কাশ্মীর উপত্যকায় ভারত-পাকিস্তানের মুখোমুখি যুদ্ধংদেহি অবস্থানের মধ্যেও পাকিস্তানের পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বক্তব্যে এক প্রকার শান্তির পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। ধৃত ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে শুক্রবার সসম্মানে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেয়ার অনেকটা অপ্রত্যাশিত ঘোষণার মধ্য দিয়ে পাক প্রধানমন্ত্রী এই শান্তির সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছেন। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গি হামলায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনীর ৪৪ জন সদস্য নিহত হওয়ার পর এই হামলার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে জঙ্গি গোষ্ঠি জইশ-ই মোহাম্মদ ও পাকিস্তানের উপর দোষারোপ করা হয়। সেই থেকে ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের হুমকি অব্যাহত থাকলেও পাকিস্তান শুরু থেকেই জঙ্গি হামলায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার প্রমান চাওয়ার পাশাপাশি যে হামলার জবাব দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দুই পারমাণবিক পরাশক্তি প্রতিবেশী দেশের চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি কনভেনশনাল ওয়ার থেকে পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, এমন আশঙ্কায় চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যুদ্ধ নয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। এসব আহ্বান উপেক্ষা করেই ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় বিমান বাহিনী মিরেজ-২০০০ বিমান নিয়ে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বালাকোট এলাকায় হামলা চালায়। এই হামলায় ভারতের পক্ষ থেকে জঙ্গি আস্তানা ধ্বংসের দাবি করা হলেও নিরপেক্ষ রিপোর্টে এবং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ধ্বংসাত্মক বা হতাহতের দাবিকে নাকচ করা হয়েছে। উপরন্তু, পাক বিমান বাহিনীর পাল্টা হামলায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর অন্তত দুটি বিমান এবং একটি হেলিকপ্টার ধ্বংসের খবর পাওয়া যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, পাক বাহিনীর হাতে আটক ধ্বংসপ্রাপ্ত ভারতীয় যুদ্ধবিমানের পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে নিয়ে বেড়ে ওঠা টান টান উত্তেজনায় হঠাৎই শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী।
যুদ্ধ নয় শান্তির আহ্বান ও সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবে অভিনন্দনকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাদের এই সিদ্ধান্তকে যেন ভারত দুর্বলতা হিসেবে মনে না করে সে বিষয়েও সতর্ক করে দিয়েছেন। অভিনন্দনকে মুক্তি দেয়ার এই পাকিস্তানী সিদ্ধান্তকে ভারত স্বাগত জানিয়েছে। বিশেষত ভারতের নাগরিক সমাজের মধ্যে শান্তির সপক্ষে একটি যুদ্ধ বিরোধী জনমত গড়ে উঠতে শুরু করেছে। পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার সাথে সাথেই পাকিস্তানকে দায়ী করে একটি যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য ভারতের বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে একে ভোটে জেতার জন্য নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে অভিহিত করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস নেতা মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় জওয়ানদের রক্ত নিয়ে রাজনীতি না করার আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত-পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এবং দৃশ্যত বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কেউই যুদ্ধ চায় না। তবে প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য ইসরাইলিরা পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন বলে দাবি করেছেন। বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই দাবি করেছেন রবার্ট ফিস্ক। ভারতের সাথে ইসরাইলের সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে। তাঁর মতে, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ভারতের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে অর্থনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে ইসরাইল। তবে নিরপেক্ষ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ কোনো দেশের জন্যই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনবে না। কাশ্মীর ইস্যুতে দুই দেশ গত ৭০ বছরে দুইবার সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমেই কেবল কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হতে পারে।
সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের মতো ইস্যু এখন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা ও ইস্যু। কাশ্মীরে আত্মঘাতী হামলার দায় সরাসরি পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে যুদ্ধের উন্মাদনা ছড়ানো এবং বিমান হামলার পরিকল্পনাকে অনেক ভারতীয়ও সমর্থন করছে না। ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয় আখ্যা দিয়ে কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা অথবা পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক মীমাংসার ক্ষেত্রে ভারতের অনাগ্রহ এই ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধানে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কাশ্মীর ইস্যুকে ঘিরে গত ৭০ বছর ধরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এর ফলে পুরো উপমহাদেশে এক ধরনের আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা, অনাস্থা ও বৈরী পরিবেশ জিইয়ে রাখা হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে কাশ্মীর উপত্যকার বাসিন্দারা ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে চরম লাঞ্ছনা ও বিচারহীন হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে। পুলওয়ামা হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাকে কেউ সমর্থন করতে পারে না। তবে এমন ঘটনার পেছনের রাজনৈতিক-সামরিক তৎপরতাকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। সাম্প্রতিক বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ সাক্ষী, যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো সমাধান নেই। শুধু পুলওয়ামা হত্যাকান্ড নয়, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত নিরাপত্তা, কাশ্মীর ইস্যুসহ আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কমপ্রিহেনসিভ ডিসকাশন প্রয়োজন। ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের মনে রাখতে হবে, জনবহুল এই অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্য কবলিত। পারমাণবিক বোমা দিয়ে কাশ্মীর বা অন্য কোনো অঞ্চলের নিরাপত্তা, মানবাধিকার রক্ষা করা সম্ভব নয়। যুদ্ধের উস্কানি বা সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের ঘৃণ্য কৌশল পরিহার করতে হবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যে শান্তি ও সদিচ্ছার বার্তা দিয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীও প্রতিত্তোরে অনুরূপ সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবেন, এই প্রত্যাশা এ অঞ্চলের সব শান্তিকামী মানুষের। একটি চরম উত্তেজনাকর মুহূর্তে সংযত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্যের পাশাপাশি ভারতীয় পাইলটকে ফেরত দিয়ে চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য আমরা পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ধন্যবাদ জানাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন