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে। আল্লাহপাক তোমাদের কার্যাবলি হতে উদাসীন নন।’ (সূরা বাকারা: আয়াত ৮৫)।
নাজরানবাসী মুবাহালার ঘটনায় প্রমাণিত বিষয়াবলিতে প্রমাণিত একটি বিষয় হলো এই যে, কোনো কাফের যদি মৌখিকভাবে হযরত মুহাম্মদ সা:-এর নবুওয়াতকে স্বীকার করে, তবে তাতেই সে ইসলামে প্রবিষ্ট বলে গণ্য হবে না, যতক্ষণ না সে ইসলামের আহকামকে জরুরিভাবে গ্রহণ করে। ফাতহুল বারী: খন্ড ৮, পৃ. ১১৯)। সুতরাং আহলে কিবলার যে ব্যক্তি জগতের অবিনশ্বরতা, হাশর-নাশরের অসম্ভাব্যতা ইত্যাদি বিশ্বাস রেখে সারা জীবন আনুগত্যের ওপর অতিবাহিত করে; তবে তার কাফের হওয়ার ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই।
অনুরূপভাবে কুফরির প্রমাণ বহনকারী কোনো বিষয় তার দ্বারা প্রকাশ পেলে সে নির্ঘাত কাফের বলে পর্যবসিত হবে। (শরহুল মাকাসিদ: খন্ড ৩, পৃ. ৪৬১)। জানা আবশ্যক যে, আহলে কিবলা বলতে তাদেরকেই বোঝায়, যারা জরুরিয়াতে দ্বীন (দ্বীনের অত্যাবশ্যকীয় স্বতঃসিদ্ধ পালনীয় বিষয়) যেমন জগতের নশ্বরতা, দৈহিকভাবে পুনরুত্থান, সব কুল্লি ও যুজয়ী (সামগ্রিক ও আংশিক বা বৃহৎ ও ক্ষুদ্র) বিষয় আল্লাহ অবগত আছেন এবং অনুরূপ মাসয়ালাসমূহের সত্যতার ব্যাপারে একমত।
সুতরাং যে ব্যক্তি সারা জীবন আনুগত্য ও ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত করল, কিন্তু বিশ্বাস করল যে, ইহজগৎ অবিনশ্বর বা হাশর অনুষ্ঠিত হবে না বা আল্লাহ পাক সামগ্রিক ও আংশিকভাবে সব বিষয় অবগত নন, তবে সে আহলুল কিবলা হিসেবে গণ্য হবে না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে, আহলুল কিবলা কোনো ব্যক্তির ওপর কুফরির হুকুম আরোপ করা যাবে না। এ কথার অর্থ হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত তার থেকে কোনো কুফরি নিদর্শন প্রকাশিত না হয় অথবা কুফরি বিষয় সংঘটিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে কাফের বলা যাবে না। সুতরাং কুফরির নিদর্শন প্রকাশ পেলে বা কুফরি কর্ম সংঘটিত হলে তাকে কাফের বলতে কোনো বাধা নেই। (শরহে ফিকহে আকবার: পৃ. ১৫৪)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন