অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে যে প্রচারনা চলছে, তা নিয়ে জনমনে এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পরিসংখ্যানে এক ধরনের গড়মিলের কথা খোদ সরকারের মন্ত্রী-আমলারাও স্বীকার করেছেন। যেমন, ভরা মৌসুমে ভারত থেকে চাল আমদানির বিতর্ক যখন সামনে চলে এসেছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং ভারত থেকে খাদ্য আমদানির বাস্তবতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এ বিষয়ে পরিসংখ্যানগত গড়মিলের বিষয়টি তুলে ধরেন। কী সাংঘাতিক ব্যাপার, পরিসংখ্যানের ভুল হিসেব শুনিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বা মধ্য আয়ের দেশে পরিনত করে দেয়ার মত তথ্য ছড়িয়ে ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের সুযোগ নিলেও বাস্তবতা যে ভিন্ন হতে পারে তা আবারো প্রমানিত হলো। সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালের শেষে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০.৫ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সানেম (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং) প্রকাশিত জরিপে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের গড় হার ৪২ শতাংশ বলে জানা গেছে। এক বছরের ব্যবধানের দেশে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণের বেশি! স্বাভাবিকভাবেই এর জন্য গত বছরের করোনা মহামারীর কারণে সংঘটিত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা বলা হচ্ছে। করোনাকালীন বাস্তবতায় সারবিশ্বেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এক জরিপে দেখা গেছে, করোনার কারণে বাংলাদেশে আয় কমেছে শতকরা ৭০ ভাগ মানুষের। এর ফলে নতুন করে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে দারিদ্র্য, উন্নয়ন ও স্বাবলম্বী তার প্রকৃত চিত্র কি উঠে আসছে? এক বছরের ব্যবধানে শুধুমাত্র করোনার কারণে এমন অর্থনৈতিক বিপর্যয় কি প্রকৃত সত্য নির্দেশ করে? নাকি এখানেও গড়মিল-গোজামিলের হিসাব নিকাশের কারসাজি রয়েছে। মাঠের বাস্তবতা এবং সরকারের উন্নয়নের দাবির মধ্যকার পাথর্ক্য মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতার জন্ম দিচ্ছে।
স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকেও এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে প্রথম মূল্যায়ণে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় স্থান লাভের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়ার পর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতারা বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। তখন বলা হচ্ছিল, ২০২২ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে। জাতিসংঘের সর্বশেষ মূল্যায়ন অনুসারে, মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে মান অর্জন করায় আগামী ৫ বছরের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা নিজেদের কৃতিত্ব ও জাহির করতে কখনোই পিছ পা হননা। এ ক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা দেশকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পদ্মাসেতু, ঢাকার মেট্ট্রোরেল, ফ্লাইওভার, কর্ণফুলী টানেল, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা ইত্যাদি অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফিরিস্তি হাজির করে থাকেন। নানাভাবে লাখ লাখ মানুষ চাকুরি ও কর্মসংস্থান হারানো, বেশিরভাগ মানুষের আয় কমে গিয়ে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাওয়া, দেশ থেকে লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার বাস্তবতা সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়ে উন্নয়নের বুলি আওড়াতেই তারা যেন বেশি ব্যস্ত। অথচ এসব সমস্যা ঠিকমত মোকাবেলা করতে পারলে দেশকে আরো আগেই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করা সম্ভব ছিল। সেই ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে ৩০৯ কোটি টাকা এনেছিলাম, চাটার দল সব খেয়ে ফেলেছে, দেশের মানুষ কিছু পায়নি। সবাই পেয়েছে সোনার খনি তিনি পেয়েছেন চোরের খনি। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলা যায় না। আগের লুটেরা ও তাদের উত্তরসুরীরা এখন ডাকাত-দুর্বৃত্তে পরিনত হয়েছে। আগের দুর্বৃত্তরা অস্ত্র দিয়ে ব্যাংক ডাকাতি করত এখনকার দুর্বৃত্তরা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে, কলমের খোঁচায় এবং ব্যাংকের সুইফ্ট কোড হ্যাক করে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে দিয়ে বিদেশে সম্পদ পাচার করে রাজপ্রাসাদ গড়ে তুলছে। দেশে গণতন্ত্রহীনতার সুযোগে, বিরাজনীতিকরণের সুযোগে, রাষ্ট্রের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করে দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশে এই লুণ্ঠনের অপসংস্কৃতি তৈরী করেছে সংঘবদ্ধ চক্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা বিশ্বে ডিজিটাল চুরির ইতিহাসে এক অনন্য নজির। কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ এভাবে তসরুফ হওয়ার উদাহরণ আমাদের জানা নেই। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, রির্জাভের সুইফ্ট কোড হ্যাক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রির্জাভ থেকে শত মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেয়ার পর কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও বিদেশি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এমন একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা কেউ জানতে পারেনি। কেন বা কি উদ্দেশ্যে এমন একটি ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি। যেখানে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিরোধিদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ২ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করে বছর ধরে জেলে রাখা হয়, সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা লোপাটের জন্য দায়ী গর্ভনর ও কর্মকর্তাদের পদত্যাগ এবং বদলি করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত ১৫-২০ দিনের মধ্যে রির্জাভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের ওয়াদা করেছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি ২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল রির্জাভ চুরি সম্পর্কে একটি অন্তবর্তিকালীন প্রতিবেদন এবং ৩০ মে পুর্নাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও গত ৫ বছরেও সে প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। গত ৫ বছরে চুরি হওয়া টাকার মধ্যে শ্রীলঙ্কা থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার ফেরত আসলেও ফিলিপাইন থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার ফেরত আনতে পারেনি সরকার। এমনকি এই ঘটনার জন্য সন্দেহজনক দায়ী ব্যক্তিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দাপটের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি উপদেষ্টা, ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা রিজার্ভ চুরির দায় এড়াতে পারেন না। অথচ রিজার্ভ চুরির পর পুরো সিস্টেম থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুছে ফেলার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ শাখায় রহস্যজনক আগুন লাগার ঘটনাও ঘটেছে। সে বিষয়েও নিরপেক্ষ কোনো তদন্ত রিপোর্ট জানা যায়নি। উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির আগে সরকারি ব্যাংক থেকে আরো অনেক বড় অংকের টাকা লোপাট হয়েছে। সেসব জাল-জালিয়াতির সাথে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো জবাবদিহিতা বা আইনগত ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
গত এক দশকে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এক ধরণের সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধন ঘটেছে, যেখানে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ১০ ভাগের বেশি নয়, সেখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের উচ্চ আসন দেয়ার চিত্র অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বড় উদাহরণ। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা থেকে শুরু করে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভারতীয় আইটি উপদেষ্টা রাকেশ আস্তানা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর শিতাংসু কুমার সুর চৌধুরী (এস কে সুর) থেকে শুরু করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে বিদেশে পাচার করে সরে পড়ার মত ঘটনাবলী বাংলাদেশের বিভিন্ন ইনস্টিটিউশনে থাকা এসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তি বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রদায়িক উদারতা ও সম্প্রীতির মনোভাবের প্রতি আস্থা ও বিশ্বস্ততার অমর্যাদার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। দেশের ইতিহাসে বড় বড় অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারিগুলোর সাথে কোনো না কোনোভাবে তারা জড়িয়ে পড়েছেন। যেখানে দেশে বিনিয়োগ অর্থনীতিতে চরম মন্দা চলছে, সেখানে পিকে হালদার ও সহযোগীরা সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করে ধরা পড়ার পরও কিভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো? এটাই সবচে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেলে এর নেপথ্যে একটি বড়সড় সংঘবদ্ধ চক্রের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। বিচার বিভাগ, দুর্নীতিদমন কমিশন, পুলিশ বিভাগ ও ইমিগ্রেশন থেকে শুরু করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে এই চক্রের হাত বিস্তৃত না থাকলে এভাবে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। গত ৫০ বছর ধরে দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা এভাবেই লুণ্ঠিত হয়ে আসছে। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো দুর্নীতি বিরোধী অভিযান, বিশেষভাবে অভিযুক্ত কিছু ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে দুর্নীতির সর্বব্যাপী জঞ্জাল সাফ করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ, সুশাসন এবং দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠান ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করা।
এ সপ্তাহে ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানি সিরিজ প্রতিবেদনে দুদকের দুর্নীতি-অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠে এসেছে। দেশের সামগ্রিক বাস্তবতায় বড় বড় রাঘব বোয়ালরা হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে একটি দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীর একটি খন্ডচিত্র এটি। গণপুর্ত অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের মহাপরিচালক আশরাফুল আলম ও তার স্ত্রীর দুর্নীতি ও জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিতে ২০ কোটি টাকার নেপথ্য লেনদেনের অভিযোগ উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে দুদকের সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্টের একটি ভার্চুয়াল বেঞ্চের দুই বিচারক। দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদসহ দুই কমিশনারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সরকার তাদের স্থলাভিষিক্ত করতে দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহকে এবং সাবেক মহানগর দায়রা জজ মো: জহুরুল হককে কমিশনার পদের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিদায়ী দুদক চেয়ারম্যান শেষ মুহুর্তে এসে নিজের কাজে স্বচ্ছতার প্রশ্নে সরাসরি অভিযুক্ত হয়ে পড়েছেন। শুধু এই অভিযোগেই নয়, দুর্নীতি দমনে দুদকের সামগ্রিক কর্মকান্ডের চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং কথিত সব দুর্নীতির অভিযোগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আদালতকেই ভূমিকা নিতে হবে। দেশের দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র সরকারি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিই যদি কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে জাতিকে বের করে আনার জাতীয় আকাক্সক্ষা পূরণে আর কোনো পথই খোলা থাকে না। এ ক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকেই পরিপুরক ভূমিকা পালন করতে হবে।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ৫০ বছর ধরে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সম্ভাবনা নি:শেষ করে দেয়া হচ্ছে। আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, বৈষম্যহীন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। যতই দিন যাচ্ছে মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে। ধনী আরো ধনী, গরিব আরো গরিব হচ্ছে। অবৈধভাবে সম্পদের পুঞ্জি সমাজে অন্যায় অবিচার ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। আর পুঞ্জিভুত সম্পদ যদি বিদেশে পাচার করে দেয়া হয় তাহলে এক সময় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদন্ডই ভেঙ্গে পড়ে। আমরা এখন এ ধরণের সমাজবাস্তবতার সম্মুখীন। দেশে আইন আছে তার প্রয়োগ নেই। প্রতিষ্ঠান আছে তার সদিচ্ছা ও সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। দুর্নীতি দমন কমিশন যদি অবৈধ সম্পদের মালিক প্রভাবশালীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাহলে এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা, লক্ষ্য ও সক্ষমতা থাকে না। দুদকের কর্মকর্তারাই যদি দুর্নীতিতে আক্রান্ত হয়ে দুর্নীতিবাজদের সাথে আপস করে অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন, তাহলে দুর্নীতি ও শোষনমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের আর কোনো উপায় থাকে না। দুদক চেয়ারম্যান ৫ বছর ধরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের আপীল বিভাগের বিচারপতির সমান সুযোগ সুবিধাসহ কোটি কোটি টাকার বাজেট ও রাষ্ট্রীয় সম্মান ও নিরাপত্তা ভোগ করেছেন। নিয়োগের আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ ও আইনসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি শপথ গ্রহণ করেছিলেন। তার এই শপথ যদি ভঙ্গ হয়ে থাকে, তিনি বা তার কমিশন যদি ব্যর্থ হয়, তারা নিজেরাই যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দুর্নীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন তার জন্য তাদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন হওয়া প্রয়োজন। নতুন দুদক চেয়ারম্যান এবং নতুন একজন কমিশনার দায়িত্ব গ্রহণ করছেন। তাদের অতীতের ট্র্যাক রেকর্ড কি তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। সরকারের মন্ত্রী-আমলা, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি থেকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যন্ত যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক, সেখানে গতানুগতিক দলবাজ, ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের দিয়ে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়।
জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে আব্দুল হাই বাচ্চু, পিকে হালদারের মত ব্যক্তিরা কিভাবে পালিয়ে বাঁচতে পারে, কেন বছরের পর বছর ধরে মামলার তদন্ত শেষ হয়না, বিচার হয়না তার মূল্যায়ণ করে জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদায়ী দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের সম্পদের হিসাবসহ তাদের যেকোনো দুর্নীতিসম্পৃক্ততার তথ্য যাচাই করে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। একইভাবে নতুন দুদক চেয়ারম্যান এবং কমিশনারদের সম্পদের স্বচ্ছ হিসাব এবং দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকে তাদের দায়িত্বপূর্ণ কর্মকান্ডের উপর প্রখর নজরদারি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে দক্ষ জনবল বৃদ্ধি, কাজের স্বচ্ছতা, সক্ষমতা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করার উদ্যোগই দুদক চেয়ারম্যানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে আপস করার কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত করা দুদকের সাংবিধানিক দায়িত্ব। নিয়োগ, পদায়ণ, অর্থায়ণসহ সরকারের কোনো মহলের আজ্ঞাবহ হওয়ার যে কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা থেকে দুদককে মুক্ত করতে হবে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন