শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খোশ আমদেদ মাহে রমজান সংখ্যা

রোজা ও তার মর্মকথা

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

মহান আল্লাহ পাক আল-কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে।’ (সূরা বাকারাহ)

রোজার মর্ম
রোজা হচ্ছে ইসলামী ইবাদতের তৃতীয় রোকন। আরবী ভাষায় রোজাকে সাওম বলা হয়। যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে চুপ থাকা, বিরত থাকা। কোনো কোনো মুফাচ্ছিরীনের বিশ্লেষণ মোতাবেক, সাওমকে কখনও কখনও ছবরও বলা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে, নিজেকে দৃঢ়তার সাথে নিবৃত্ত রাখা এবং সুদৃঢ় পন্থায় দৈহিক চাহিদাসমূহকে সংযত রাখা। এই অর্থসমূহের দ্বারা বোঝা যায় যে, ইসলামী পরিভাষায় রোজার প্রকৃত অর্থ ও মর্ম কি? বস্তুত রোজা হচ্ছে নফসের খাহেশ ও আশা-আকাক্সক্ষাসমূহকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সংযত রাখা এবং লোভ-লালসা উৎসাহব্যঞ্জক রঙিন পরিমন্ডলে নিজের দেহ-মন-প্রাণকে সংযত, সুদৃঢ়ভাবে বিমুক্ত রাখা। ব্যবহারিক জীবনে প্রাত্যহিক কর্মকান্ডের মাঝে সাধারণত নফসানী খাহেশসমূহ এবং মানবিক লোভ-লালসা ও উচ্চাকাক্সক্ষাসমূহের বিকাশস্থল হচ্ছে তিনটি। যথা- খাদ্য, পানীয় এবং নারী। এই তিনটি উপকরণ এবং উপায় থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দৈহিক ও আত্মিক সম্পর্কসমূহকে সংযত ও সুসংহত রাখার নামই শরীয়ত মোতাবেক রোজা। কিন্তু একই সাথে এ সকল বাহ্যিক খাহেশের সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ খাহেশসমূহও অমঙ্গল চিন্তা-ভাবনা হতে অন্তর ও যবানকে হেফাজত রাখার নাম বিশেষ শ্রেণীর নিকট রোজার মর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

রোজার প্রাথমিক ইতিহাস
রোজার প্রাথমিক ইতিহাস জানা যায় না। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত দার্শনিক স্পেন্সার তার বই চৎরহপরঢ়ষবং ড়ভ ঝড়পরড়ষড়মু-তে কতগুলো বন্য সম্প্রদায়ের উদাহরণ এবং জীবনবৃত্তান্তের ওপর কিয়াস করে লিখেছেন যে, রোজার প্রাথমিক মানদন্ড এভাবেই হয়তো হয়ে থাকবে যে, আদিম বন্য যুগের মানুষ স্বভাবতঃই ক্ষুৎ-পিপাসায় আক্রান্ত থাকত এবং তারা মনে করত যে, আমাদের আহার্যবস্তু আমাদের পরিবর্তে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃতদের নিকট পৌঁছে যায়। কিন্তু অনুমানসিদ্ধ উপাত্তকে যুক্তি ও বুদ্ধির আওতাভুক্ত করা লোকেরা কখনও স্বীকার করে নেননি। (ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা : ১০ম খন্ড, ১৯৪ পৃষ্ঠা, একাদশ সংস্করণ) মোটকথা, অংশীবাদী ধর্মমতগুলোতে রোজার প্রারম্ভ এবং হাকীকতের যে কোনো কারণই হোক না কেন ইসলামের দৃষ্টিতে এর প্রাথমিক পর্যায় ও শেষ পর্যায়কে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে নিজের অনুসারীদের ওকালতির প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করে না। ইসলামের মূল উৎস কুরআনুল কারিম নাজিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পরিপূর্ণ হেদায়েত, পথ প্রদর্শনের দলিল এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী। “সুতরাং তোমাদের মাঝে যে এই মাসকে পাবে তাকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। আর যদি কেউ রুগ্ন হয় কিংবা সফরে থাকে তাহলে সে সমপরিমাণ রোজা অন্যান্য দিনসমূহে আদায় করবে। আল্লাহপাক তোমাদের আসানী কামনা করেন এবং তোমাদের ওপর কাঠিন্য আরোপিত হোক তা কামনা করেন না। যেন তোমরা রোজার নির্দিষ্ট পরিমাণকে পরিপূর্ণ করতে পার এবং (এই রোজা এজন্য ফরজ হয়েছে) যাতে করে তোমরা এই হেদায়েত মোতাবেক আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পার এবং যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হতে পার।” (সূরা বাকারাহ: রুকু-২৪) এই পবিত্র আয়াতসমূহে শুধু কেবল রোজার কতিপয় আহকামই বর্ণনা করা হয়নি; বরং রোজার ইতিহাস, রোজার হাকীকত, রমজানের বিশেষত্ব এবং রোজার প্রতি আরোপিত অভিযোগসমূহের প্রত্যুত্তরসমূহ বিস্তারিতভাবে এবং চিত্তাকর্ষকরূপে বিবৃত করা হয়েছে। পরবর্তী আলোচ্য বিষয়াদির মাঝে শ্রেণীবিন্যাস সহকারে এ সকল বিষয়ের প্রতি আমরা অবশ্যই আলোকপাত করতে যত্মবান হব।

রোজার ধর্মীয় ইতিহাস
কুরআনুল কারীমের উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহে সুস্পষ্টভাবে এ কথা তুলে ধরা হয়েছে যে, বর্তমান ইসলামের সাথেই শুধু কেবল রোজার সম্পৃক্ততা সুনির্দিষ্ট নয়; বরং কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী মাযহাবগুলোতেও রোজাকে একটি ধর্মের বিশেষ অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অন্ধকার যুগের আরবদের সামনে রাসূলুল্লাহ সা. উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসের মাঝে রোজা অবশ্যই ফরজ ইবাদত হিসেবে পরিগণিত ছিল। কিন্তু তৎকালীন আরবের বিরুদ্ধবাদী সম্প্রদায় এমনকি বর্তমান যুগের কোনো কোনো পন্ডিত ব্যক্তিরাও মনে করেন যে, রাসূলুল্লাহ সা. প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সা.-এর দাবি যদি সর্বাংশে সত্য ও যথার্থ বলে প্রতিপন্ন হয় তাহলে এ কথা মেনে নিতে দ্বিধা- সংকোচের অবকাশ মোটেই থাকবে না যে, তিনি উপাদানভিত্তিক জ্ঞানবত্তার ঊর্ধ্ব পরিমন্ডলে অবশ্যই অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই দাবির সত্যতা প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে ইউরোপের অধিক প্রামাণ্য গ্রন্থের উদ্ধৃতি আমরা পেশ করছি, যা অনুসন্ধানীদের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবে। ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার রোজার প্রবন্ধ লেখক (ঋধংঃরহম) উল্লেখ করেছেন যে, ‘রোজার বিধিবিধান ও আদায় পদ্ধতি, আবহাওয়া, সামাজিক ব্যবস্থা এবং সভ্যতা বিবর্তনের দরুন যদিও বিভিন্ন রূপ পরিদৃষ্ট হয় তথাপি আমরা অতি কষ্টে এমন কোনো ধর্মের নাম উপস্থাপন করতে পারব না, যেখানে রোজাকে ধর্মীয় বিধানের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করা হয়নি।’ সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, ‘বস্তুত রোজা একটি ধর্মীয় প্রথা হিসেবে সকল স্থানেই স্বীকৃত আছে।
ভারতবর্ষকে ধর্ম বিকাশের সবচেয়ে পুরাতন স্থান হিসেবে দাবি করা হয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, এই ব্রত অর্থাৎ রোজা থেকে এখানকার ধর্মগুলোও বিমুক্ত ছিল না। ভারতীয় বর্ষপঞ্জিতে প্রতি মাসের এগারো ও বার তারিখে ব্রাহ্মণদের ওপর একাদশীয় রোজা অপরিহার্য ছিল। এই হিসাব অনুসারে বার মাসে সর্বমোট ২৪টি রোজা পাওয়া যায়। কোনো কোনো ব্রাহ্মণ কার্তিক মাসে প্রত্যেক সোমবারে রোজা ব্রত পালন করে। হিন্দু যোগীরা চিল্লা পালন করে অর্থাৎ তারা চল্লিশ দিন পর্যন্ত পানাহার বর্জন করে উপোস থাকার প্রচেষ্টা চালায়। ভারতবর্ষের সকল ধর্মমতে বিশেষ করে জৈন ধর্মের মাঝে রোজা পালনের শর্তাবলি অত্যন্ত কঠিন। তাদের মতানুসারে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ১টি রোজা প্রলম্বিত হয়। গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যে প্রতি বছর জৈন ধর্মের অনুসারীরা কয়েক সপ্তাহ যাবৎ রোজা ব্রত পালন করে। প্রাচীন মিসরীয়দের মাঝেও রোজাকে অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির অন্তর্ভুক্ত দেখা যায়। গ্রিক ধর্মানুসারীদের মাঝে শুধু কেবল মহিলারা থাসমো ফেরিয়া-এর ৩য় তারিখে রোজা রাখত। পার্শিয়ান ধর্মে যদিও সাধারণ অনুসারীদের ওপর রোজা ফরজ নয়। কিন্তু তাদের ইলহামী কিতাবের একটি শ্লোক দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাদের ওপর রোজার হুকুম প্রযোজ্য ছিল। বিশেষ করে ধর্মীয় নেতাদের জন্য পাঁচ বছর রোজা রাখা আবশ্যক ছিল। (ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা : ১০ম খন্ড, ১৯৩-৯৪ পৃষ্ঠা, একাদশ সংস্করণ) ইহুদিদের মাঝেও রোজা ছিল আল্লাহর আরোপিত ফরজ ইবাদত। হযরত মুসা আ. কুহে তুরে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ক্ষুৎ-পিপাসার ভেতর দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। (নির্গমন : ৩৪-৩৮) সুতরাং সাধারণভাবে হযরত মুসা আ.-এর অনুসারীদের মাঝে চল্লিশ দিন রোজা রাখাকে উত্তম বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু তাদের ওপর চল্লিশতম দিনে রোজা রাখা ফরজ যা তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ পড়ত। (তৌরাত: সফরুল আহবার: ১৬-২৯-৩৪ : ২৩-২৭) এ জন্য এই দশম দিনকে আশুরা বলা হতো। আর আশুরার এই দিনটি ছিল ঐ দিন যেদিন হযরত মুসা আ.-কে তৌরাতের ১০টি আহকাম দান করা হয়েছিল। এজন্য তৌরাত কিতাবে এই দিনের রোজাকে পালন করার প্রতি জোর তাকিদ করা হয়েছে।
বস্তুত উপরোল্লেখিত দিকনির্দেশনা ছাড়া ইহুদীদের অন্যান্য ছহীফাসমূহের মাঝে অন্যান্য দিনের রোজার হুকুম-আহকামও বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায়। (প্রথম শামুয়েল ৭-৬ এবং ইয়ারমিয়া ৩৬-৬) খ্রিষ্টান ধর্মে বর্তমানকালেও রোজার প্রভাব বিদ্যমান। হযরত ঈসা আ.ও চল্লিশ দিন পর্যন্ত জঙ্গলে অবস্থান করে রোজা রেখেছেন। (মথি : ৪-২) হযরত ইয়াহইয়া আ. যিনি হযরত ঈসা আ.-এর সমসাময়িক ছিলেন তিনিও রোজা রাখতেন এবং তার উম্মতগণের মাঝেও রোজা রাখার রীতির প্রচলন ছিল। (মার্কস : ২-১৮) ইহুদীরা বিভিন্নকালে অসংখ্য ঘটনাবলির স্মৃতিস্বরূপও এর সাথে অনেকগুলো রোজা সংযোজন করেছিল। এর অধিকাংশই ছিল বেদনাময় স্মৃতির স্মরণিকা। এই সকল রোজার মাধ্যমে তারা নিজেদের অতীত বেদনাময় স্মৃতিগুলোকে উজ্জীবিত করে তুলত। এমনকি দেহ-মনের মাঝেও বেদনার ছাপ ফুটিয়ে তুলত। (কোযাত ২০-২৬, ১ম শামুয়েল ৭-৬ ও ৩১-১৩ এবং লুক : ৬-১৬) হযরত ঈসা আ. স্বীয় আমলে কিছুসংখ্যক রোজা রাখার অনুমতি বা অবকাশও ছিল। একবার কতিপয় ইহুদী সমবেত হয়ে হযরত ঈসা আ.-এর নিকট এই আপত্তি উত্থাপন করল যে, তোমার অনুসারীরা কেন রোজা রাখছে না। হযরত ঈসা আ. এর জবাবে বললেন, ‘তবে কি বরযাত্রীগণ যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে অবস্থান করে তারা ততক্ষণ পর্যন্ত রোজা রাখতে পারে না। সুতরাং এমন এক সময় আসবে যখন দুলা তাদের সাথে থাকবে না তখন তারা রোজা রাখবে।’ (মার্কস : ২-১৮)
এই দিকনির্দেশনায় দুলা বলতে নির্দেশ করা হয়েছে হযরত ঈসা আ.-এর পবিত্র সত্তাকে এবং বরযাত্রী বলা হয়েছে তার অনুসারী হাওয়ারীদেরকে। একথা সুস্পষ্ট যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো নবী স্বীয় উম্মতের মাঝে অবস্থান করেন ততক্ষণ উম্মতদের শোক পালনের কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় না। সুতরাং উপরোল্লেখিত বর্ণনার দ্বারা বোঝা যায় যে, হযরত ঈসা আ. হযরত মুসা আ.-এর আমলে প্রবর্তিত ফরজ এবং মুস্তাহাব রোজাসমূহকে নয়; বরং শোক পালনার্থে প্রচলিত নব্য রোজার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন এবং তিনি স্বীয় অনুসারীদেরকে পূর্ণ আন্তরিকতা ও বিশুদ্ধচিত্ততার সাথে রোজা রাখার উপদেশ প্রদান করতেন। যেমন ‘অতঃপর তোমরা যখন রোজা রাখবে তখন লোক দেখানো মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষের মতো নিজেদের মুখমন্ডলকে উদাস করে রাখবে না। কেননা, এ শ্রেণীর লোক নিজেদের মুখমন্ডলের আসল রূপ বিকৃত করে ফেলে যেন মানুষ মনে করে যে, তারা রোজাদার। আমি তোমাদের কাছে সত্য কথাই বলছি। এ শ্রেণীর লোকেরা তাদের বিনিময় পেয়ে গেছে। সুতরাং তোমরা যখন রোজা রাখবে তখন মাথায় তেল ব্যবহার করবে, মুখমন্ডল ধৌত করবে। এতে করে তোমরা মানুষের নিকট নয়; বরং তোমাদের পিতার নিকট গোপনীয়ভাবে অবস্থান করবে। তোমরা যারা রোজাদার তা সুস্পষ্ট এবং তোমাদের পিতার নিকট যা প্রচ্ছন্ন ও গোপনীয় তিনি তার সরাসরি প্রতিফল ও বিনিময় অবশ্যই প্রদান করবেন।’ (মথি : ৬-৬-৭) অপর এক স্থানে হযরত ঈসা আ.-এর নিকট তাঁর অনুসারীরা জিজ্ঞেস করল যে, আমরা আমাদের অপবিত্র অন্তরসমূহকে কীভাবে দূর করে দিতে সক্ষম হব? প্রত্যুত্তরে হযরত ঈসা আ. বললেন, অন্তরসমূহের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে দোয়া এবং রোজা ছাড়া দূর করার কোনো ব্যবস্থা নেই। (মথি : ১৭-২১)
আরববাসীরাও ইসলামের পূর্বে রোজা সম্পর্কে কম-বেশি ওয়াকিবহাল ছিল। মক্কার কোরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ই মুহররম) দিনে এ জন্য রোজা রাখত যে, এই দিনে খানায়ে কাবার ওপর নতুন গেলাফ চড়ানো হতো। (মুসনাদে ইবনে হাম্বল : ষষ্ঠ খন্ড, ২৪৪ পৃ:) মদীনায় বসবাসকারী ইহুদীরাও পৃথকভাবে আশুরা উৎসব পালন করত। (সহীহ বুখারী : কিতাবুস সাওম, ১ম খন্ড, ১৬২ পৃ:) অর্থাৎ ইহুদীরা নিজেদের গণনানুসারে ৭ম মাসের ১০ম দিনে রোজা রাখত।
উপরোক্ত বিশ্লেষণের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, কুরআনুল কারীমের নির্দেশ, ‘তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল’ কতখানি ঐতিহাসিক সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

রোজার হাকীকত
মানুষের সকল প্রকার আত্মিক অবনতি ও দুর্ভাগ্যসমূহকে এবং তার অসফলতার কার্যকারণসমূহ যদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে সর্বশেষ পরিণাম ফল এই দাঁড়াবে যে, পৃথিবীর বুকে মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনসমূহের প্রতি মুখাপেক্ষী এবং তারা বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসরণ করে চলে। তাদের অন্তরের যে কোনো অনুকম্পন এবং তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বস্তুত যাবতীয় চেষ্টা ও তদবীর কোনো প্রয়োজন এবং উদ্দেশ্য থেকে খালি নয়। নৈতিক অবস্থা যার সার্বিক সম্পর্ক আত্মিক অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। যদি এর তাহকীক করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, এর ভিত্তিও সাধারণত কোনো না কোনো প্রয়োজন অথবা গরজে নফসানীর ওপর অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত। এ জন্য আমাদের সকল প্রকার দুর্ভাগ্য, অপবিত্রতা এ সকল কারণেরই ফলশ্রুতি মাত্র। সুতরাং প্রয়োজন এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যদি সম্পূর্ণরূপে অমুখাপেক্ষী ও বিমুক্ত হয়ে যায় তাহলে সে আর মানুষরূপে বরিত হবে না, বরং তাকে ফেরেশতা বলাই সমীচীন হবে।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, মানুষের প্রয়োজনসমূহ এবং তাদের বিভিন্নমুখী আশা-আকাক্সক্ষা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা একটি বৃহত্তর পরিসরে সীমাহীনরূপে পরিদৃষ্ট হয় এগুলোর আসল হাকীকত কী? আমাদের অন্তরে রয়েছে আশা-আকাক্সক্ষার একটি খনি এবং ইচ্ছা ও অভিব্যক্তির সুবিশাল প্রান্তর এবং সেখানে অবস্থান করছে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অসংখ্য প্রয়োজনীয়তার অগণিত সম্ভার। কিন্তু তাই বলে কি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাকাদি, আলীশান ইমারতরাজি, সুস্বাদু আহার্য সামগ্রী এবং দ্রুতগামী যানবাহনসমূহ ছাড়া আমরা বেঁচে থাকতে পারি না? আমাদের সন্তানসন্ততি, পরিবার-পরিজন, অর্থ-সম্পদ এবং আমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও চাকর-বাকরদের পরিবেষ্টিত অবস্থার বিপরীত পরিমন্ডলে আমাদের জীবনীশক্তি ও ব্যক্তিসত্তার কি সমাধি রচিত হয়ে যাবে? অনেক রাজা-বাদশাহ ফকীরদের মতো জীবন অতিবাহিত করেছেন। সাধারণ্যে প্রচলিত কথায় জানা যায়, ইব্রাহীম আদহাম বাদশাহ হয়েও ফকীরী গ্রহণ করেছিলেন এবং আনন্দ ও পরিতৃপ্তির সাথে রূহানী জিন্দেগী অতিবাহিত করেছিলেন।
স্বীয় উদ্ভাবিত প্রয়োজনসমূহের বিলুপ্তি এবং বিস্মৃতির পর মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয়তাসমূহের বিস্তৃত পরিমন্ডল হয়তো সামান্য দু-একটি বিন্দুর মতোই থেকে যাবে এবং তাহলো শক্তি ও গেজা অর্থাৎ দানা এবং পানি যা ব্যতীত মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। রূহ এবং প্রাণের দেহের মাঝে অবস্থিতি শুধু সদ্দে রমক (শুধু কেবল প্রাণ রক্ষা পায় এ পরিমাণ) হলেই অব্যাহত থাকে। সদ্দে রমক শুধু কয়েক লোকমা আহার্য এবং কয়েক ঢোক পানির ওপরই নির্ভরশীল। এ কথা সত্যি যে, এরপর মানুষের সকল প্রয়োজনের উৎস ও উৎপত্তিস্থল এ সকল কয়েক লোকমা খাদ্য এবং কয়েক ঢোক পানির সুবিস্তৃত অবস্থা ও স্বল্পতাহেতু জটিলতার পরিমাণ মাত্র। এই দৃষ্টিকোণ থেকে একজন মানুষ এবং একজন ফেরেশতা অর্থাৎ আলমে নাসুত এবং আলমে মালকুতেন দুই বাসিন্দাদের মাঝে বিভেদ ও পার্থক্যের দেয়াল যদি কায়েম করা যায় তাহলে শুধু এই জিনিসটিই যাবতীয় পৃথকীকরণ ও শ্রেণীভেদকে পরিবেষ্টন করে রাখবে। মানুষের সকল প্রকার অপরাধ ও গোনাহসমূহের সূচি যদি তৈরী করা যায় এবং লোভ-লালসা এবং হত্যা ও রক্তপাতের সর্বশেষ কারণসমূহ যদি তালাশ করা হয় তাহলে সেই দুটো জিনিসের বিস্তৃতি ও স্বল্পতা এবং জীবন ধারণের জন্য কঠিন পরিশ্রমের একমাত্র উপাদান হিসেবেই এগুলোকে অনুভব করা যাবে।
এ সকল কারণে দুনিয়ার সকল মাযহাবে বস্তুভিত্তিক অপবিত্রতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র থাকার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকাকে প্রাথমিক অপরিহার্য শর্ত হিসেবে স্থিরীকৃত করেছে। এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, মানুষ যেন পর্যায়ক্রমে নিজের প্রয়োজনীয়তাসমূহের পরিমন্ডলকে সংক্ষিপ্ত এবং সঙ্কুচিত করে তোলে এবং শক্তি ও আহার্যের অনুসন্ধান এবং লোভ-লালসা থেকে নিস্তার লাভের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা জারি রাখে। কেননা, মানুষের যাবতীয় অপরাধ ও গুনাহসমূহ এই একক শক্তিমত্তার সর্বশেষ পরিণাম ফল। যদি এই অন্বেষা ও প্রয়োজনীয়তা দূরীভূত হয়ে যায়, তাহলে ক্রমাগতভাবে আমরা আলমে নাসুতে অবস্থান করেই আলমে মালাকুতের সমুজ্জ্বল প্রভা ও দীপ্তি অবলোকন করতে সক্ষম হব। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ শুধু কেবল মানুষ হিসেবেই অবস্থান করবে ততক্ষণ পর্যন্ত আহার্য বস্তু হতে সামগ্রিকভাবে অমুখাপেক্ষী হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে এ সকল আবিলতা হতে মুক্ত থাকার জন্য বিশ্বের সকল ধর্মেই একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই সময়সীমার মাঝে সকল মানুষই মানবিক প্রয়োজনীয়তার নিগঢ় হতে স্বল্প সময়ের জন্য বিমুক্ত থাকতে পারে এবং এই স্বল্প সময়ের মনোনিবেশ দ্বারা মালায়ে আলা- ঊর্ধ্ব জগতের পবিত্রতম পরিমন্ডলে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। যেহেতু এই পৃথিবীর জীবন কেবলমাত্র আল্লাহ পাকের ইবাদত ও বন্দেগীর মাঝেই অতিবাহিত করতে হবে সেহেতু এ পৃথিবীর সকল ধর্মের মানুষই নিজেদের জীবন পরিক্রমার স্বল্পতম সময়ে যথাসম্ভব রোজার ভেতর দিয়ে সেই দায়িত্ব ও কর্তব্যকে পালন করতে পারে।
কুরআনুল কারীমে সিয়াম সাধনার এ সকল হাকীকত ও মানদন্ডকে শুধুমাত্র একটি শব্দের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সে শব্দটি হলো তাকওয়া বা পরহেজগারী। রোজার হাকীকত ও বিশেষত্ব সুলভ তাকওয়া ও পরহেজগারী পৃথিবীর সকল ধর্মেই একইভাবে অবলম্বন করা হয়েছে। এ কারণে কুরআনুল কারীম ও অন্য ধর্মগুলোকে রোজার এই অভ্যন্তরীণ হাকীকতের সাথে সম্পৃক্ত করে ঘোষণা করেছে, ‘তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল যাতে করে তোমরা তাকওয়া ও পরহেজগারী অর্জন করতে পার।’ (সূরা বাকারাহ: রুকু ২৩)
প্রকৃতপক্ষে রোজার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে তাকওয়া ও পরহেজগারী অর্জন করা। অর্থাৎ নিজের খাহেশাতকে নিজের আওতাভুক্ত রাখা এবং দৈহিক কামনা-বাসনার তীব্র প্রভঞ্জনের ছোঁয়াচ হতে নিজেকে বিমুক্ত রাখা। এর দ্বারা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, রোজা আমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে এক প্রকার রুহানী চিকিৎসা হিসেবে। শুধু তই নয়, আল-কুরআনে ইসলামে রোজার ওপর দুটো সুনির্দিষ্ট বিশেষত্বের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘যেন আল্লাহপাক তোমাদেরকে যে পথ প্রদর্শন করেছেন সে মোতাবেক তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পার এবং আল্লাহার শোকর গুজারী আদায় করো। (সূরা বাকারাহ: রুকু- ২৩)
এই মৌলিক দিকনির্দেশনার বিশ্লেষণ করার লক্ষ্যে আমাদেরকে অবশ্যই রমজানুল মুবারকের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা, রমজানের মূল হাকীকত অনুধাবন না করা পর্যন্ত এই বিশেষত্বটি আমরা পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হব না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন