তিন
আর এ ধরনের তাকওয়া ভিত্তিক রাষ্ট্রের উন্নয়নকল্পে আল্লাহ আসমান ও জমিনের দুয়ারসমূহ খুলে দেন। আল্লাহ বলেন, “লোকালয়ের মানুষগুলো যদি ঈমান আনতো ও তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করতো তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। সুতরাং তাদের কর্মকাÐের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম।
এ ধরনের তাকওয়া সম্পন্ন জনগোষ্ঠি নিয়ে যে সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠবে, সেটিই হবে আল-কুরআনের সমাজ, ইসলামী সমাজ ও আল্লাহর পছন্দের সমাজ। এ সমাজের প্রতিটি লোক ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর কাছে সম্মানিত হবেন। দুর্নীতির মূলোচ্ছেদে পৃথিবীর কোন জীবন ব্যবস্থাই সম্পূর্ণরূপে সফল হতে পারে নি; যেমন পেরেছে ইসলাম। তাই ইসলামের ঈড়ফব ড়ভ বঃযরপং গ্রহণ করতে হবে। ইসলামের অর্থনীতির জন্য, রাজনীতির জন্য, ব্যবসার জন্য, জীবনের সর্বক্ষেত্রের জন্যই রয়েছে ঈড়ফব ড়ভ বঃযরপং. বিশেষ করে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থায়, রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে। মানুষের মজ্জাগত অভ্যাসকে পরিবর্তন করার জন্য ইসলামের শাশ্বত বিধান ও পদ্ধতির অনুসরণ একান্ত প্রয়োজন। দুর্নীতি একটি মজ্জাগত পদ্ধতি। দুর্নীতির মধ্যে ব্যক্তি স্বার্থ নিহিত রয়েছে। কিন্তু খারাপ দিকটি ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে বেশী। সুতরাং দুর্নীতি সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। এ জন্য ব্যাপক প্রচার ব্যাপক প্রপাগাণ্ডা চালাতে হবে। আল্লাহ মদ সম্পর্কে তাঁর চূড়ান্ত মতামত জানালেন, “হে মুমিনগণ! মদ শয়তানী কাজ। সুতরাং তা বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” একইভাবে দুর্নীতি একটি শয়তানী কাজ। সুতরাং তা বর্জনীয়। আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। কেউ শয়তানের পদাংক অনুসরণ করলে শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়।” আর এ কথা তো বলাই বাহুল্য যে, দুর্নীতি মন্দ কাজের অন্যতম। আল্লাহ বলেছেন, “যে সব লোক আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের শান্তি হচ্ছে, তাদেরকে হত্যা করতে হবে কিংবা শূলিবিদ্ধ করা হবে অথবা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে, অথবা তাদের নির্বাসিত করা হবে।” সাধারণ আইনে অপরাধ সংক্রান্ত সকল শাস্তিকেই ‘দণ্ডবিধি’ নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু ইসলামের শাস্তি আইনগুলো একটু কঠিন মনে হলেও প্রতিটি শাস্তির আলাদা আলাদা বিধান রয়েছে। ‘অপরাধ’ বলতে শরীয়তের এমন আদেশ ও নিষেধ বুঝায় যা লঙ্ঘন করলে হদ্দ বা তা’যীর প্রযোজ্য হয়। দুর্নীতি একটি অপরাধ, যে সম্পর্কে আল্লাহ হদ্দ (বিধিবদ্ধ শাস্তি) অথবা তা’যীর (দন্ডবিধি) দ্বারা হুমকি প্রদান করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ এবং পরকালে জাহান্নামের শাস্তির ওয়াদা করা হয়েছে। শাস্তির মাত্রার দিক থেকে অপরাধ তিন প্রকার: যেসব অপরাধের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে শাস্তি নির্ধারিত। যেমন: যিনা (ব্যভিচার), যিনা এর মিথ্যা অপবাদ (কায্ফ), চুরি (সারাকা), ডাকাতি (কাতউত তারীক), মাদক গ্রহণ (শুরবুল খাম্র) এবং ইসলাম ধর্ম ত্যাগ (ইরতিদাদ); যেসব অপরাধের জন্য কিসাস (মৃত্যুদণ্ড বা অঙ্গহানী) অথবা দিয়াত (রক্তপণ) নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন: ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হত্যা এর অন্তর্ভূক্ত এবং আল্লাহ বা মানুষের অধিকার সংশ্লিষ্ট যে সব অপরাধের জন্য শরীয়ত নির্দিষ্ট কোন শাস্তি কিংবা কাফ্ফারা নির্ধারণ করে দেয়নি সে সব অপরাধের শাস্তিকে তা’যীর (অনির্ধারিত শাস্তি) বলে।
তা’যীর পর্যায়ের অপরাধগুলোর মধ্যে দুর্নীতিসমূহ অন্যতম। এর উদ্দেশ্যে হচ্ছে, অন্যায় অপকর্ম থেকে অপরাধীকে বিরত রাখা। মানুষের মৌলিক বিষয়সমূহের সংরক্ষণ; সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন এবং অপরাধীকে পবিত্রকরণ। হুদুদ ও কিসাস জাতীয় কয়েকটি অপরাধ ছাড়া অবশিষ্ট সব অপরাধই তা’যীরী অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। যেহেতু দুর্নীতি তা’যীরের পর্যায়ের একটি অপরাধ সেহেতু এর শাস্তিও তা’যীরের অনুরূপ। তা’যীরা শাস্তি হচ্ছে: অপরাধের ভিন্নতার কারণে শাস্তির ভিন্নতা হবে। ইসলামী ফৌজদারী আইনের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী তা’যীরের আওতায় কাউকে হত্যা করা সমীচীন নয়। আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা এমন কাউকে বিনা অধিকারে হত্যা করো না, যার হত্যা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন”। ইমাম ইবনু তাইমিয়া র. বলেন, “বিপর্যয় সৃষ্টিকারী আক্রমণকারীর মতই। যদি আক্রমণকারী হত্যা ছাড়া অবদমিত না হয়, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে”। বেত্রাঘাত করা, বন্দী করা, নির্বাসন বা দেশ থেকে বহিষ্কার, শূলে চড়ানো, উপদেশ বা তিরষ্কার কিংবা ধমকদান, অপমান করা, বয়কট, আদালতে তলব, চাকুরীচ্যুতকরণ, সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে রেদয়া, কাজ কারবারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, উপায় উপকরণ ও সম্পদ নষ্ট করা, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং আর্থিক দণ্ড আরোপ করা। আল্লাহ বলেছেন, “আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অবৈধ পদ্ধতিতে ভক্ষণ করো না এবং নানা কারণে দুর্নীতি হতে পারে, কোন একক উপাদানকে দুর্নীতির কারণ বলে উল্লেখ করা যায় না। নিম্নে এর কারণগুলো বর্ণনা করা হলো- মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক পরিবেশ থেকে নৈতিক মূল্যবোধের প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। যে জাতি ইসলামী শিক্ষায় তথা ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, যাদের তাকওয়া ও আখিরাতে জবাবদিহিতার বালাই নেই সে সমাজে দুর্নীতি সহজেই প্রবেশ করে। তার সাথে বাড়তে থাকে অনৈতিক কর্ম, দেখা দেয় হানাহানি, মারামারি ইত্যাকার বিষয়।
সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের কারণে সামাজিক মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটছে। সময় সময় সামাজিক অবস্থার প্রচণ্ড পরিবর্তনের চাপে মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তার ভাব জন্মায়। এরূপ অনিশ্চয়তা হতে রক্ষার জন্য মানুষ বৈধ বা অবৈধ যে কোন উপায়েই হোক না কেন টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ অর্জন করতে চায়। ফলে দুর্নীতির জন্ম হয়। আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায়, সারা পৃথিবীকেই দুর্নীতি গ্রাস করে ফেলেছে। কিন্তু নীতি বহির্ভূত সকল প্রকার কাজ-কর্ম, আচার-ব্যবহার ও কথা-বার্তা সবই এর আওতাভূক্ত। যেহেতু আয়-উপার্জন জীবনের বিশাল অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে যৌক্তিক কারণেই বড় করে দেখা হয়। দুর্নীতি ব্যাপক বিস্তৃত একটি পরিভাষা। নীতি হিসেবে আমরা যদি ইসলামকে বেছে নেই তবে দুর্নীতিরও একটি সংজ্ঞা প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন