স্বাধীনতা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি নেয়ামত। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই নেয়ামতকে সুনিশ্চিত করেছে। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মভূমির প্রতি অপরিসীম ভালবাসা ছিল। প্রতিপক্ষ মুশরিকদের নির্যাতনে রসুল (সা.) মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে যেতে বাধ্য হন। যখন তিনি মক্কা ছেড়ে মদীনার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন, তখন পিছন ফিরে প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি তাকাচ্ছিলেন এবং বলেছিলেন, হে প্রিয় জন্মভূমি মক্কায় যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বাধ্য না করত আমি কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।
দেশপ্রেমের কারণেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের অনেক মানুষ জীবন দান করেছে অকাতরে। মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে। স্বদেশপ্রেমই মুক্তিযোদ্ধাদের অমর করে রেখেছে। তাদের শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও দেশবাসীর অন্তরে তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল। স্বদেশপ্রেম ও মাতৃভূমিকে ভালবাসা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট থাকা ঈমানের দাবি। সাহাবায়ে কেরামও দেশকে ভালবাসতেন। সুদীর্ঘ তের বছর রসুল (সা.) ও তার সাহাবীরা মক্কায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়ে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হিজরতের পর মদীনায় হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত বিলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হন। তখন তাঁরা জন্মভূমি মক্কার স্মৃতিসমূহ স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। এ অবস্থায় মহানবী (সা.) সাহাবীদের মনের অবস্থা দেখে এই বলে দোয়া করেন, হে আল্লাহ আমরা মক্কাকে যেমন ভালবাসি তার চেয়েও বেশি মদীনার ভালবাসা আমাদের অন্তরে দান করুন। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুল (সা.)কে বলতে শুনেছি, দুই প্রকারের চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। প্রথমত সেই চক্ষু যা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, দ্বিতীয়ত সেই চক্ষু যা আল্লাহ্র পথে সীমান্ত পাহারাদারি করতে করতে রাত কাটিয়ে দেয়। দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতে হলে অবশ্যই দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। নিজ দেশের প্রতি অনুগত থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশমাতৃকাকে ভালবাসা সকলের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, মানুষের তিনটি করে মা থাকে। একটি জন্মদাত্রী মা, একটি মাতৃভাষা আর একটি মাতৃভূমি। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার পর লন্ডন টাইমস পত্রিকা একটি রিপোর্ট করেছিল, যদি রক্ত স্বাধীনতার মূল্য হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ মূল্যেই স্বাধীনতা কিনেছে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবজনক অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আমরা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছি। দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রাম সর্বোপরি নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি মহান স্বাধীনতার লাল সূর্য, পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ ও পতাকা। অসাধারণ ও অকৃত্রিম দেশপ্রেমের কারণেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ম্যাকব্রাইড বলেছেন, Bangabandu Sheik Mujib was the soul of his nation.. ১৯৭৩ সনের বঙ্গবন্ধুর ডাইরিতে লিখেছেন, As a man what concern mankind concerns me, As a Bengali I am deeply involved in all that concerns Bengalis . The abiding involvement is born of nourished by love enduring love, which gives meaning to my politics and to my very being. (একজন মানুষ হিসেবে আমি সমগ্র মানবজাতি নিয়ে ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালির সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা যে ভালবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।) বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ডাইরির এ লেখায় তাঁর মানবতাবোধ ও গভীর দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সুনাম অর্জন করছে তার সব কিছুর পিছনে আছে স্বাধীনতা। আর তার পিছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সামাজিক খাতে এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি বিশ্ববাসীর মুখে মুখে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ চীনের সমপর্যায়ে চলে যেতে পারে। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে উন্নয়ন অগ্রগতির এক বিস্ময়কর পরিবেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে সাধারণ মানুষরা ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণে দেশ স্বাধীন হয়েছে, ঠিক তেমনি দেশের উন্নয়নের কারিগর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন এদেশের সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত উদ্যোগও দেশকে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের যে অর্জন, যে অগ্রগতি তার কিছুই হয়তো সম্ভব হতো না যদি না বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি তৈরি হতো। লক্ষ লক্ষ শহিদ ও অগণিত মা-বোনের জীবন-সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে তখনই সার্থক হবে, যখন দেশের প্রতিটি মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে মৌলিক অধিকারগুলো যথাযথভাবে ভোগ করতে পারবে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ জাতির দীর্ঘ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। স্বাধীনতার প্রধান আকাক্সক্ষা ছিল সব ধরনের অধীনতা থেকে মুক্তি, গণতন্ত্র, ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা। সহজ কথায় মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একাট শোষণ মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। সমতা, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায় বিচার- এই তিনটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল, যা পরে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সেই কাক্সিক্ষত সমাজ যদিও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। তারপরও বাংলাদেশের অর্জন অনেক। ধানের উৎপাদন চার গুণেরও বেশি বেড়েছে। মঙ্গা হয়েছে ইতিহাস। মানুষের জীবনাচরণে পরিবর্তন এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশের আজকের এ অবস্থায় উন্নীত হতে দেশের কৃষক শ্রমিক উদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষ কঠোর পরিশ্রম করছে। এদের স্বীকৃতি দিতে হবে। এদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। মানুষের মানবাধিকার যাতে লংঘিত না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের অর্থনীতি মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে আমাদের প্রবাসীদেরও রয়েছে বিরাট ভূমিকা। তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সকলের প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে টেকসই রূপ দিতে হলে নৈতিক চর্চাও বাড়াতে হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতার চর্চা বাড়ানোর বিকল্প নেই। আসলে স্বাধীনতা হলো মানুষের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। স্বাধীনতার মানেই হলো নিজের মান সম্মান ও ধন সম্পদ ইত্যাদি নিয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন