বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

মেয়ে ডাক্তার, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার–এ নিয়ম আর কত দিন

ফুয়াদ খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৫ এপ্রিল, ২০১৯, ৭:৪৭ পিএম

‘মেয়ে হলে ডাক্তার আর ছেলে হলে ইঞ্জিনিয়ার’–এটা আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত একটা ধারণা। সন্তান জন্মের পর এমনটাই ধরে নেন পরিবারের সদস্যরা। সন্তান জন্মানোর আগেই অবশ্য এ ধরনের হিসাব করে ফেলি। সন্তান হওয়ার পরে যখন কেউ ফোন করে জিজ্ঞেস করে কী সন্তান হয়েছে? ছেলে না মেয়ে? তখন বাবা একগাল হেসে বলেন, ‘আমার ঘরে একটা ডাক্তার হয়েছে’।

একবার ভেবে দেখুন। আমাদের সমাজের যত মানুষ আছে, তাদের সবাইকেই কিন্তু তাদের বাবা-মা অথবা কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীর ইচ্ছা অনুযায়ীই নিজেদের ক্যারিয়ার পছন্দ করতে হয়। সবাইকে বলতে পারবে যে, আমার সন্তান ডাক্তার, আমার সন্তান সিএসই ইঞ্জিনিয়ার। এর পিছনে অন্যতম আরেকটি কারণ দেখা যায়, সেটি হচ্ছে অর্থ। অর্থের হিসাব করেই আজকাল সবাই সাবজেক্টের মানদণ্ড দাঁড়া করাচ্ছে। যে বিষয়ে অর্থ যত বেশি, সে বিষয়েই সন্তানকে পড়তে হবে। হয়তো আপনি ইলেকট্রিক্যালে পড়তে চাচ্ছেন, আপনার পরিবার বলবে–‘না, না, এখন এ বিষয় নিয়ে পড়া যাবে না। মার্কেটে এই সাবজেক্টের অবস্থা ভালো না। এখন সিভিল বেশ ভালো চলছে। ওইখানে ভর্তি হও।’

ফলে আপনাকে ভর্তি হতে হলো সিভিল বিষয়ে। আসলে পরিবার যে সন্তানের খারাপ চায়, ঠিক তা-ও না। তারা সবসময়ই চান তাদের সন্তান ভালো থাকুক। ভালোভাবে নিজের জীবনকে উজ্জ্বল করুক। কিন্তু অনেক সময় অতিরিক্ত ভালো চিন্তা করতে গিয়েই হিতে বিপরীত হয়ে যায়। টাকা আর ভালো ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করতে গিয়ে যে সন্তানের ইচ্ছেটাকে মেরে ফেলা হচ্ছে, তা একবারের জন্যও ভেবে দেখে না কেউ।

আপনার আশেপাশের মানুষদেরকে প্রশ্ন করে দেখবেন, তোমার সবচেয়ে পছন্দের কয়েকটা মুভির নাম বলো? দেখবেন, কয়েকটা নামের মধ্যে ‘থ্রি ইডিয়টস’ অবশ্যই থাকবে। কারণ হচ্ছে এই মুভিতে যে সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরা হয়েছে, আমাদের বেশিরভাগ মানুষকে ঠিক একই ধরনের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে এবং হচ্ছে।

কোনো ছেলের হয়তো স্বপ্ন ছিল ফটোগ্রাফার হবে কিন্তু তাকে হতে হচ্ছে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কেউ হয়তো মাঠে খেলতে চেয়েছিল দেশের জন্য কিন্তু তাকে এখন ব্যাংকে চাকরি করতে হচ্ছে। কেউ বা হতে চেয়েছিল বড় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে চেয়েছিল তার উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে, কিন্তু আজ সে হাসপাতালে বসে রোগী দেখছে। এইভাবে প্রতিনিয়তই আমাদের সবার স্বপ্নগুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে।

পৃথিবীর উন্নত কোনো রাষ্ট্রে কিন্তু এ ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় না কাউকে। সেখানে যার যেটা হতে ইচ্ছে করে, সে সেটাকেই নিজের জীবনের টার্গেট পয়েন্ট হিসেবে ঠিক করে নেয়। আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম। প্রতি বছর এই বিভাগে ছেলে-মেয়েসহ খুব বেশি হলে ৬০ জন পড়ার সুযোগ পায়। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে থেকে এই ৬০জনকে বাছাই করা হয়। তারপরেও যখন আমাকে কেউ প্রশ্ন করত যে, কোন সাবজেক্ট?

–জি, নৃবিজ্ঞান।

–এইটা আবার কি? কোনো দিন তো শুনি নাই।

–জি এটা আসলে সমাজবিজ্ঞানের একটা সাবজেক্ট।

আর কিছু বলার আগেই তার চেহারাতে একটা বিরক্ত ভাব চলে আসত। তারপর শুরু হতো–লাভ কি এই সাবজেক্টে পড়ে? কোনো লাভ নাই। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি কেন হলে না। কেন যে এইসব ছাইপাসে ভর্তি হও। এখন সিএসই বেশ ভালো চলছে। এখনো সময় আছে। এখান থেকে বের হয়ে সিএসইতে কোনো প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হও।

এসব ছিল আমার প্রায় নিত্যদিনের সঙ্গী। এর মধ্যে যদি আবার কেউ পরিবারের অমতে নিজের পছন্দের কোনো বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করে, তাহলেই হয়েছে। গোষ্ঠীর সবাই মিলে লেগে পড়বে তার পেছনে। পাস করার পরে চাকরি পাচ্ছেন না, ‘আগেই বলেছিলাম, এই বিষয়ে না যেতে। তখন তো শুনোনি, অমুকের ছেলে ডাক্তার আর তুমি এখনো চাকরি খুঁজে বেরাচ্ছো, নিজের হাতেই তুমি নিজের লাইফটা কে শেষ করেছ।’ এ ধরনের কত কথা যে শুনতে হবে, তার কোনো হিসাব নেই। এইভাবে চলতে চলতে একটা সময় সেই ছেলেটাও হতাশ হয়ে পড়ে।

এই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নিয়মটা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে এবং এর জন্যেই আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুব অল্প বয়সেই ডিপ্রেশন এসে ভর করে। সাবজেক্ট দিয়েই সবাই মেধার মূল্যায়ন করে ফেলছে খুব সহজেই। ‘এই ছেলেটা সায়েন্সে পড়ে, বাহ খুব মেধাবী তো। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে।’ ‘ওই মেয়েটা কমার্সে পড়ে, মেধা তো ভালোই ছিল। সায়েন্সে গেল না কেন? আচ্ছা সমস্যা নেই ব্যাংকার হতে পারবে।’ ‘ওই ছেলেটা মানবিকে পড়ে। মানবিক? নির্ঘাত মাথায় কিছু নেই। তা না হলে ঠিকই সায়েন্স বা কমার্সে যেত।’

এই ধরনের হিসাব কিন্তু আমরা খুব সহজেই করে ফেলি। অথচ আমাদের মাথায় এটা আসে না কমার্সে পড়েও সে হতে পারে দেশের বড় একজন ব্যবসায়ী, মানবিকে পড়ে হতে পারে দেশের সেরা অর্থনীতিবিদ অথবা বিশ্বসেরা সমাজকর্মী থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু হতে পারে।

এই চাপিয়ে দেওয়া নীতির কারণে আমাদের আশপাশে প্রতিনিয়তই সুইসাইডের ঘটনা ঘটছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করার পরেও অনেকে হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। ছোট ছোট ভাই-বোনেরা একটু রেজাল্ট খারাপ করলেই, মেডিকেলে চান্স না পেলেই, কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলেই এই ধরনের কাজ করছে। এর কারণ কী? কারণ হচ্ছে বাবা-মাকে মুখ কী করে দেখাবে? মানুষ কী বলবে?

অথচ আজ যদি তারা নিজেদের পছন্দ মতো ক্যারিয়ার গড়তে পারত, তাহলে হয়তো পকেটে টাকা না থাকলেও কাজের মধ্যে একধরনের আত্মতৃপ্তি খুঁজে পেত। এই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের লোভে আমরা আমাদের নিজেদেরকে শেষ করে দিচ্ছি। ছেলে-মেয়েদের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছি শুধু বইয়ের বোঝা। এর ফল অনেকেই হয়তো পাচ্ছেন। অনেকে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারও হচ্ছেন। অঢেল টাকার মালিকও হচ্ছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন তাদের ভেতরটা আজও পোড়ে।

দেশের সবচেয়ে নাম করা ডাক্তার জীবনের সবকিছু পেলেও যখন বাড়ির পাশের কোনো ছাদে কেউ গিটার নিয়ে গান বাজায়, তখন তিনি এসে বারান্দাতে দাঁড়ান। তার চোখের পানিতে খুব আবছাভাবে একটা গিটার দেখা যায়। যে স্বপ্নটাকে অনেক আগেই হত্যা করা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন