শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের এক জননন্দিত মহান রাষ্ট্রনায়ক। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রণক্ষেত্রের বীর সেনানী, সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের প্রধান জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে এদেশের মানুষ প্রথম চিনতে পারে, তাঁর সম্পর্কে জানতে পারে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে কালুঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ইথারে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর থেকে। তবে বাংলাদেশে রাজনীতির মঞ্চে ও ক্ষমতার শীর্ষে তাঁর আবির্ভাব ১৯৭৫ সালে। এ বছর ১৫ আগষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মামন্তিক হত্যাকাণ্ডের পর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান যুগপৎভাবে সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করলে জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম দলীয় ভিত্তিতে ও প্রত্যক্ষ ভোটে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জিয়া। এভাবেই একজন সমর নেতা থেকে জিয়াউর রহমান একজন রাজনীতিবিদ জননেতা ও রাষ্ট্রনায়কে রূপান্তরিত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক জিয়ার মূল্যায়নের চেষ্টা বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবেই করার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু একজন শিক্ষাবান্ধব রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর শিক্ষা চিন্তা ও নীতি সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা তুলনামূলকভাবে কম পরিদৃষ্ট হয়। অথচ এক্ষেত্রে শহীদ জিয়া অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। ১৯ জানুয়ারি শহীদ জিয়া শুভ জন্মদিন। এদিনে তাঁকে সম্মান জানানোর নিমিত্তে শিক্ষা ক্ষেত্রে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবদান সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র অংকন আলোচ্য নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
শিক্ষা মানব জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। মানুষের জ্ঞান ও চিত্তের উৎকর্ষের জন্য, মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য, চরিত্র গঠন ও মানবীয় মূল্যবোধের জন্য,সর্বোপরি মানবস¤পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষা হচ্ছে প্রধান নিয়ামক। রাষ্ট্রপতি হিসেবে শহীদ জিয়া শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নকে তাঁর সরকার একটি প্রাধিকার খাত হিসেবে গ্রহণ করেছিল। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে শহীদ জিয়ারও একটি নিজস্ব চিন্তা ও দর্শন ছিল। তিনি স্বাধীন দেশের উপযোগী এবং উৎপাদনমূখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনে বিশ^াসী ছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর শহীদ জিয়া ঢাকায় একটি “জাতীয় শিক্ষা ওয়ার্কসপ” আয়োজন করেন। এতে শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত সারাদেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষাকর্মী এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণ উপস্থিত ছিলেন। শহীদ জিয়া এ ওয়ার্কশপে বারো ঘন্টাব্যাপী শিক্ষাকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের শিক্ষা বিষয়ক মতামত ধৈর্যের সাথে শুনেন এবং পরে প্রদত্ত গ্রহণযোগ্য মতামতের ভিত্তিতে তিনি নিজে একটি দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। জিয়ার এ বক্তব্যে তাঁর শিক্ষা চিন্তা ও দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়। জিয়াউর রহমান বিশ^াস করতেন যে, “শিক্ষা মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের মূল উপাদান।” তাই স্বাধীন জাতির আশা-আকাক্সক্ষাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সময়োপযোগী পরিবর্তন অত্যাবশ্যক বলে তিনি মনে করতেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে মৌল সমস্যাগুলো প্রতিবিধান করে বাস্তবমূখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে তাঁর সরকার প্রয়োজনীয় সম্পদ ও শক্তি নিয়োজিত করেছিল। জিয়াউর রহমান তাঁর শিক্ষা দর্শনের সাথে সঙ্গতিপূণ একটি সময়োপযুগী অন্তর্বর্তী শিক্ষানীতি প্রণয়ণের জন্য ১৯৭৮ সালে প্রফেসর মুস্তফা বিন কাসিমের নেতৃতে একটি জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি ১৯৭৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ‘অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি সুপারিশ’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে দেশে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় যাতে জনগণ দেশের উন্নয়নে ভ‚মিকা রাখতে পারে। এ রিপোর্টে বৃত্তিমূলক, কারিগরী, কৃষি ও চিকিৎসার সম্প্রাসারণে বিশেষ জোর দেয়া হয়। জিয়াউর রহমান নিজেও মনে করতেন যে, বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতি এবং দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির জন্য বৃত্তিমূলক কৃষি ও বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষার সম্প্রাসরণ একান্ত প্রয়োজন। শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র’ প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রের ২১ নং ধারায় বাংলাদেশে একটি ‘গণমুখী ও জীবননির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম’ চালুর প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল বিএনপি সরকার “এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষপাতী যা জাতীয় ঐক্য আনে, উৎপাদন বাড়ায় এবং ব্যক্তি ও সামাজিক উন্নয়নের নিশ্চয়তা দেয়।” শিক্ষিত যুব সমাজ যেন বেকারত্বের অভিশাপে নিপতিত না হয়, সেজন্য বিজ্ঞানভিত্তিক, কারিগরি ও বৃত্তিমূল শিক্ষার দ্রুত প্রসারে সরকারের সদিচ্ছার কথা ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল।
১৯৭৯ সালে ২ এপ্রিল জাতীয় সংসদে বক্তৃতাকালে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষাকে “জাতির জন্য কল্যাণকর” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি মনে করতেন “বাংলাদেশের অগণিত জনগণের উন্নতি ও ভবিষ্যৎ জাতীয় জীবনের বহুমুখী সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগ অপরিহার্য।” এ কারণেই তিনি ১৯৭৬ সালে “জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা পরিষদ” গঠন করেন। শহীদ জিয়া মনে করতেন গ্রামীণ ও পল্লী উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যাপক প্রয়োগ ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনায় উপযোগী প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যাপক প্রয়োগ ও ব্যবহার দরকার। আর এ জন্য তাঁর সরকার ‘পল্লী প্রযুক্তি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান’ গড়ে তোলেছিল।
বাংলাদেশে বিদ্যমান বাস্তবতায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার উপর জিয়াউর রহমান জোর দিয়েছিলেন সত্য, তবে একই সাথে তিনি মানবিক শিক্ষার অপরিহার্যতার কথাও বলেছেন। তিনি মনে করতেন, মানবিক শিক্ষা ব্যতিত মানুষের জ্ঞান পূর্ণতা পাবে না। তাঁর মতে, কেবল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা মানুষকে যন্ত্রে পরিণ করবে। এ শিক্ষাকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে হলে এতে “মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে আসতে হবে।” আর এ জন্য তিনি “পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষা এবং চরিত্র গঠন বা ক্যারেক্টার বিল্ডিং-এর শিক্ষা” গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। আর এ দু’টো শিক্ষা ঠিকভাবে নিতে হলে শিক্ষার্থীকে অবশ্যই সত্য ও ন্যায় এবং বাস্তব ইতিহাসের মাধ্যমে পাঠ দিতে হবে। শহীদ জিয়া শিক্ষার্থীদের আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সত্য ও প্রকৃত ইতিহাস পাঠ দানের উপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তাঁর ভাষায় “ যতদিন না আমরা আমাদের জাতীয় সত্যকে-আমাদের যে একটা জাতীয় ইতিহাস আছে, এ সত্যকে ঠিকভাবে এস্টাবিলিস্ট করতে পারবো, ততদিন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে গৌরব আসবে না।”
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আমাদের জাতীয় পরিচয়ের ও আত্ম উপলব্ধির অনস্বীকার্য উপাদান। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যাতে আমাদের জাতীয় জীবনে পূর্ণ ও ব্যাপক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয় সেজন্য শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ভাষার কথা বলেছেন। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রের ২৭ ও ২৮ নং বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে জিয়া সরকার ও তাঁর দলের করণীয় নির্দেশ করা হয়েছে। বাংলায় মাধ্যমিক ও উচ্চতর শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনায় জিয়া সংশ্লিষ্টদের দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। শিক্ষার মাধ্যম ও জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বলিষ্ঠ ব্যবহার ও ব্যাপকতর প্রসারে জিয়াউর রহমান সর্বাত্মক উদ্যোগ নিলেও যুগ বাস্তবতার প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে তিনি ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্মরণ রাখতে বলেছিলেন।
শহীদ জিয়া মনে করতেন একটি পশ্চাৎপদ দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন সে দেশের সকল জনগণের মধ্যে জাতীয় চেতনার উম্মেষ, প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে সামাজিক কর্তব্য, নাগরিক দায়িত্ব, জাতীয়তাবোধ ও দেশাত্ববোধ সম্বন্ধে ¯পষ্ট ধারণা তৈরি একান্ত প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রয়োজন জনগণের মধ্যে দ্রুত শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া। শিশু, তরুণ ও যুবাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। জিয়া সরকার প্রতিটি শিশুকে স্কুলে নেয়ার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। জিয়া সরকারের সময় গৃহীত অন্তবর্তীকালী দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনা এবং দ্বিতীয় পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষা খাতের উন্নয়নে প্রাগ্রাধিকারসহ বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বয়স্ক প্রবীণ। তাদের অধিকাংশই অশিক্ষিত ও অক্ষরজ্ঞানহীন। এ বয়স্ক জনগণকে স্কুলে এনে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব ছিল না। অথচ পুরো জাতিকে শিক্ষিত করে তোলা না গেলে জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নতির ধারা নিশ্চিত করা অসম্ভব বলে শহীদ জিয়া মনে করতেন। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, সার্বিক জনগণকে জাতীয় চেতনায় সমৃদ্ধ করে তুলতে অক্ষরজ্ঞানের বিকল্প নেই। তাই তিনি ‘গণশিক্ষ’ কার্যক্রম চালু করেন। এ লক্ষ্যে একটি পাঁচশালা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৮০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি গণশিক্ষা কর্মসূচি সূচনা করেন। শহীদ জিয়ার অনুরোধে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে গঠিত প্রায় ১,৪৬,২০৫ টি শিক্ষা স্কোয়াডে ৩,৯১,২০৫ জন শিক্ষক সারা দেশে ৩৪৫টি থানায় নৈশ বিদ্যালয়ের মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্ক নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করার এক মহানব্রতে নিয়োজিত হন। স্বাক্ষরতা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণের উদ্দেশে সরকার গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারভিযান চালানো হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এতদবিষয়ে জরুরি প্রকল্প হাতে নেয়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রমে গণশিক্ষা কার্যক্রমের গুরুত্ব বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরকারের এসব ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে দেশ নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে অনেকাংশে মুক্ত হয় এবং শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
ধর্ম মানব জীবনের অবিভাজ্য অংশ। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের আবাসস্থল হলেও ইসলাম এদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ও জীবনদর্শন। এ জন্য মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার যথাযথ প্রসারের ব্যাপারে জিয়া উদ্যো নিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ শুরু হয়। দ্য ন্যাশনাল কমিটি ফর কারিকুলাম অ্যান্ড কোর্সেস অফ স্টাডি-এর সুপারিশ অনুযায়ী আলিয়া মাদ্রাসার পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচি বাস্তবায়নের ফলে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য এক নব দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হয়। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মূল ধারায় যুক্ত করার লক্ষ্যে জিয়া সরকারের আমলে মাদ্রাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান, কারিগরি ও ক্রাফট শিক্ষা চালু করা হয়। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা মেডিক্যাল, প্রকৌশল বিদ্যাসহ বিশ^বিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার যোগ্যতা লাভ করে। মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নের জন্য জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’ প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যুগের চাহিদা এবং জাতীয় ঐতিহ্য ও প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমন্বিত উপায়ে ইসলাম ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর শান্তিডাঙ্গায় (কুষ্টিয়া ও যশোর সীমান্তবর্তী এলাকা) ইসলামি বিশ^বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৮০ সালে জাতীয় সংসদে ‘ইসলামি বিশ^বিদ্যালয় আইন’ পাশ করা হয়। মাদ্রাসা শিক্ষা বিস্তারে জিয়া সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে অন্যান্য ধর্মাবলীদের ব্যাপারেও তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল যে,মুসলমানদের অনুরূপ “অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যাতে নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী নিজ নিজ ধর্ম শিক্ষা লাভ করতে পারেন সে জন্য আমরা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাবো।”
শিক্ষার প্রসারে গণগ্রন্থাগারের ব্যাপক ভূমিকা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শহীদ জিয়া দেশে শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নে গণগ্রন্থাগারের অসাধারণ ভ‚মিকার বিষয়টি উপলব্ধি করেই দেশের প্রতিটি থানায় একটা করে গণগ্রন্থাগার ও মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর সে ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৮০-৮১ অর্থ সালে ‘থানা পাবলিক লাইব্রেরী কাম অডিটোরিয়াম স্থাপন’ শীর্ষক একটা উন্নয়ন প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়েছিল।
জ্ঞান অর্জনের জন্য শিক্ষাঙ্গনে সুস্থু অনুকূল পরিবেশ অপরিহার্য। ১৯৭৯ সালে ২ এপ্রিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে এ ব্যাপারে তিনি জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট সকলকে একযোগে কাজ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের প্রয়োজন অপরিহার্য। আর দক্ষ শিক্ষক পাওয়ার জন্য তাদের সম্মানজনক সুযোগ সুবিধা দিতে হয়। কারণ ক্ষুধার্ত শিক্ষক দিয়ে যে তৃষ্ণার্ত শিক্ষার্থীর প্রয়োজন মিটানো সম্ভব নয়। শহীদ জিয়া এটি উপলব্ধি করে শিক্ষকদের প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়ে শিক্ষকদের জন্য অভিন্ন চাকরি বিধি এবং জাতীয় বেতন-স্কেলের প্রারম্ভিকের ৫০% দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
শহীদ জিয়ার শিক্ষা দর্শন এবং তা বাস্তবায়নের তাঁর গৃহীত নীতি ও উদ্যোগ বাংলাদেশের জনমনে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। কিন্তু ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়ার নিমর্ম হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে তাঁর দল বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করে অবৈধ সরকার সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিয়ে জিয়া সরকারের অপরাপর সকল রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে তাঁর সূচিত শিক্ষা কর্মসূচির অনেক ইতিবাচক পদক্ষে বন্ধ করে দেয়া হয়।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসের একজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তি ও মহান রাষ্ট্রনায়ক। “প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ”-এই ছিল দেশপ্রেমিক জিয়ার জীবনব্রত। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার জিয়াকে হেয় করা, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ নানা ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানকে অস্বীকার করার অপতৎপরতা আমরা দেখছি। কিন্তু তা সফল হবে না। কারণ ইতিহাস চলে তার আপন গতিতে। ইতিহাস থেকে কারো অবদান জোর করে মুছে দেয়া যায় না। জিয়া ভাস্বর থাকবেন তাঁর স্বমহিমায়।
(লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ঢা.বি) mail: s_rahman_khan@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন