দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকর্ম কী ছিল তা সংস্থাটির নামই বলে দিচ্ছে। দুর্নীতি দমন, দুর্নীতি প্রতিরোধ। অথচ তিনি দেশ ও জাতির কাছে শপথবদ্ধ সেই ‘আসল কাজ’ পাশ কাটিয়ে কিংবা এড়িয়ে গেছেন। নির্দোষ পাটকল শ্রমিক ‘জাহালম কান্ড’র মতো অনেক কান্ড-কারখানার মাধ্যমে অঘটন-ঘটন পটিয়সী হিসেবে নিজেকে ‘স্মরণীয় (?)’ রেখে অবশেষে বিদায় হলেন। অসহায়-নিরীহ অনেক মানুষকে তিনি দমন-হয়রানি-নাজেহাল করেই ছেড়েছেন।
শুধুই তাই নয়, পদের ঝাঁঝ প্রমাণ করতে গিয়ে নিছক ইগো-অহমিকা আর দম্ভের বশে দেশ, জাতি ও সমাজের সর্বজন সম্মানীয় নাগরিকদের বিনাদোষে ‘এক হাত’ নেয়ার অপচেষ্টা করেছেন। অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তব যে, জাতীয় পর্যায়ের নামিদামি, সৎ, আদর্শবান, পেশাদার, প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ মান্যগণ্য সম্পাদক, মিডিয়া ব্যক্তিত্বগণ পর্যন্ত তার অকারণ যাতনা-বিড়ম্বনার শিকার হন। যাদের সাংবাদিক-বান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাদর করে আসছেন।
দেশের বিবেকবান সুশীল সমাজ, বিশিষ্ট নাগরকিমহলে স্বভাবতই যুক্তিসঙ্গত কারণেই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ওইসব কান্ডকীর্তির উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক জিজ্ঞাসা আর কৌত‚হল। গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও নাগরিকবৃন্দ বক্তব্য-মন্তব্য ও অভিমত দিয়েছেন উপরোক্ত প্রসঙ্গে।
তারা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ইকবাল মাহমুদ ছুটেছেন চুনোপুটিদের পেছনে। এরজন্য দুদক-এর জনবল, রাষ্ট্রীয় অর্থ এবং সময় অহেতুক অপচয় করেছেন। কিন্তু রাঘব-বোয়াল, রুই-কাতলারা কাড়ি কাড়ি অর্থ-সম্পদ লুটপাট, ব্যাংকের অর্থ-আমানত তছরুপ, বিদেশে পাচার, সেকেন্ড হোম, ‘বেগম পাড়া’ ইত্যাদি আইনত ধর্তব্য ও দন্ডনীয় অপরাধমূলক অপকর্ম করেও অনায়াসেই পার পেয়ে গেছে। গেল পাঁচ বছরে এটি ওপেন সিক্রেট। যার নেপথ্য রহস্য কী তাও সহজেই অনুমেয়। প্রয়োজন নিরপেক্ষ তদন্তের।
অন্যদিকে রাঘব-বোয়ালদের ‘ছাড়বো না’, ‘পার পাবে না’, ‘জিরো টলারেন্স’ ইত্যাদি কানসুখ কথাবার্তায় হম্বিতম্বি আর আস্ফালন দেখিয়েছেন সেই তিনি। যা অসার তর্জন-গর্জনেই শেষ। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারা এবং এক ধরনের অসন্তোষ নিয়ে বিদায় নিচ্ছেন বলে গত সোমবার সাংবাদিকদের সামনে স্বীকারও করেছেন ইকবাল মাহমুদ। তাবৎ ব্যর্থতার গ্লানি নিয়েই বিদায় হচ্ছেন। বিদায়বেলায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের মুখোমুখি হওয়ার জন্যও তিনি আদিষ্ট হন।
স্বাধীন সংস্থা দুদক-কে কেন দন্ত-নখরহীন একটি ঠুনকো, অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করলেন তিনি? ইকবাল মাহমুদ রাঘব-বোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কেন ব্যর্থ? দুদক-এর দক্ষ, নিষ্ঠাবান, সৎ ও সৃজনশীল শীর্ষ ও মাঝারি পর্যায়ের কোনো কোনো কর্মকর্তা তার ‘ইচ্ছে-পূরণের হাতিয়ার’ হিসেবে অপছন্দ হওয়ায় তার স্বেচ্ছাচারিতার রোষানলে পড়েন। বিশিষ্ট নাগরকিমহল স্বভাবতই এসব প্রশ্নে জাতীয় স্বার্থেই জাতির কাছে সুস্পষ্ট জবাবদিহিতা চান। উঠেছে স্বচ্ছতার প্রশ্নও। যাতে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানে নতুন করে ইকবাল মাহমুদ এপিসোডের ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, দেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার রোধে দুদকের ভূমিকা কাক্সিক্ষত নয়। সরকার দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। নিজ দলেও দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছেন।
অথচ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানের তার বিদায়ী শীর্ষ কর্তাব্যক্তির ভ‚মিকা নিয়েই জনমনে নানা প্রশ্ন। বড় বড় দুর্নীতিবাজ ছাড় ও পার পায়। আর চুনোপুটিদের নিয়েই দুদক তার সময় ব্যয় করে। সম্মানিতদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। এতে করে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি জনগণ আস্থাহীন। তাতে উৎসাহিত হচ্ছে দুর্নীতিবাজরা। দুর্নীতি আরও বাড়ছে। জনমনে তৈরি হচ্ছে হতাশা।
একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বিদায়ী দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ কেন রাঘব-বোয়ালদের বিরুদ্ধে তার অঙ্গীকার সত্তে¡ও ব্যবস্থা নিতে পারেননি তা বোধগম্য নয়। অথচ তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন (গত সোমবার) এক্ষেত্রে তার করণীয় ও দায়িত্ব পালনে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রকম চাপের সম্মুখীন হননি। দুদক একটি দন্ত-নখরহীন বাঘে পরিণত হয়েছে। প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, ২০০৭-০৮ সালে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করতে এবং দুর্নীতি দমনে কার্যকর ভ‚মিকা পালনে যে আইন-বিধির অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছিল, সেটি ২০০৯ সালে সংসদে আইন হিসেবে পাস করার প্রক্রিয়াটি তখন সম্পন্ন হয়নি। এখন তা করা প্রয়োজন। তাহলেই দুদক কার্যকর প্রতিষ্ঠান হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার প্রতিরোধ করাই দুদকের কাজ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণে এ প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থ। সাম্প্রতিক সময়ে তারা নিজেরাই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন সুস্পষ্ট অভিযোগ আছে। অনেক দুর্নীবাজকে তারা দায়মুুুুক্তি দিয়েছে।
দুর্নীতিবাজ রাঘব-বোয়ালদের পুর্নবাসন করেছে। বড় বড় দুর্নীতিবাজ বাদ দিয়ে চুনোপুটিদের পিছু ছুটেছে দুদক। দুর্নীতি দমন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের কঠোর হতে দেখা যায় না। নতুন কমিশন এসব বিষয় সামনে রেখেই নতুন উদ্যোমে তাদের পথচলা শুরু করবে-এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
বিশিষ্ট ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট আহসানুল হক হেনা বলেন, দুদকের তৎপরতায় দুর্নীতি কমেছে এটা মানুষ বিশ্বাস করে না। বাস্তবতা হলো দেশে দুর্নীতি, লুটপাট আর অর্থপাচার বেড়েই চলেছে। কারণ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পারেনি দুদক। তাদের মধ্যে কোন ভয়ের পরিবেশও তৈরি করতে পারেনি। বড় কোন দুর্নীতিবাজের দৃষ্টান্তমূলক কোন সাজারও নজির নেই। আমলাতন্ত্রের কাছে তাদের অসহায় দেখা যাচ্ছে। অথচ তারা একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান।
মানবাধিকার সংগঠক ও চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দেশে অনিয়ম, দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। জনগণ মনে করে দুদক তাদের যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। দুদক বড় বড় দুর্নীতিবাজকে এড়িয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতিবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যা দেশে ন্যায়-নীতি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন