বাম্পার ফলন হলেও ঝিনাইদহ অঞ্চলের বোরো চাষিদের মুখে হাসি নেই। বোরো ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে বর্গা চাষিরা বিঘা প্রতি জমিতে লোকসান দিচ্ছে ৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে নিজস্ব জমিতে ধান চাষ করে লাভের মুখ চোখে দেখছে না কৃষকরা। উপরন্ত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে বেশি দামে শ্রমিক কিনে তড়িঘড়ি করে ধান ঘরে তুলতে দ্বিগুণ খরচ গুনতে হয়েছে তাদের। এদিকে ধান চাষে লোকসানের পর ব্যাংক ঋণ, এনজিওর কিস্তি, মহাজন ও সার কীটনাশক ব্যবসায়ীদের দেনা শোধ করা দায় হয়ে পড়েছে। ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ঝিনাইদহের ছয় উপজেলায় ৯২ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, কিন্তু অর্জিত হয়েছে ৮৮ হাজার ৪০৫ হেক্টর। ডাল জাতীয় ফসলের আবাদ বেশি হওয়ায় বোরো চাষ কিছুটা কমে গেছে। ঝড় আর শিলাবৃষ্টির মধ্যেও কৃষকরা বাম্পার ফলন পেয়েছিল, কিন্তু দাম না থাকায় তারা পথে বসতে শুরু করেছে। এর আগে ভুট্টার কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পেয়ে হতাশ হন। দুই আবাদের চাষে সমান সমান আর বর্গা চাষিদের লোকসান গুনতে গিয়ে তারা অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলেছে। ঝিনাইদহের গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক শওকত আলী ও মিজানুর রহমান জানান, ৩৩ শতকে এক বিঘা জমিতে বোরো চাষ করতে এ বছর ১৪ হাজার টাকা খরচ রয়েছে। খাত ওয়ারি ধরা হলে সার ও ওষুধ বাবদ ৩ হাজার টাকা, সেচ ২৫’শ টাকা, লাগানো ১২’শ, নিড়ানো ৪’শ, মই দেওয়া ২০০, ধান কাটা ২৫’শ, ধান বাড়িতে আনা ১৫’শ, ধান ঝাড়া ১৫’শ ও জমি চাষ করতে ১২’শ টাকা। এই হিসেব নিজস্ব জমির মালিকদের। আর যারা বর্গা চাষি তাদেরকে ১৪ হাজার খরচের সাথে বিঘা প্রতি ৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে জমির মালিকদের। হিসাব করলে বর্গা চাষিরা ধান চাষ করে ৫ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার ভান্ডারদোয়া গ্রামের ভুট্টা চাষি সুকাল উদ্দীন জানান, এক বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেত ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আর ভুট্টা বিক্রি হয়েছে ২০/২১ হাজার টাকায়। নিজস্ব জমির মালিকরা বিঘা প্রতি জমিতে ১০ হাজার টাকা আর বর্গাচাষিরা ২/৩ হাজার টাকা লাভ করেছে। ভুট্টার দাম পেলে এই চাষে কৃষকরা আরো লাভবান হতো বলে তিনি মনে করেন। কৃষক মিজানুর রহমানের ভাষ্যমতে এ বছর ধান চাষ করে অধিকাংশ কৃষক দেনায় জড়িয়ে পড়েছে। ধান বিক্রি করে দায়দেনা শোধ করে অনেকের ঈদ হবে না বলে যোগ করলেন বংকিরা গ্রামের আরেক কৃষক আব্দুল আলীম। এদিকে কৃষকের কাছ থেকে ধান চাল বা গম কেনার বিধান থাকলেও ঝিনাইদহে তা করা হয় না। মিলার ও খাদ্য বিভাগের সিন্ডিকেট ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে রাতের আধারে গুদামে ধান চাল সরবরাহ করে থাকে। কৃষি বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, একজন কার্ডধারী কৃষকের নিকট থেকে ৭০ মণ ধান ন্যায্য মূল্যে ক্রয় করার নিয়ম রয়েছে। এ হিসেবে একজন কৃষক ১০৪০ টাক মন দরে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারতো। এই নিয়মে একজন কৃষক ধান দিতে পারলে তিনি বাজার (বাজারে ৭০০ টাকা ধানের মন) দর ছাড়া আরো ৩৪০ টাকা মন প্রতি বেশি পেতেন। এতে কিছুটা হলেও কষ্ট লাঘব হতো। কিন্তু‘ মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা মধ্যসত্ত্বভোগীদের কারণে এ দাম পাচ্ছে না। সরকারি ধান কে বা কারা গুদামে সরবরাহ করেন তা সাধারণ কৃষকরা জানেন না। বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জিএম আব্দুর রউফ জানান, উৎপাদ বেশি হওয়ায় ধানের দাম পড়ে গেছে। তাছাড়া বাজারের কিছু কারসাজিও এই দাম পড়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী। তিনি বলেন কৃষকরা সরকারের শর্ত পুরণ করতে পারে না বলে তারা ন্যয্যমুল্যে ধান বিক্রি করতে পারে না। এ জন্য মধ্যসত্বভোগীদের কবলে সরকারের কাছে ধান বিক্রির বাজার চলে গেছে। ঝিনাইদহের বিশিষ্ট চাল ব্যবসায়ী মোয়াজ্জেম হোসেন ধানের দাম কম থানার কারণ জানিয়ে বলেন, গত বছরের ধান চাল উদ্বৃত্ত রয়ে গেছে। এই কারণে চলতি বছরে ধানের দাম নেই। তিনি বলেন, গত বছর বেশি দামে ব্যাবসায়ীরা ধান কিনে ২০% লোকসান গুনতে হয়েছে। সেই ধান এখনো রয়েছে। ফলে বাজারে ধানের দাম বাড়ছে না বলে তিনি মনে করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন