শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে মামলা নিয়ে কত অর্থ ও সময়ের অপচয় হয়, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৩ মে, ২০১৯, ১২:১১ এএম

কী নিয়ে লিখব, ভেবে পাচ্ছি না। সোমবারের পত্রিকায় একটা সংবাদের শিরোনাম ছিল: মামলার দীর্ঘসূত্রতা। মামলার দীর্ঘসূত্রতা আমাদের দেশের যে বড় একটা সামাজিক সমস্যা, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
একত্রিত সমাজে প্রতিনিয়ত এমন এমন অনেক ঘটনাই ঘটে চলেছে, যেগুলো সামাজিক সমস্যা বলে অভিহিত হওয়ার দাবিদার। কিন্তু তার কয়টাই বা মামলা হিসেবে আদালতে উঠে আসে? এর কারণ ঘটনার যারা ক্ষতিগ্রস্তপক্ষ তাদের অনেকেরই ক্ষমতা এত কম যে, এ নিয়ে শহরের আদালতে যাওয়ার সাহস হয় না। কারণ আদালত পর্যন্ত যাওয়ার পর উকিলের মাধ্যমে আদালতে তোলাও ব্যয়সাপেক্ষ। সুতরাং, অনেকেই দরিদ্র বলে মামলা করতে শহরে যেতে সাহস পায় না। একে তো ঘটনার ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ, তদুপরি দরিদ্রের কারণে অর্থ ব্যয় করে শহরে যাওয়ার সাহস করে না অনেকেই।
গ্রামে আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বলে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি। অতীতে এমন এক সময় ছিল যখন গ্রামে বসেই অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ সমাজের নেতৃত্বাধীন লোকদের নিকট থেকে মামলার মূল লক্ষ্য তথা সুবিচার পেতে পারতো। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি, গ্রামের নেতৃত্বাধীন ব্যক্তিরা যারা গ্রামে মাতবর হিসাবে পরিচিত তারা চেষ্টা করতেন ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির একটা সুরাহা করে দিতে। কেউ যদি গোয়ার্তোমী করে তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকার করতো তাহলে তাদের ‘একঘরে’ ঘোষণা করে গ্রামের অন্যান্য লোকদের তাদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে তাদের জীবন অচল করে দিতো। যেহেতু গ্রাম জীবনে সামাজিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই একঘরে ঘোষিত হওয়াকে অত্যন্ত ভয় করতো তারা এবং মাতবরদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে রাজী হয়ে যেতো। এরকম দেখার অভিজ্ঞতা আমার প্রচুর রয়েছে। অবশ্য পরর্বতীকালে শহরে গিয়ে উকিলদের মাধ্যমে আদালতে যাওয়ার রেওয়াজ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের সুবিচার পাওয়ার ব্যাপার ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে গেছে। তেমনি শহরে আদালত ও উচ্চ আদালতে তাদের সুবিচার পাওয়াটা অনেকটা সময়সাপেক্ষ হয়ে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের উচ্চতম আদালতের এক মামলায় বিচারপতির উদ্বেগ প্রকাশ দুঃখজনক ঘটনার প্রমাণ বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সুপ্রিম কোর্টে মামলার জট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে গিয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টে বর্তমানে এত মামলা যে ফাইল রাখার জায়গা হয় না। এভাবে চলতে পারে না। এর সমাধান বের করতে হবে। গত রবিবার সকালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল কক্ষে একটি মামলার শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। এ সময়ে আদালতে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও সাবেক এটর্নি জেনারেল এ এম হাসান আরিফ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে শনিবার সুপ্রিম কোর্টের অডিটরিয়ামে জুডিসিয়াল রিফর্ম কমিটি ও জার্মান ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন বাংলাদেশ আয়োজিত দেশের মামলার বিচার সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়, প্রতিবেদনটি সম্পর্কে মাহমুদ হোসেন বলেন, উপস্থাপন করা সুপ্রিম কোর্টের মামলার প্রতিবেদন দেখে আমি প্রায় বিব্রত। এত মামলা। এভাবে চলতে পারে না। তিনি বলেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মামলাজট নিরসন বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতিকে নিয়ে বসব। সবাইকে বলব, যে এ অবস্থায় আপনারা কী করবেন, আপনারা দেখেন।
প্রধান বিচারপতি জানান, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে প্রায় পাঁচ লাখ পঁচিশ হাজার মামলা বিচারাধীন। ১৯৮২ সালে ছিল মাত্র ২৫ হাজার। আর যদি আগাম জামিনের বিষয়গুলো নিষ্পতি না করা হতো তাহলে সুপ্রিম কোর্টে মামলার পরিমাণ ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেতো। তিনি বলেন, প্রতিদিন মামলা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে মাত্র একজন বিচারক বিচারিক সেবা দিয়ে থাকেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মামলার পারস্পরিক বোঝাপড়া বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পতির মাধ্যমে নিষ্পতি হয়ে থাকে। সেখানে বড় জোর ১-১৫ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়ে থাকে আদালতে। আমাদের দেশে ঠিক এর বিপরীত। এ দেশে কেবল ১০-১৫ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়ে থাকে বোঝাপড়া বা বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে? আর ৮৫-৯০ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয় আদালতে।
যে বিষয় নিয়ে আজকের এ লেখা শুরু করে ছিলাম তা ছিল মামলা বাবদ আমাদের অর্থ ও সময় অপচয় নিয়ে। এ পর্যন্ত আলোচনায় আমরা বুঝতে পেরেছি যে, এ বিষয়ে আমাদের যে অর্থ ও সময়ের অপচয় হচ্ছে আমরা কখনো চিন্তা করে দেখিনি বলে এর মারাত্মক ক্ষতিকর দিক অনুধাবন করতে সক্ষম হইনি। অথচ যদি এ ব্যাপারে আমরা এর আগে চিন্তা করে দেখতাম তাহলে হয়ত এর প্রতিকারের কোনো বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারতাম। তা করিনি বলেই হয়ত আমরা ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রচুর অর্থ ও সময়ের অপচয় করে ফেলেছি।
মাননীয় বিচারপতিকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে, তিনি এ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি জাতির সামনে তুলে ধরে এ ব্যাপারে আরও অধিকতর ক্ষতির হাত হতে রক্ষা করতে আমাদের সামনে একটা সুযোগ এনে দিয়েছেন। আমাদের এখন কর্তব্য, মাননীয় প্রধান বিচারপতির উপস্থাপিত দিক-নির্দেশনার আলোকে জাতির যারা প্রকৃত মঙ্গলকামী তাদের নিজ নিজ করণীয় কর্মে এগিয়ে যাওয়া। নইলে আমরা আমাদের মতো দরিদ্র জাতির অর্থ ও সময়ের অপচয়ের মাধ্যমে আমরা শুধু আত্মঘাতী জাতি হিসাবেই বিশ্বে পরিচিতি লাভ করবো না, ইতিহাসে আমরা একটি মামলাবাজ জাতি হিসেবেও নিন্দাও কুড়িয়ে যাব বিশ্ববাসীর কাছে।
বর্তমানে আমরা শুধু অর্থ ও সময় অপচয়কারী জাতি হিসেবেই নিন্দিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। কিন্তু আমাদের এই আত্মঘাতী প্রবণতা বজায় থাকলে আমাদের জন্য আরেকটি উপাধি লাভ অবশ্যসম্ভাবী হয়ে উঠবে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারবো কোন্ ঘৃণ্য উপাধি আমাদের জন্য ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে।
আমরা সবাই জানি, মানুষ এ দুনিয়ায় জন্ম গ্রহণ করে ব্যক্তি হিসেবে, পরবর্তী কালে পিতামাতা, ভাইবোন প্রভৃতির মাধ্যমে একটি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাশাপাশি পাড়াপ্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলে গ্রামবাসী বা শহরবাসীতে পরিণত হয়। আরও পরবর্তী পর্যায়ে এরা একটা জাতিতে পরিণত হয়।
মানুষ যদিও ব্যক্তি হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে তবুও পরবর্তীকালে তারা এক সময়ে পরিবার, সমাজ ও জাতিতে পরিণত হয়। একইভাবে তারা পর্যায়ক্রমে মহাদেশবাসী বা বিশ্ববাসীতে পরিণত হয়। কিন্তু এরপরও আমাদের ব্যক্তিগত সত্ত¡া ধ্বংস হয়ে যায় না। মানুষের আরেকটি বৈশিষ্ট্য যে, তারা ব্যক্তিগতভাবে জন্মগ্রহণ করলেও পরবর্তীতে তারা পরিবার, পড়শী, গ্রামবাসী ও জাতিতে পরিণত হয়, তেমনি তাদের কোনো পর্যায়েই তাদের ব্যক্তিগত পরিবারগত, গ্রামবাসী বা শহরবাসী হিসেবে তাদের বৈশিষ্ট্য কখনও নষ্ট হয় না। সুতরাং, আমাদের প্রতিটি পর্যায়ের পরিচয়ের সাথে আরেকটি পর্যায়ের সত্ত¡াগত মিল যেমন বিপুপ্ত হয় না, তেমনি বিভিন্ন পর্যায়ের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যও কখনও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় না। এই বাস্তবতাটা প্রতিটি ব্যক্তি মানুষকে মনে রাখতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন