ঈদের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম আমার নিজ জেলা কিশোরগঞ্জে। ভাবলাম ঘুরে আসি চন্দ্রাবতীর গ্রাম। জেনে আসি তার ও তার বাল্যবন্ধু জয়ানন্দ কেন আত্মহত্যা করেছিলেন। ১৫/৭/২০২২ শুক্রবার চলে গেলাম আমার জন্মস্থান ডাউকিয়া (কাটাবাড়ীয়া) থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চন্দ্রাবতীর নিবাস পাতুরীয়া বা পাঠবাড়ীয়া গ্রামে। এটি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারীপাড়া (বর্তমান নাম) গ্রামে অবস্থিত। গ্রামের বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, চন্দ্রাবতী মধ্যযুগে রচিত ’মনসা মঙ্গলের’ অন্যতম কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা। এই গ্রামেই ছিল তাঁদের নিবাস। এখানে বসেই তিনি ’রামায়ণ’, ’দস্যু কেনারামের পালা’, ’মলুয়া’, ‘মনসার ভাসান’ প্রভৃতি কাব্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি নারী কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত একটি স্থাপনা (ছবি ধারণ: ১৫/৭/২০২২)
এটি নীলগঞ্জের জমিদার নীলকন্ঠ রায় (যার নামে নীলগঞ্জ রেল ষ্টেশন, নীলগঞ্জ বাজার ও নীলগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়) এর বাসস্থান বলে স্থানীয় অধিবাসীদের মাধ্যমে জানা যায়, তবে ভবনটি চন্দ্রবাতী মন্দিরের অতি নিকটে হলেও ভবনে চন্দ্রাবতী ও তার বাবা-মা বসবাস করতেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। কারণ কবি চন্দ্রাবতী তাঁর নিজ কবিতায় তাদের বাসস্থানের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তাতে বুঝা যায় তাঁদের বাসস্থান বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনি ছিল, কবিতাটি নি¤œরূপ;
ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়।
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়।
ভট্টাচার্য ঘরে জন্ম অঞ্জণা ঘরণী।
বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনি।
চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত আর একটি স্থাপনা চন্দ্রাবতী মন্দির। এটি মূলত একটি শিব মন্দির। ফুলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত মন্দিরটি বর্তমানে প্রতœতাত্তি¡ক অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত পুরাকীর্তি। কবি চন্দ্রাবতী মন্দির (ছবি ধারণ: ১৫/৭/২০২২) চন্দ্রাবতী শিবমন্দিরটি বস্তুত তাঁর বহু কাহিনী ও ঘটনাকে ধারণ করে। ষোড়শ শতকের দ্বিতীয় ভাগে কবি চন্দ্রাবতীর জন্য নির্মিত হয় এই মন্দিরটি। কবি চন্দ্রাবতী ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাধারী ও সম্ভাবনাময় সাহিত্যিক। গবেষক দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, চন্দ্রাবতী ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। নয়নঘোষ প্রনীত পালাগান ‘চন্দ্রাবতী’ থেকে জানা যায় যে, কৈশোরে চন্দ্রাবতী ও স্থানীয় এক ব্রাহ্মনযুবক জয়ানন্দের মধ্যে মনের আদান-প্রদান হয়। তাদের এ ভালবাসার কথা চন্দ্রাবতীর পিতা বংশীদাস মেনে নেন। কথা অনুযায়ী তাদের মধ্যে তিনি বিয়ের ব্যবস্থাও করেন। কিন্তু পরিশেষে জয়ানন্দ কথা অনুযায়ী বিয়ে না করে ধর্মান্তরিত হয়ে তার নাম পরিবর্তন করে জয়নাল নাম রেখে অপর এক মুসলিম রমণী আসমানীকে বিয়ে করেন। এই ঘটনায় চন্দ্রাবতীর মাথায় যেন বাজ ভেঙে পরল। তার সকল স্বপ্ন আশা নিমেষে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। চন্দ্রাবতী পাথরের মতন কঠিন হয়ে গেলেন। তার চোখের জল শুকিয়ে গেল। মুখের ভাষা নিরব হয়ে গেল। চন্দ্রাবতীর এরকম অবস্থা দেখে স্নেহময় পিতা বড় ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। এদিকে নানা জায়গা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসতে লাগলো। কিন্তু চন্দ্রাবতী অনড়। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে আর বিয়ে করবেন না। শিবের আরাধনা করেই বাকি জীবনটা কাটাবেন। চন্দ্রাবতীর ইচ্ছানুযায়ী ফুলেশ্বরী নদীর ধারে শিব মন্দির তৈরি হলো। চন্দ্রাবতীও পূজা অর্চনায় মন দিলেন। আর তার সঙ্গে চলল কাব্যচর্চা। এইসময় তিনি পিতার নির্দেশে রামায়ণ রচনা করলেন। চন্দ্রাবতীর রামায়ণের মৌলিকত্ব তাকে কবি প্রতিভার অমরত্বের আসনে পৌঁছে দিয়েছে। আজও ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলের ঘরে ঘরে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গীত হয়। কৃত্তিবাসের পর যারা রামায়ণ লিখে বিখ্যাত হয়েছেন তাদের মধ্যে চন্দ্রাবতী অন্যতম। কিন্তু দুঃখের বিষয় চন্দ্রাবতী এই রামায়ণ শেষ করে যেতে পারেননি। সীতার বনবাস পর্যন্ত লিখেই তাকে থেমে যেতে হয়েছিল। চন্দ্রাবতীর আবিস্কারকর্তা দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে, চন্দ্রাবতীর রামায়ণ একেবারেই মৌলিক রচনা, মিল নেই অন্য কোনোটার সঙ্গেই। যেমন এখানে তিনি এনেছেন কৈকেয়ীর কন্যা কুকুয়াকে, যে রামচন্দ্রের কাছে সীতা সম্পর্কে অপবাদ দিচ্ছে। এই চরিত্রটির উপস্থিতি অন্য কোনো রামায়ণে নেই। এই কুকুয়ার কথায় রাম যখন সীতার চরিত্র সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠেন, তখন পালাকার চন্দ্রাবতী রামকে তিরস্কার ভর্ৎসনা করতে ছাড়েননি। এমন পরিশীলিত রামায়ণ আর কেউ লেখেননি। কিন্তু মধ্যযুগীয় পুরুষ শাষিত সমাজে এই নারী কী করে পারলেন? কারণ চন্দ্রাবতী নিজেও যে পুরাণ কাহিনির সীতার মতোই ট্র্যাজিক এক নায়িকা। নিজেও তিনি প্রেমবঞ্চিত, সমাজের কাছে অপমানিত, ধৈর্যে অটল কিন্তু হৃদয়ে ব্যাকুল, আর তারও যে বুকজুড়ে খালি অভিমান, তিনিও যে বুক ভরা ব্যথা নিয়ে জীবনের অধ্যায় শেষ করেছিলেন।
সময়টা তখন বৈশাখ। গ্রীষ্মের দাবদাহে প্রকৃতি তখন জর্জরিত। চন্দ্রাবতী রামায়ণ রচনায় তখন আত্মমগ্ন হয়ে আছেন। এমন সময় চন্দ্রাবতী একখানি চিঠি পেলেন। জয়ানন্দ তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করে একটি চিঠি লিখেছেন। সে আজ ক্ষমাপ্রার্থী।
শুনরে প্রাণের চন্দ্রা তোমারে জানাই।/মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হইছে ছাই।।/অমৃত ভাবিয়া আমি খাইয়াছি গরল।/কন্ঠেতে লাগিয়া রইছে কাল-হলাহল।।/জানিয়া ফুলের মালা কালসাপ গলে।/মরণে ডাকিয়া আসি আন্যাছি অকালে।।/তুলসী ছাড়িয়া আমি পূজিলাম সেওরা।/আপনি মাথায় লইলাম দুঃখের পসরা।।/জলে বিষ বাতাসে বিষ না দেখি উপায়।/ক্ষমা কর চন্দ্রাবতী ধরি তোমার পায়।।/একবার দেখিব তোমায় জন্মশেষ দেখা।/একবার দেখিব তোমার নয়নভঙ্গি বাঁকা। (অসমাপ্ত)
”/চিঠিটা পড়ে চন্দ্রাবতীর দুচোখ জলে ভরে উঠলো। অতীতের স্মৃতিগুলো আবার মানসপটে ভেসে উঠলো। চন্দ্রাবতী বংশীদাসকে সব কথা জানালেন। বংশীদাস মেয়েকে দেবতার কাছে চিত্ত সমর্পণ করতে বললেন। চন্দ্রাবতীও জয়ানন্দকে সান্তনা দিয়ে এই মর্মে চিঠি লিখলেন যে, জয়ানন্দ যেন নিজেকে দেবতার পায়ে সঁপে দেন তাহলে সে তার সকল যন্ত্রণা ভুলবে। জয়ানন্দ চিঠি পেয়ে মন্দির অভিমুখে ছুটলেন। মন্দিরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। চন্দ্রাবতী শিব পুজোয় মগ্ন হয়ে আছেন। জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীকে পাগলের মত ডেকে চললেন। অভিমানী চন্দ্রা দরজা কিন্তু খুললো না। জয়ানন্দ তখন সন্ধ্যামালতী ফুলের রস নিংড়িযে দরজার কপাটে চার লাইনের কবিতা লিখলেন;
“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী।।/পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত।/বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত।।”
মন্দিরের প্রবেশ পথ (ছবি ধারণ: ১৫/৭/২০২২খৃ.)
এরপর ব্যর্থ প্রেমিক জয়ানন্দ আত্মগøানি আর দহনে পুড়ে ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।
ফুলেশ্বরী নদীর বর্তমান দৃশ্য (ধারণ: ১৫/৭/২০২২)
অনেকক্ষণ পর ধ্যান ভাঙে চন্দ্রাবতীর। বুঝতে পারেন জয়ানন্দের স্পর্শে মন্দির অপবিত্র হয়ে পড়েছে। তাই পবিত্র করার জন্য ফুলেশ্বরী নদীতে যান জল আনতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো হৃদয়দহনে দগ্ধ হন তিনি। জয়ানন্দ আত্মহত্যা করেছেন জেনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন চন্দ্রাবতী। তবে কারো কারো মতে, নদী থেকে ফিরে এসে চন্দ্রাবতী মন্দিরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হয়।/লেখক: গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন