রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

হজরত হাস্সান (রা.)-এর কবিতা ও কাব্য সাহিত্য প্রসঙ্গে

আদিল মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

মানুষের মনন ও সুবোধ জাগিয়ে তোলা এবং সত্য ও সুন্দরের সন্ধান দেয়াই সাহিত্যের কাজ। আর ভাষা ও সাহিত্যজগৎ কাব্য ও ছন্দ নিয়েই তার যাত্রা শুরু করেছিল। কবিতাই ছিল মানুষের সাহিত্য সৃষ্টির প্রাথমিক মাধ্যম। মানব মনন, প্রেম, অনুভূতি, আবেগ, ভালোবাসা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক কবিতা। কবি ও কবিতা কালের মহান এক সাক্ষী। আমাদের প্রেয়ারে নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) কবিতা শুনতে, কবিতা ভালোবাসতেন। কবি ও কবিতার প্রতি তাঁর একটি স্বভাবসুলভ আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল। পেয়ারে নবী তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে কবিতার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্যে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন— ‘যে দু’টো মনোরম আবরণে আল্লাহ তাআলা বিশ্বকে সাজিয়ে থাকেন, কবিতা তার একটি।’ 

তিনি আরোও বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে কোন কোন কবিতায় রয়েছে প্রকৃতি জ্ঞানের কথা।’ তিনি সাহাবীদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, ‘তোমরা তোমাদের সস্তানদেরকে কবিতা শেখাও, এতে তার কথা মিষ্টি ও সুরেলা হবে।’ হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা কাফির, মুশরিকদের নিন্দা করে কাব্য লড়াইয়ে নেমে পড়ো। তীরের ফলার চেয়েও তা তাদেরকে বেশী আহত করবে।’
রাসূল (সা.)-এর উৎসাহ ও প্রেরণায় সাহাবীদের মধ্যে যাদের কাব্যচর্চার প্রতিভা ছিল, তারা প্রায় সকলেই কাব্যচর্চা করতেন। সাহাবী কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, ‘হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.), কাআব ইবনে মালিক (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.), আলী ইবনে আবু তালিব (রা.), আবু বকর সিদ্দিক (রা.), ওমর ফারুক (রা.), লবীদ ইবনে রাবিয়াহ (রা.), আব্বাস ইবনে মিরদাস (রা.), জুহায়ের ইবনে জুনাব (রা.), সুহায়েম (রা.), খুবাইহ ইবনে আদী (রা.), তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.), আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রা.), জাফর ইবনে আবু তালেব (রা.), ও আবু লায়লা (রা.) প্রমুখ।
রাসূল (সা.)-এর সাহাবী কবিদের মধ্যে থেকে হজরত হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.)-কে সভাকবির মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হতো ‘শায়েরুর রাসূল বা রাসূলের কবি।’ হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.) কবিতা আবৃত্তি শুরু করলে কবিকে উৎসাহিত করার জন্য কখনো কখনো নবীজী সবাইকে শুনিয়ে বলতেন, ‘হাস্সানের জিব যতদিন রাসূলের পক্ষ হয়ে কবিতার বাণী শুনিয়ে যাবে, ততদিন তার সাথে জিব্রাইল (আ.) থাকবেন।’ কবিতা লেখার পুরস্কার হিসাবে হজরত হাস্সান বিন সাবিত (রা.) জীবিত অবস্থায় জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন। হাস্সান বিন সাবিত (রা.)-এর কবিতা শুনে রাসূল (সা.) ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘হে হাস্সান, আল্লাহ কাছ থেকে তোমার জন্য পুরস্কার রয়েছে জান্নাত।’
হজরত হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.)-এর কবিখ্যাতি ছিল আরবজুড়ে। সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতো তাঁর কবিতার পংক্তি। তিনি রাসূল (সা.)-কে পেয়েছিলেন খুব কাছে থেকে, রাসূলের (সা.)-এর ভালোবাসাও পেয়েছিলেন অনেক বেশি। রাসূল (সা.)-এর প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসায় অভিষিক্ত ছিলেন। সব মিলিয়ে এক সৌভাগ্যবান কবি ছিলেন হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.)।
রাসূল (সা.)-কে তিনি ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে। তাঁর সেই ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না। ‘তোমার তারিফ› কবিতায় রাসূল (সা.)-এর প্রতি তাঁর সেই ভালোবাসার দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই। যেমন, ‘তোমার চোখের মত ভালো চোখ পৃথিবীতে দেখেনি/ এবং বিশ্বে কোথাও কোন মাতা এমন সুন্দর পুত্র আর প্রসব করেনি/ তোমার সৃজন সে তো একেবারে দোষমুক্ত করে/ এবং তুমিও তাই চেয়েছিলে আপন ইচ্ছায়/ তোমার তারিফ এই পৃথিবীতে বেড়েই চলেছে/ যেমন কস্তুরী ঘ্রাণ বাতাসে কেবলি ছুটে চলে। ... তোমার প্রশংসা করার মত আমার তেমন কোন ভাষা জানা নেই/ ভাষার দিক থেকে আমি তো নগণ্য কবি/ নবীর সঠিক সুন্দর প্রশংসা হয় না নিছক আমার এ ভাষায়/ কিন্তু নবীর ছোঁয়া পেয়ে এ কবিতা অমরত্ব পাবে।›
হজরত হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.) কবিতা রচনা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বস্তুত কবিতার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যের প্রচার, সুন্দরের প্রতিষ্ঠা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের প্রতিবাদে, সত্য ও ন্যায়কে বিজয়ী করার মানসেই কবিতা রচিত হওয়া উচিত। তিরমিজি শরিফে এসেছে, হজরত হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.)-এর জন্য রাসূল (সা.) মসজিদে নববিতে একটি মিম্বর স্থাপন করেছিলেন। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে কাফেরদের নিন্দাসূচক কবিতার উত্তর দিতেন। রাসুল (সা.) তাঁর কবিতা শুনে বলতেন, ‘আমার পক্ষ থেকে উত্তর দাও। হে আল্লাহ, রুহুল কুদুস (জিবরাঈল)-কে দিয়ে হাস্সানকে সাহায্য করো।’
একবার রাসূল (সা.) হজরত হাস্সান (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আবু বকরকে নিয়ে কোন কবিতা কি এ পর্যন্ত লিখেছো? তখন হজরত হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.) বললেন, হ্যাঁ লিখেছি। রাসূল (সা.) বললেন, শোনাও তাহলে। হজরত হাস্সান ইবনে সাবেত (রা.) হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা রাসূল (সা.)-কে শোনাতে শোনাতে যখন নিচের পংক্তিগুলো পড়তে লাগলেন, ‘সুউচ্চ সওর গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি সে/ তিনি যখন রক্ত লোলুপ শৃগালেরা/ মুখে শুঁকে শিখরে এলো/ রাসূলের সঙ্গে আছেন সদা এক ছায়াতরু/ সবাই জানে নবীর পরে/ তিনি সৃষ্টির মাঝে সবার চেয়ে সেরা।’ তা শুনে রাসূল (সা.) হেসে হেসে বললেন, ‘তুমি সত্য বলেছে হাস্সান, যা বলেছো তার যোগ্যই আবু বকর।’
হজরত হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.) ছিলেন ইসলামের তরে নিবেদিত প্রাণ। তাই ইসলামী পরিভাষার প্রাচুর্য রয়েছে তাঁর রচনায়। তিনি কবিতায় কুরআনের বাক্যাংশ সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন। যেমন, ‘যাবতীয় স্তুতি, করুণা ও কর্তৃত্ব তাঁরই/ তাই আমরা শুধু তাঁরই সকাশে সু-পথের সন্ধান যাঞ্চা করি/ এবং শুধু তাঁরই ইবাদত (আনুগত্য ও উপাসনা) করি।’ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের বিষয়ও স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতায়। তাঁর এ ধরণের কোনো কোনো কবিতা প্রবাদের আবহে আজও সমানভাবে প্রচলিত। এও উল্লেখ্য যে, তিনি ছিলেন স্বভাব কবি। কাব্যিক-সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অহেতুক পরিশ্রম করতেন না। সে-বিষয়ে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘কবিরা কী বলেছেন, আমি তা অনুকরণ করি না/ ফলে, আমার কবিতার সাথে তাঁদের কবিতা মেল খায় না।’
রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি প্রিয় নবীজীর স্মরণে একটি কবিতা লিখেছেন। সেই কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘তুমি ছিলে আমার নয়নের মণি/ তোমার মৃত্যুতে আমি অন্ধ হয়ে গেছি/ এখন অন্য কারও মৃত্যুতে আমার কোনো প্রতিক্রিয়াই হবে না।’
হজরত হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.) খাজরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখায় হিজরতের প্রায় ৬০ বছর আগে ৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। রাসূল (সা.)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের মা ছিলেন বনু নাজ্জার গোত্রের, এদিক দিয়ে হজরত হাস্সান ইবনে সাবিত (রা.) রাসূল (সা.)-এর আত্মীয় ছিলেন। তাঁর বংশ ছিল কবি বংশ। ঐতিহাসিক আহমদ ইসকান্দারি বলেন, ‘তাঁর বাবা ও দাদা উভয়েই কবি ছিলেন। তাঁর ছেলে আব্দুর রহমান ও নাতি সাঈদ ও কাব্যচর্চা করতেন।› তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তাঁর জীবনে বার্ধক্য এসে গিয়েছিল। মদীনায় ইসলাম প্রচারের সূচনালগ্নে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল (সা.) মদীনায় হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিল ৬০ বছর। রাসূল (সা.) মদীনায় এলে মদীনাবাসীর সঙ্গে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর তিনি তাঁর কাব্যশক্তি দিয়ে ইসলামের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। রাসূল (সা.) তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। খলিফারাও তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দিয়ে ছিলেন। আমিরে মুয়াবিয়া (রা.)-এর খেলাফতকালে ৫৪ হিজরিতে ১২০ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
saif ৭ এপ্রিল, ২০১৯, ৭:৫৬ পিএম says : 0
‘তোমার চোখের মত ভালো চোখ পৃথিবীতে দেখেনি/ এবং বিশ্বে কোথাও কোন মাতা এমন সুন্দর পুত্র আর প্রসব করেনি/ তোমার সৃজন সে তো একেবারে দোষমুক্ত করে/ এবং তুমিও তাই চেয়েছিলে আপন ইচ্ছায়/ তোমার তারিফ এই পৃথিবীতে বেড়েই চলেছে/ যেমন কস্তুরী ঘ্রাণ বাতাসে কেবলি ছুটে চলে। ... তোমার প্রশংসা করার মত আমার তেমন কোন ভাষা জানা নেই/ ভাষার দিক থেকে আমি তো নগণ্য কবি/ নবীর সঠিক সুন্দর প্রশংসা হয় না নিছক আমার এ ভাষায়/ কিন্তু নবীর ছোঁয়া পেয়ে এ কবিতা অমরত্ব পাবে লেখক সাহেব কে এবং ইনকিলাব সংশ্লিষ্ট সকলকে আল্লাহ্‌ এর উত্তম প্রতিদান প্রধান করুন
Total Reply(0)
Jahid ৩ নভেম্বর, ২০২০, ৫:১৪ পিএম says : 0
#weLoveMuhammad S.A.O.S
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন