পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় গ্রুপগুলোর হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র মজুত বাড়ছে। গত দেড় বছরে সশস্ত্র উপজাতিয় গ্রুপগুলোর হাতে খুন হয়েছে প্রায় ৫০জন সাধারন পাহাড়ি ও বাঙালি। তিন পাবর্ত্য জেলা থেকে প্রতি বছর ৪০০ কোটি টাকার অধিক চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। চাঁদার বেশির ভাগ টাকা অস্ত্র কেনার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। জেএসএস ও ইউপিডিএফসহ পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক বিভিন্ন আঞ্চলিক দল ও গোষ্ঠীর ক্যাডারদের হাতে রকেট লঞ্চার, ১৪-এমএম, এম-১৬, এসকে-৩২, সেনেভা-৮১, এম-৪ ও এম-১-এর মতো ভয়াবহ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। টার্গেট কিলিং বেড়ে যাওয়ায় পার্বত্য এলাকায় সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে এখন চরম আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
সূত্র জানায়, প্রশিক্ষিত সশস্ত্র উপজাতিয় সংগঠনের ক্যাডারের হাতে প্রতিবেশি দেশগুলো থেকে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র পৌছে দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয় এদের কাছে রয়েছে সামরিক পোশাকের আদলে কমব্যাট পোশাক ও ওয়াকিটকিসহ নানা সরঞ্জাম। তিন হাজারের অধিক অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে উপজাতিয় সশস্ত্রগ্রুপগুলোর ক্যডারদের কাছে। সর্বশেষ গত ১৮ মার্চ সোমবার সন্ধ্যায় রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের ব্রাশফায়ারে ৮জন নিহত ও ১৪জন আহত হয়েছে। এর ১৪ ঘণ্টার মধ্যেই একই জেলার বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তংচঙ্গ্যাকে সকাল নয়টায় আলিখিয়ংয়ের তিনকোনিয়া পাড়া এলাকায় গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। আইন-শৃংখলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানাযায়, তিন পার্বত্য জেলায় কৃষি থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্য, চাকুরি, যানবাহন, ঠিকাদারি সব সেক্টর থেকেই আঞ্চলিক দলগুলো নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করে থাকে। তাদের এ চাঁদাবাজি পার্বত্য এলাকায় এখন ওপেন সিক্রেট।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিন জেলায় সশস্ত্র ক্যাডার ও সেমি-আর্মড ক্যাডারের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। জেএসএস ও ইউপিডিএফ বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন ও অপহরণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাহাড়ি বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা সম্ভব না হলে আরও রক্তপাতের আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় জেএসএস এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ইউপিডিএফের আধিপত্য রয়েছে। তবে নানিয়ারচরসহ কিছু কিছু স্থানে জেএসএস ও ইউপিডিএফের বিদ্রোহী গ্রুপগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠায় ওইসব স্থানে হানাহানি হচ্ছে। এসব হানাহানির অন্যতম কারণ চাঁদাবাজি। এক হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী বছরে প্রায় চারশ’ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে থাকে। এসবের ভাগাভাগি নিয়ে গ্রুপগুলোর মধ্যে বিরোধের জন্ম হচ্ছে।
সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্তের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো সীমান্ত চৌকি (বর্ডার আউটপোস্ট-বিওপি) নেই। ফলে সেখানে বাধাহীনভাবে অস্ত্র ঢুকতে পারে। তাছাড়া শান্তিচুক্তি সই করার পর চুক্তি বাস্তবায়নের শর্ত মোতাবেক বেশকিছু নিরাপত্তা ফাঁড়ি প্রত্যাহার করা হয়। শান্তিচুক্তির আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৫৫২টি নিরাপত্তা ফাঁড়ি ছিল। চুক্তির পর অনেকগুলো প্রত্যাহারের পর বর্তমানে সেখানে ২১৮টি নিরাপত্তা ফাঁড়ি রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ি সীমান্তে পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকায় উন্মুক্ত সীমান্তে বিওপি স্থাপন করা যাচ্ছে না। কেননা বিওপি স্থাপন করতে হলে তার নিরাপত্তার প্রয়োজনে যোগাযোগ জরুরি। বর্তমান অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন দুর্গম স্থানও রয়েছে, যেখানে কোনো সশস্ত্র হামলা হলে নিরাপত্তা বাহিনীর পৌঁছতে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ইউপিডিএফের সামরিক শাখার তিনটি কোম্পানি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, জাগুয়ার কোম্পানি (খাগড়াছড়ি), ড্রাগন কোম্পানি (রাঙ্গামাটি) ও ঈগল কোম্পানি (বাঘাইছড়ি)। এদের কোনো স্থায়ী সামরিক ক্যাম্প নেই। সবগুলোই ভ্রাম্যমাণ। এসব মারাত্মক অস্ত্রের বিপরীতে বাঙালিদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে বাঙালিরা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের সাথে হাত মেলাচ্ছে। সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের অস্ত্র বাহক হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া চাঁদা সংগ্রহ, সোর্স হিসেবে স্থানীয়দের ব্যবহার করা হচ্ছে।
ওই সূত্র আরো জানায়, সন্তু লারমার নের্তৃত্বাধীন জেএসএসের সাথে শান্তি চুক্তি হলেও বর্তমানে আধিপত্য বিস্তারের জেরে একটি সংগঠন থেকে চারটি সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে প্রসীত বিকাশ খীসা ও রবি শংকর চাকমার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হয়। পাহাড়ে নতুন করে শুরু হয় সন্তু ও প্রসীতের নেতৃত্বে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। এসময় থেকেই পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক চাঁদাবাজি, হত্যা ও অপহরণের পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে মাঝে মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হতে থাকে তারা। এতে প্রাণ হারায় বহু নেতাকর্মী। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১৮ বছরের মাথায় ইউপিডিএফ ভেঙ্গে যায়। গত ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রসীত-রবি’র নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করে বেরিয়ে এসে তপন জ্যোতি বর্মাকে আহ্বায়ক ও জলেয়া চাকমা তরুকে সদস্য সচিব করে গঠিত হয় ১১ সদস্যের ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দল। আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে ২০১৭ সালে তপন চাকমাসহ ৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন