চেঙ্গিস খানের প্রথম দুই পুত্রের বংশে কিভাবে ইসলাম প্রচারিত হয়, সে বিবরণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। চেঙ্গিসের তৃতীয় পুত্রের নাম ওগতাই খান (ওকতাই খান) । পিতার মৃত্যুর পর তৃতীয় পুত্র ওগতাই সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের অধিকারী হন এবং তিনি ‘খাকান’ উপাধি ধারণ করেন। ‘খাকান’ উপাধি তখন থেকে এখন পর্যন্ত উপমহাদেশে মুসলমানগণ জুমার খুতবায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে তা বর্জন করা হয়েছে বলে জানা যায়। এখন ‘খাকান ইবনে খাকান’ খুতবায় আর পাঠ করা হয় না।
ওগতাই খানের ইসলাম গ্রহণের বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে তার শাসনামলের আগেই ইসলাম ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছিল বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সাক্ষ্য পাওয়া যায়। ওগতাই খানের আমলে তার রাষ্ট্রের সর্বত্র ইসলাম ‘রাষ্ট্রধর্মে’ পরিণত হওয়ার কথাও বর্ণিত হয়ে থাকে।
চেঙ্গিস থেকে ওগতাই খানের আগ পর্যন্ত মুসলমানদের ওপর যেসব নিষ্ঠুর অত্যাচার-নির্যাতন চলে, তার বিক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া গেলেও বিশদ বিবরণ উদ্ধার করা কঠিন। তবে চেঙ্গিস খানের একটি নিষ্ঠুর নির্দেশ ছিল এরূপ : ‘কোনো মুসলমান যদি কোনো পশু ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক জবাই করে, তাকে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হবে।’ এ নির্দেশের ফলে কত আলেমকে হত্যা করা হয়েছিল এবং কতকাল এ নির্দেশ বলবৎ ছিল তার সঠিক তথ্য কারো জানা নেই।
এ কঠোর আইন ও অন্যান্য নির্যাতনের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেক আলেম আত্মগোপন করেছিলেন বলে জানা যায়। তারা আত্মগোপন করেই ক্ষান্ত হননি, গোপনে তারা সত্য ধর্ম প্রচারের দায়িত্বও সুকৌশলে, সতর্কতার সাথে পালন করতে থাকেন এবং এর সুফলও দেখা দিতে থাকে। এ সম্পর্কে ওগতাই খানের শাসনামলের (১২২৯-১২৪১) একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আর্লন্ডের ভাষ্য মতে : ‘মোগলদের সকল এলাকায় এবং তাদের ছোট-বড় সমস্ত রাজ্যে এমন মুসলমান আলেমে দ্বীন ও মোবাল্লেগিন বর্তমান ছিলেন, যারা মোগলদের সাধারণ জনগণ ও বিশিষ্টজনদের গোপনে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মুসলমান করতেন। সুতরাং, চেঙ্গিস খানের পুত্র ওগতাই খানের আমলে কিরগিজ নামক ইরানি শাসক যিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন, তিনি বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেন।’ এতে প্রমাণিত হয়, ওগতাইয়ের সময়ে ইসলামের প্রভাব কিভাবে বিস্তার লাভ করেছিল।
এখানে উল্লেখ্য, চেঙ্গিস খানের প্রথম দুই পুত্র জওজি খান ও চাগতাই খানদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের সূচনা হয়েছিল, যার ধারাবাহিক বিবরণ অনুপস্থিত। কিন্তু চেঙ্গিস খানের তৃতীয় পুত্র ওগতাই খানই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার রাষ্ট্রের সর্বত্র ইসলাম প্রচারিত হয়ে যায়। চেঙ্গিস বংশে ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে ওগতাই খান শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।
এখানে একটি বিভ্রান্তির বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন। চেঙ্গিস খানের চতুর্থ পুত্রকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ ইতিহাস গ্রন্থে তোলাই বা তাওয়াল্লী খানকে চতুর্থ পুত্র হিসেবে লেখা হলেও মাওলানা আসলাম জিরাজপুরী রচিত ‘তারিখুল উম্মত’ নামক গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে ‘ওকদাই’-কে চতুর্থ পুত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তাওয়াল্লী খানকে বলা হয়েছে তৃতীয় পুত্র। তাকে চীন ও সমগ্র পূর্বাঞ্চলের অধিপতি এবং ‘আকা আন আজম’ উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয়। তাকে সর্বকনিষ্ঠ (চতুর্থ) পুত্র বলা হয়। চেঙ্গিস খান অছিয়ত করে যান, ‘তার অন্যান্য পুত্র তার অনুসরণ ও তাকে সাহায্য করবেন এবং কেউ তার নির্দেশ অমান্য করবে না।’
এমনিতেই মুসলিম ইতিহাসবিদগণ চেঙ্গিস বংশের সঠিক ও বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে যথেষ্ট কার্পণ্য প্রদর্শন করেছেন। তার ওপর চেঙ্গিসপুত্রদের ধারাবাহিকতায় বিভ্রান্তির বেড়াজাল বিছিয়ে দিয়েছেন, যাতে সাধারণ পাঠকবর্গ চেঙ্গিস বংশ সম্পর্কে সঠিক তথ্য উদ্ধার করতে হিমশিম খাবেন তাতে সন্দেহ নেই। ইসলাম গ্রহণ ও প্রচারের ক্ষেত্রে পরবর্তী চেঙ্গিস বংশধারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য অবগত হওয়া কঠিন। তাদের সম্পর্কে ইতিহাসের এ উদাসীনতাকে বেদনাদায়ক না বলে পারা যায় না।
ইসলাম ও মানবতা ধ্বংসকারী একটি কুখ্যাত জাতি ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে ইসলামে যে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন, তাদের সেই ইতিবাচক ভ‚মিকা ইতিহাসে অবর্তমান। অথচ ওগতাই খানরাই ‘খাকান ইবনে খাকান’ হয়ে মুসলমানদের জুমার খুতবায় শত শত বছর বিরাজমান ছিল। ‘ইলখানি’ ইতিহাস সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য।
চেঙ্গিসপুত্র ওগতাই বা ওকমাই নামে এই বাদশাহ ‘খাকান’ উপাধিতে ভ‚ষিত ছিলেন, সে কথা আগেই বলা হয়েছে; কিন্তু কার হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন সে কথা স্পষ্ট না হলেও তিনি ইসলাম প্রচারক দলের কারো না কারো নিকট মুসলমান হয়েছিলেন, এটাই স্বাভাবিক। ওগতাই খানের মতো তার পরবর্তী প্রজন্মও ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল বলে জানা যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন