শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা বিন্যাসে পুনর্ভাবনা জরুরি

মেহেদী হাসান পলাশ | প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এখানে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ হচ্ছে, শান্তিচুক্তিতে ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস স্থাপনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সেই সেনানিবাসগুলোর ফর্মেশনের কথা শান্তিচুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা নেই। এই ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস কীরূপে সেখানে অবস্থান করবে- ডিভিশন আকারে, ব্রিগেড আকারে না ব্যাটালিয়ন আকারে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। এই অপশনটি রাষ্ট্রের হাতে রয়ে গেছে। রাষ্ট্র প্রয়োজন মতো তা ব্যবহার করতে পারবে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন জেলা সদরে তিনটি ব্রিগেড রয়েছে। এর বাইরে খাগড়াছড়ির গুইমারায় আরেকটি ব্রিগেড রয়েছে। কাপ্তাই ব্রিগেডটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। শান্তিচুক্তির শর্ত পালনে গুইমারা ব্রিগেড দিঘীনালায় সরিয়ে নিলেও আলীকদম ও রুমাতে দুইটি নতুন ব্রিগেড প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে। তবে শান্তিচুক্তির মধ্যেই সমাধান খুঁজলে এ চুক্তির ঘ খন্ডের ১৭(ক) ধারা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এই ধারায় যেমন স্থায়ী সেনানিবাসের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয়নি। তেমনি অস্থায়ী সেনানিবাসের সংজ্ঞাও দেয়া নেই। অর্থাৎ অস্থায়ী সেনানিবাস বলতে ব্রিগেড, ব্যাটালিয়ন/জোন, সাবজোন, কোম্পানি স্থাপনা নাকি সেনা আউট পোস্ট বোঝানো হবে তার কিছুই চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এই ব্যাখ্যাটাও রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে এবং রাষ্ট্র চাইলে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে পারে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান ৪টি ব্রিগেডের মধ্যে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান ব্রিগেডে ৫ ব্যাটালিয়ন করে সৈন্য রয়েছে, গুইমারায় রয়েছে ৩ ব্যাটালিয়ন। সব মিলিয়ে ১৮ ব্যাটালিয়ন সৈন্য রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। একটি ব্যাটালিয়নে গড়ে ৭০০ করে সৈন্য ধরলে ১৮টি ব্যাটালিয়নে ১২-১৩ হাজার সৈন্য রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফর্মেশন অনুযায়ী ৩-৫টি ব্যাটিলিয়ন নিয়ে একটি ব্রিগেড গঠিত হয়। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬টি ব্রিগেড থাকলে সেখানে ১৮-৩০ ব্যাটালিয়ন সৈন্য থাকতেই হবে। ব্যাটালিয়নগুলো আবার গড়ে ওঠে কতকগুলো সাবজোনের সমষ্টিতে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এই জোন, সাবজোনগুলো কোথায়, কীভাবে অবস্থান করবে? শান্তিচুক্তিতে এ বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই।
শান্তিচুক্তির ঘ খন্ডের ১৭(ক) ধারায় আরো বলা হয়েছে, ‘আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে।’
উল্লিখিত বাক্যটি বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে বা জাতীয় অন্যান্য দরকারে রাষ্ট্র প্রয়োজনানুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের যেখানে যেখানে প্রয়োজন যে কোনো ফর্মেশনে সেনাবাহিনী রাখতে পারবে। এ ক্ষেত্রে ৪টি ব্রিগেড বা ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস বিবেচ্য নয়- রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন বিবেচ্য। আরো বিবেচ্য যে, এক্ষেত্রে নির্ধারিত কোনো সময়সীমাও রাখা হয়নি।
একই ধারায় আরো গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলা হয়েছে তাহলো শান্তিচুক্তিতে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার শর্ত বাস্তবায়িত হতে হবে ‘জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে...।’ অর্থাৎ চুক্তিতে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার ও সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার বিষয়টি শর্তহীন নয়। বরং এর সাথে ‘জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার’ শর্ত যুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ জনসংহতি সমিতির সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেই কেবল সেনাবাহিনী ফেরত আনার বিষয়টি বিবেচ্য হবে।
সন্তু লারমার ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনে দেয়া বক্তব্য ও ১৮ মার্চ বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উপর হামলার পর একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, জেএসএসের মূলের সামরিক শাখাও সম্পূর্ণরূপে অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি। বরং বর্তমানে চারটি পাহাড়ি সংগঠন প্রকাশ্য ও গুপ্ত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গুপ্ত বা গোপন শাখা আসলে তাদের সশস্ত্র সামরিক শাখা। যদিও প্রকাশ্যে তারা কখনই এই সামরিক শাখার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে না। প্রকৃতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বর্তমানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। চাঁদা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ নাগরিক দূরে থাক, সরকারি কর্মকর্তাদেরও বসবাস অসম্ভব। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনটি পাহাড়ি সংগঠনের নির্ধারিত চাঁদা দিতে না পারলে সেখানে বসবাস যে কারো জন্যই অসম্ভব। সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে সাধারণ ও শান্তিপ্রিয় পাহাড়িদের জিম্মি করে তাদের নির্দেশিত পথে পরিচালিত করতে বাধ্য করে।
সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পূর্বে নিরাপত্তা বাহিনী ১৬০৯টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে গ্রেনেড ৩৫৯টি, মর্টার ৭০টি, মাইন ১৩টি এবং অন্যান্য গোলাবারুদ সাড়ে ৪ লক্ষ। এই পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পরে ২০০৫ সাল থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ২৬৩০টি অস্ত্র ও ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৫৬৯টি বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। শান্তিচুক্তির পূর্বে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শান্তিবাহিনী কর্তৃক ২৩৮ জন উপজাতি, ১০৫৭ জন বাঙালি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৭৮ জন উপজাতি ও ৬৮৭ জন বাঙালি। অপহরণের শিকার হয়েছে ২৭৪ জন উপজাতি ও ৪৬১ জন বাঙালি।
একই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শান্তিচুক্তির পরে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শান্তিবাহিনী কর্তৃক ৪৪১ জন উপজাতি, ২৭১ জন বাঙালি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬৭২ জন উপজাতি ও ৮২৮ জন বাঙালি। অপহরণের শিকার হয়েছে ৯৯১ জন উপজাতি ও ৪২০ জন বাঙালি।
এমতাবস্থায় শান্তিচুক্তিতে উল্লেখ থাকা সত্তে¡ও সরকারের পক্ষে সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার সম্ভব হয়নি (আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস ও কৌশলগত ঝুঁকির কথা এখানে বিবেচিত হয়নি)। তবু শান্তিচুক্তির ২১ বছরে সরকার একটি ব্রিগ্রেডসহ ২৪০টি নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রত্যাহার করেছে। দেখা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর যেসকল ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, ওই সকল এলাকা উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তারের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পগুলোর অনেকগুলো বিভিন্ন নামে সন্ত্রাসীরা দখল করেছে। ফলে স্থানীয় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে পুনরায় নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি জানানো হয়েছে।
শুধু তাই নয়, শান্তিচুক্তির শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া’ সরকার ও জনসংহতি সমিতি এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে কিন্তু জনসংহতি সমিতির পক্ষে স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমা টানা ২২ বছর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা ভোগ করলেও আজো বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়পত্র গ্রহণ করেননি। এমনকি তিনি ২৬ মার্চ, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবসের মতো জাতীয় দিবসগুলো পালন করেন না। অর্থাৎ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও সন্তু লারমার বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য সন্দেহাতীত নয়।
এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, পাশ্চাত্যের ক্রিশ্চিয়ান বাফার স্টেট বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র, বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস ও উভয় রাষ্ট্র বিরোধীদের তৎপরতা, আন্তঃসম্পর্ক, অনিষ্পন্ন সীমানা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সংলগ্ন কক্সবাজারে ১১ লাখ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অবস্থান এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সন্নিহিত পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থানগত কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বর্তমানে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার শান্তিচুক্তির শর্তানুযায়ী বাধ্যতামূলক বা বিবেচ্য নয়। বরং শান্তিচুক্তির শর্তানুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের যেখানে যেমন প্রয়োজন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা জরুরি। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, শান্তিচুক্তির ঘ খন্ডের ১৭(ক) ধারা বাস্তবায়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন ও সেনাক্যাম্প স্থাপন জরুরি। এটা শান্তিচুক্তিরই অংশ। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন চাইলে এটাও মানতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী স্বেচ্ছায় বা স্বাগ্রহে যায়নি। কোনো প্লেজারিজমের উদ্দেশ্যেও যায়নি। সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অপরিহার্য প্রয়োজনে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাবি করে। এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে পোস্টিংকে পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী গিয়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে সরকারি নির্দেশে। সেখানকার পরিবেশ, আবহাওয়া, ভূপ্রকৃতি, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন সমতলের মানুষের জন্য অনুকূল নয়। সাপ, মশা, জোঁক হিংস্র বন্যপ্রাণি, দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রতিকূল পরিবেশ, বৈরী ভূপ্রকৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের সাথে মোকাবেলা করে এবং পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হুমকি ও অপতৎপরতার মুখে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অটুট রেখেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকের অনেকে এ কথা বহুবার বলেছেন যে, সেনাবাহিনী না থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বহু আগেই বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো।
সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত নিরাপত্তাবাহিনীর ৩৫৯ জন সদস্য নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪৩০ জন এবং অন্যভাবে ২২৭ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পূর্বে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৪৩ জন সদস্য নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৭৩, বিজিবি ৯৬, পুলিশ ৬৪, আনসার ভিডিপির ১০ জন। নিহত সেনা সদস্যদের মধ্যে অফিসার ৫ জন, জেসিও ৩ জন, বাকিরা সৈনিক। এছাড়াও দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনা, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ, ভূমিধস প্রভৃতি কারণে মারা গেছে আরো অনেকে। এর মধ্যে শান্তিচুক্তির পূর্বে শুধু ম্যালেরিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১৬০ জন এবং পরে ৮১ জন মারা গেছে। উভয় কারণে আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য। তবে শান্তিচুক্তির পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর মোট ১৬ জন সদস্য মারা গেছে। এর মধ্যে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে মারা গেছে ১১ জন, ৫ জন রাঙামাটির ভূমিধসে। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ৮ জন, বিজিবির ২ জন, পুলিশ ২ জন এবং আসনার ভিডিপি ৪ জন।
তারপরও সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়ে গেছে দেশের স্বার্থে। কিন্তু এদেশে পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অবস্থানকে এমন নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয় যেন, তারাই সকল সঙ্কটের মূল। অথচ অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে যেসব এলাকা থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেসব এলাকা পুনরায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বিজিবি বা পুলিশ থাকার পরও সন্ত্রাসীরা ঐ সকল অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হয়েছে। ঐসকল পরিত্যাক্ত সেনা ক্যাম্পের অনেকগুলো ইতোমধ্যেই পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা দখল করে নানাভাবে তাদের আধিপত্য বিস্তারের কাজে ব্যবহার করছে।
উল্লিখিত পর্যালোচনার ভিত্তিতে এ কথা জোর দিয়ে বলার সময় এসেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করে নিরাপত্তা কৌশল পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে, যেসকল নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব সেনা নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল সেগুলো ইচ্ছেমতো করা হয়নি। এর সাথে যোগাযোগ, জনবসতি, জননিরাপত্তা, কৌশলগত অবস্থান, সন্ত্রাসীদের তৎপরতা প্রভৃতি বিবেচনা করেই এক একটি নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। এখন সেগুলো থেকে সেনা/বিজিবি প্রত্যাহারের ফলে একদিকে যেমন ওই এলাকায় নুতন করে নিরাপত্তা সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে ওই সকল ক্যাম্প সন্ত্রাসীরা দখল করে অবস্থানগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার ও নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণের কাজে ব্যবহার করছে। কাজেই অনতিবিলম্বে প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্পের স্থান সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনানুযায়ী এসব ক্যাম্পের স্থানে সেনা অবস্থান/সেনা টহল নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে যোগাযোগ, অবকাঠামো ও পর্যটন উন্নয়নের কারণে যেসব স্থানে নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে সেসব স্থানে প্রয়োজনানুযায়ী সেনাক্যাম্প স্থাপন ও সেনা টহল বৃদ্ধি করতে হবে। শান্তিচুক্তির শর্তমোতাবেক বা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই এ কাজ করা যায়। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং বাংলাদেশে সীমান্তে আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার আর্মির নিয়মিত সংঘর্ষ পরিস্থিতি বিবেচনা, মাদক, অস্ত্র পাচার ও সম্ভাব্য জঙ্গি তৎপরতা বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পুনর্বিন্যাস অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। (সমাপ্ত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (11)
মাসুদুর রহমান ভুঁইয়া ১৩ মে, ২০১৯, ১:৩১ এএম says : 0
ঠিকই বলেছেন। বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার হুমকি রয়েছে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ হুমকি দেয়া হচ্ছে। কাল বিলম্ব না করে এখনই নিরাপত্তা জোরদার করা উচিত।
Total Reply(0)
জয়নাল হাজারি ১৩ মে, ২০১৯, ১:৩২ এএম says : 0
পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলো অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। পাহাড়কে অশান্ত করতে তারা সবসময় তৎপর থাকে। নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে একে অপরকে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ দেয়। তাই এদেরকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। নতুবা যে কোনো সময় বিদ্রোহ শুরু করবে।
Total Reply(0)
হাসিবুল ইসলাম ১৩ মে, ২০১৯, ১:৩৩ এএম says : 0
একমত। শান্তিচুক্তির আওতায় সেনাবাহিনী এরইমধ্যে অনেক ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা। যেসব এলাকা থেকে ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হচ্ছে সেসব এলাকায় রাতারাতি আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সশস্ত্র গ্রুপগুলো ওইসব এলাকা দখল ও পাল্টা দখলের খেলায় মেতে উঠছে। এতে বাড়ছে খুনোখুনি, চাঁদাবাজি আর অপহরণ ধর্ষণের মতো ঘটনা।
Total Reply(0)
মাহমুদুল হাসান রাশদী ১৩ মে, ২০১৯, ১:৩৪ এএম says : 0
পার্বত্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ২৪০টি নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি একটি ব্রিগেড সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে চারটি ব্রিগেড কাজ করছে। এগুলো রয়েছে-রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও গুইমারায়। ২০০৮ সালে কাপ্তাই থেকে ব্রিগেডটি সরিয়ে নেয়া হয়। ফলে অরক্ষিত এ অঞ্চলের সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ হয়ে পড়েছে নিরাপত্তাহীন। এ অবস্থায় প্রত্যাহার করা ক্যাম্পগুলো পূণঃস্থাপন করা হলে শান্তি ও নিরাপত্তায় সহায়ক হবে বলে মনে করি।
Total Reply(0)
বিজয় রাঙামাটি ১৩ মে, ২০১৯, ১:৩৬ এএম says : 0
আগে রাঙামাটিতে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করতে পারলেও এখন পরিস্থিতি খুবই খারাপ। যে কোন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে। সন্ধ্যা নামার আগেই বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু সেখানেও যে খুব নিরাপদ তা নয়। তাই নিরাপত্তা বিণ্যাস সময়ের দাবি।
Total Reply(0)
মাওলানা রূহুল আমীন'সানী' ১৩ মে, ২০১৯, ১:৩৭ এএম says : 0
সরকারকে বলবো খোঁজ নিয়ে দেখুন। শহরের তুলনায় প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে অবস্থা আরও বেশি খারাপ। দূর্গম এলাকা হওয়ায় সেসব জায়গা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেছে নিয়েছে। এদেরকে উৎখাত করতে হলে পুনরায় সেনা ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে।
Total Reply(0)
রাফি বিন মনির ১৩ মে, ২০১৯, ১:৩৮ এএম says : 0
আমি আপনার সাথে একমত। যেসব সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেসব জায়গা দখল করে নিয়েছে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। সেখানে তৈরি করছে নিজেদের আধিপত্য। এতে বাড়ছে চাঁদাবাজি আর খুনোখুনি। তিনি নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে প্রত্যাহার করা সেনাক্যাম্পগুলো আবারও স্থাপন জরুরি।
Total Reply(0)
মুরাদ হোসেন শিপলু ১৩ মে, ২০১৯, ১:৪০ এএম says : 0
নিরাপত্তা বিন্যাস ফরজ হয়ে পড়েছে। কেননা পাহাড়ে এখন প্রতিযোগিতা করে চলছে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর চাঁদাবাজি। এসব সংগঠন সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতে শান্তিপ্রিয় পার্বত্যবাসির জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সন্ত্রাসীরা টোকেন কিংবা রশিদ দিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে। কৃষক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ী, সরকারী বেসরকারী অফিসিয়ালস কেউই সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
Total Reply(0)
শাখাওয়াত হোসেন ১৩ মে, ২০১৯, ১:৪১ এএম says : 0
সবুজ পাহাড় আবার রক্তে রঞ্জিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনের পরে বেশ কিছু দিন কেটে যাওয়ার পর পাহাড়ের অবস্থা অনেকটা গুমোট। বিষয়টি প্রশাসনকে নজরে নেওয়া িউচিত।
Total Reply(0)
নয়ন মুরাদ ১৩ মে, ২০১৯, ১:৪৩ এএম says : 0
পাহাড়ের অরাজকতা ও সহিংসতার পেছনে মূল কারণ অর্থের জোগান, আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতালিপ্সা। শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন হওয়া না হওয়া নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। সবার প্রত্যাশা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা অটুট রেখে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে।
Total Reply(0)
সবুজ আলম ফিরোজ ১৩ মে, ২০১৯, ১:৪৩ এএম says : 0
ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সংহতি নিশ্চিত করে সঠিক সাংবিধানিক পদ্ধতিতে হাঁটতে হবে সরকারকে। পাহাড়ি জনগণ এবং উপজাতীয় সংস্কৃতি যেন বিলীন না হয়, সে দিকেও লক্ষ রাখতে হবে। এখন আরেকটা চুক্তি করতে হবে, তা পাহাড়িদের নিজেদের সাথে নিজেদের। এ জন্য হয়তো মধ্যস্থতা করতে হবে সরকারকে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন