সাত সকালে তিন বছরের আবিদ কে ছুড়ে দেয়ার মতো করে মারুফের কাছে দিয়ে রেশমি কড়া গলায় বলে, ঘুম থেকে জেগে টো টো করে ঘোরা ছাড়া যেন কোনো কাজ নেই। আমি কাজ করতে করতে মরি আর উনি হাওয়া খেয়ে ঘুরে বেড়ান।
এতো গুলো কথা বলার ভেতর একবারের জন্যও শ্বাস নেয় না রেশমি। কথার স্পীড মিটার থাকলে মেপে বলা যেত গতিবেগ। কোন ধরনের কথা ঝড়। মারুফের ধারণা এই বদ মহিলা চিৎকার দিতে গিয়েই একদিন দম ফেটে মরবে। তবে সহসা মরবে বলে মনে হয়না। আবিদ তার বড় আদরের সন্তান। তিন বছর হিসাবে একটু পাকা এই যা। চা খাওয়া দরকার। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। আবিদ কে নিয়ে হাটতে হাটতে চায়ের দোকানে যায়। একটা লাল চায়ের অর্ডার। একটু পরেই দোকানী ভদ্রমহিলা এককাপ লাল চা দেয়।
চকলেট চুষতে চুষতে আবিদ বলে, আব্বু লাল চা কই?
- এই তো, আমি খাচ্ছি।
আবিদ আংগুল তুলে বলে, এই কী লাল?
- হু।
- কই আমার লাল জামা, লাল প্যান্ট, লাল ফুল, লাল গাড়িটা তো এরকম না।
- এটাও এক প্রকার লাল।
- ও আচ্ছা। এক প্রকারের লাল।
- হ্যাঁ।
- আব্বু তুমি আমাকে এক প্রকারের লাল জামা, লাল প্যান্ট, লাল ফুল, লাল গাড়ি কিনে দেবে।
- হু, দেব।
বাড়ি ঢোকার সময় দেখে আবিদের লাল প্যান্ট দড়িতে ঝুলছে। আবিদ বলে ওঠে, আব্বু দেখো আমার ওই প্রকারের লাল প্যান্ট পেশাব করছে।
- ধুর বোকা।
- ধুর না আব্বু। সত্যি।
মারুফ চেয়ে দেখে ভেজা প্যান্ট থেকে চুইয়ে ফোট ফোট পানি ঝরছে। হাত ঘড়ি জানান দেয় অফিসের সময় হয়েছে। তড়িঘড়ি ঘরে ঢুকে রেশমি কে বলে, খাবার কই?
- টেবিলে আছে খেয়ে নাও।
টেবিলে কাল রাতের রান্না করা তরকারি! বাসি ভাত। প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে বলে, তরকারি কী ঢাকা ছিল?
রেশমি খেকিয়ে ওঠে, শুধু ঢাকা থাকবে কেন! চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও ছিল। খেলে খাও না খেলে যাও।
মারুফ ভেতের প্লেট ঠেলে আস্তে করে উঠে যায়। রেশমি গদগদ কন্ঠে বলে, ইস। ওরে আমার নায়ক। যাও যাও। কতোই তো গেলে।
যতো দিন যাচ্ছে, বয়স হচ্ছে অফিসের কাজ সেই সাথে পালা দিয়ে বাড়ছে। ঘাড় ফেরানোর সময় নেই। অফিসে কাজের চাপ, বাড়িতে বউয়ের চাপ এ্ই নিয়ে মারুফের সংসার। দিনরাত। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। সন্ধ্যার চাইতে বড় সন্ধ্যা। সারা আকাশে ভুতুড়ে কালো মেঘ। কলিগ সনু মিয়া টেবিলের সামনে এসে বড় একটা হাই তোলে। ভাবখানা এমন যেন জীবনের শেষ হাই তুলে এখনি পরোপারে পাড়ি জমাবেন।
মারুফ বলে ওঠে, কি হয়েছে সানু ভাই।
-কিছু না। ওই যে শরীর ম্যাজম্যাজ করছে।
- হু, এখন তো ম্যাজম্যাজ করার সময়।
সানু প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে, বৃষ্টি পড়ে।
-ও আচ্ছা। তা কোন ক্লাসে?
-ধুর মিয়া আকাশে হঠাৎ মেঘ, কালবৈশাখী ঝড়। বৃষ্টি।
-ওহ। বৃষ্টি শুরু হয়েছে! ঝড় বৃষ্টি।
-মাথার ভেতর শুধু মেয়ে মানুষের চিন্তা! কথা শেষে হোঃ হোঃ শব্দ করে হাসে সানু।
অফিস থেকে যখন রাস্তায় নামে তখন দমকা বতাস। কড়কড় করে মেঘ ডাকে। রাস্তায় একটা গাড়িও নেই। হঠাৎ একটা এম্বুলেন্স মারুফের পাশে এসে দাঁড়ায়। জানালার কাচ খুলে ড্রাইভার হাক দেয়, যাবেন নাকি?
মারুফ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলে, আমি তো রুগী না।
ড্রাইভার মাথা বের করে ফিক করে হেসে দেয়। হাসপাতালে যাচ্ছি। ওষুধ ডেলিভারি দিতে হবে। ভাবলাম অসহায় মানুষের উপকার করি। তাই আর কি....।
-আমি মিরপুর বারো যাবো।
-সমস্যা নাই ওঠেন।
মারুফ উঠে পড়ে।গাড়ি ভরা বস্তা দেখে মারুফ বলে ওঠে, বস্তা ভরা কী!
-ওষুধ ভাই। নানা প্রকার ওষুধ।
কিছুদূর যেতেই সিগনাল। একঝাক পুলিশ গাড়ি দাড় করাতেই ড্রাইভার বেচারা লাফ দিয়ে দৌড় দেয়। পালাতে গিয়েও পারেনা। লাফ আর দৌড়ের জন্য কটা থাপ্পড় আর লাথি জোটে। সামনে থেকে দুটো বস্তা টেনে বের করে একজন বলে ওঠে, স্যার বস্তা ভরা মদ। কর্মকর্তা মহোদয় সামনে এসে ড্রাইভার কে প্রশ্ন করে, ভেতরে কী আছে?
- রুগী আছে স্যার। মারাত্মক রুগী।
বাইরের কথা শুনে মারুফের বুক শুকিয়ে আসে। মারুফ নিতান্তই সুস্থ সবল মানুষ। তাকে বলছে মারাত্মক রুগী! পুলিশের কী বুঝতে বাকি আছে এম্বুলেন্সে রুগী নেই। মদ বোঝাই। মারুফ ঘাপটি মেরে থাকে। সময় টা সামান্য। মিনিট খানিকের ভেতর দরজা খুলে মারুফ কে ভেতর থেকে টেনে হিচড়ে বের করে। হাসপাতালের ওষুধ বলা বস্তা গুলো একে একে ভেতর থেকে নামানো হয়। সব গুলো মদের বস্তা! মারুফ অসহায়ের মতো তাকায়। কেন পুলিশ! বস্তা ভরা মদ কেন? মারুফের জানার কথা নয়। তবু জীবন চলার পথে অনেক অজানা, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়।
- আপনি রুগী?
- না স্যার, একেবারে সুস্থ মানুষ। শয়তানটা আমাকে ধোকা দিয়ে গাড়িতে তুলেছে।
ড্রাইভার চিৎকার করে বলে, এই আপনি রুগী। বড় রুগী। মদ গিলতে গিলতে এখন দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
শান্ত ভদ্র কন্ঠে পুলিশ অফিসার প্রশ্ন করেন, মদ কার? কে ব্যবসায়ী!
- স্যার আমি একজন চাকুরীজীবি মানুষ। বিশ্বাস করুন আমি কিছু জানিনা। তবে ড্রাইভার কে মোবাইলে বলতে শুনেছি....
- কী শুনেছেন?
- ড্রাইভার কাকে যেন ফোন করে বলছিল, মাল ডেলিভারির কথা।
দুজনের মোবাইল নেয়া হয়। মারুফ সানন্দেই দেয় আর ড্রাইভারের টা জোরাজুরি করে কিল-ঘুষি মেরে নিতে হয়। কললিস্ট চেক করে ফোন দেয়া। যাচাই বাছাই শেষে মারুফ কে ছেড়ে দেয়। মারুফ ভয়ে ভয়ে, কাপা কাপা পায়ে হাটে।
বেশ লোকজন জড়ো হয়েছে। এম্বুলেন্সে মদ বোঝাই। ভাবা যায়! কৌতুহলী মানুষ দৌড়ে, হেটে, ছুটে, ফেটে এসেছে। মারুফের জন্যই ড্রাইভারের দুরাবস্তা। গুরু সহ সবাই ধরা পড়ে যাবে। তাকে চলে যেতে দেখে, কষে কটা গালি দেয়। দেখে নেবে। খেয়ে ফেলবে। মারুফ অবাক হয়! অল্প সময়ের জন্যে হলেও দেখাদেখি হয়েছে। রুগী টানা গাড়িতে যে মদ বোঝাই করে আনতে পারে তার পক্ষে মানুষ, বিড়াল, কুকুর, শিয়াল সবই খেয়ে ফেলা সম্ভব।
পাশে দাঁড়ানো এক বয়স্ক লোক প্রশ্ন করে, কি সমস্যা বাবা ?
- তেমন কিছু না। হনু তো তাই।
- হনু কী! হনুমানের অর্ধেক কিছু?
- না।
- তাহলে কী?
বয়স্ক মানুষকে বোঝানো দারুণ কষ্ট। এজন্য বয়স্ক মানুষকে স্কুলে পড়তে, ভর্তি হতে দেখা যায়না। মারুফ একেবারে সহজ করে বোঝায়, হনু কিভাবে হয় আর তাদের কাজ কি তা নিয়ে বিষদ চিন্তা ভাবনা করিনি। শুধু এটুকু বুঝেছি হনুরা সমস্যা বা কারন ছাড়াই মানুষ কে গালি দেয়। হনুরা যাকে তাকে গালি দিতে পারে।
মোবাইল বেজে ওঠে। বউয়ের হুংকার শোনা যায়। সংসারের প্রতি কোন খেয়াল আছে। এই ব্যাটা রাত কতো হলো খেয়াল আছে?
মারুফ একটা র্দীঘশ্বাস ছেড়ে আপন মনে বলে, সংসার!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন