শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

মেঘবিষণ্ন বিকেলের শূন্যতা

আহমেদ উল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৭ এএম

আকাশের মন ভালো নেই! না রোদ না বৃষ্টি, মধ্যরাত থেকে মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে রেখেছে অভিমানী আকাশ।
ভোরের আগে কিছুটা রিমঝিম বৃষ্টি ঝরলেও, এরপর থেকে অভিমানী কিশোরীর মতো মুখ ভার করে রেখেছে সুনীল আকাশ; আকাশের এমন গুমড়ানো ভাব পলেনের কাছে শৈশব থেকেই বিরক্তিকর, ও চায়- হয় রোদ ওঠুক, নয় তো বৃষ্টি ঝরে আকাশ পরিস্কার হয়ে যাক; খামাখা মেঘ যতই চেষ্টা করে না কেন, সুর্যের আলোকে আর কতক্ষণ বেঁেধ রাখতে পারবে! জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিমনে স্বামীর কাছে গিয়ে পলেন বলে, মুসাফির..অ্যাই মুসাফির..


বিয়ের আগ থেকেই স্বামীকে নাম ধরে ডাকে পলেন। অবশ্য বিয়ের পর কিছুদিন ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছিল, কিন্তু মুসাফির নিজেই ওকে নাম ধরে ডেকে ‘তুমি’ সম্বোধনের অনুমতি দেয়। স্ত্রীর মুখে নিজের নামটি শুনে খুবই আনন্দ পায় মুসাফির!
মুসাফির খোলা জানালার পাশে বসে গুমড়ানো আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘলা দিনের কবিতা লিখছে! ভাবে নিমগ্ন থাকাবস্থায় সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে পলেন বলে, আকাশে মেঘ দেখলেই বুঝি তোমার মনের আকাশ ভাবে ভারী হয়ে ওঠে, তাই না? এখন আর ভাব নিয়ে বসে থাকলে চলবে না; ওঠো, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। কয়টা বাজে, খবর আছে তোমার? ওদিকে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বসে আছে। আর তুমি এদিকে বসে বসে মনের মেঘলা আকাশে ওড়ে বেড়াচ্ছ!


স্ত্রীর কথায় প্রভাবিত না হয়ে লেখায় মনোনিবেশ করে আছে মুসাফির। পলেনের কথার উত্তর না দিতে দেখে কিছুটা চটে পলেন বলে, এমন ভাবে মশগুল হয়ে কী লিখছ? কয়েকবছর ধরে আমাকে নিয়ে একটি লাইনও লিখতে দেখেনি তোমাকে, কাকে নিয়ে তোমার এমন লেখালেখি?
কাগজটি টেনে হাতে নিয়ে পলেন বলে, দেখি কী লিখেছ-
‘আমি মেঘমালার হয়ে আকাশে ওড়ে ওড়ে
শুকুনের তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে খুঁজে বেড়াই তোমাকে;
পাহাড়ের জনহীন কুয়াশাভেজা পথে ঘুরে ঘুরে,
অমা-আঁধারে জোনাকির মতো আলো জ্বেলে জ্বেলে
আজো খুঁজে বেড়াই তোমাকে’..


কপালে চোখ তুলে তাকিয়ে পলেন বলে, অ্যাই, কাকে খুঁজে বেড়াও তুমি? এখন বলো আমাকে, মেঘের আয়নায় কার ছবি দেখে দেখে কবিতা লিখো? বলো, গোপনে কার প্রেমের মালা গলায় পড়ে আছো? হ্যাঁ, সত্যি করে বলো তো!
মুচকি হেসে মুসাফির বলে, তোমাকে ছাড়া আর কেউ নেই আমার।
তাহলে একথাগুলো লিখেছ কার উদ্দেশ্যে?
তোমার।
আমার উদ্দেশ্যে মানে! আমি তো তোমাকে ছেড়ে যাইনি; এটা বিশ্বাস হয় না, শাক দিয়ে মাছ ঢাকছো তুমি!
এতক্ষণ তুমি কাছে ছিলে না তো, তাই!
ফাইজলামি করার সময় পাও না। ওঠো বলছি..
সবকিছু গুছিয়ে রেডি হও, আমি আসছি।
সব প্রস্তুত, কেবল বেরুবার বাকি।


চেয়ার ছেড়ে উঠে স্ত্রীর পেছন পেছন পা বাড়ায় মুসাফির। ছুটির দিনগুলোতে বাসায় থাকতে চায় না মুসাফির, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায় স্ত্রীকে নিয়ে। আজ ওদের কুমিল্লা যাবার কথা; মেঘলা আকাশ কিছুটা দেরি করিয়ে ছাড়ল।
কোটবাড়ি পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল ওদের। গাড়ি থেকে নেমে দুজনে হেঁটে শালবনের ভেতরে প্রবেশ করে...


মুসাফিরকে বিয়ে করে পলেন সুখি। দুজনার মধ্যে বেশ বোঝাবুঝি ও মিল-মহব্বত। একে অপরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছে। কলেজে ভর্তি হবার পর উভয়ের পরিচয়।
ছাত্রজীবনে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তির পর্বটা মুসাফির বেশ জমিয়ে তুলতো, এছাড়া আবৃত্তিতে প্রথম পুরস্কারটা ওকে ছাড়া কেউ সহজে স্পর্শ করতে পারেনি। ওর কবিতা আবৃত্তির ছন্দময় সুরের জালে পলেন এসে ধরা পড়ে। তারপর থেকেই মুসাফিরের লেখালেখির কেন্দ্রবিন্দু পলেনের দখলে চলে যায়। মুসাফিরের গল্প-কবিতার শব্দ-ছন্দে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াত পলেন...
মুসাফিরের ইচ্ছে ছিল- নামকরা একজন কবি হবে! বিভিন্ন পত্রিকায়ও ওর বহু লেখা ছাপা হয়েছে। কিন্তু চাকরির ব্যস্ততায় আগের মতো আর লেখালেখিতে সময় দিতে পারে না। বিশেষ করে বিয়ের পর, ওর লেখালেখির প্লাটর্ফম অনেকটাই নির্জীব হয়ে যায়। রামপুরা মহানগর প্রজেক্ট এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে ওরা। ছুটির দিনগুলোতে স্বস্ত্রীক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় আনন্দের পাল উড়িয়ে!
কোটবাড়িতে বেড়াতে এসে, দুজনে শালবনের ভেজা লাল মাটির পথ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাতে হাত ধরে!


মেঘঢাকা আকাশের মেঘ তখনো পুরোপুরি কাটেনি, ঘোমটাপরা নববধূর লজ্জিত চাহনির মতো মেঘের আড়াল থেকে উঁিক মেরে তাকায় সূর্য! টিলার পাদদেশ ঘেঁসে হেঁটে চলার সময় আচমকা মুসাফিরের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়- বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসা এক নারীর দিকে; সাথে ওর ফুটফুটে দু মেয়ে। অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে তাদের পাশ কাটিয়ে যাবার সময়, সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গতিরোধ করে মুসাফির বলে, অনামিকা!
আঁতকে ওঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনামিকা! চেহারায় চিন্তার রেখা বিকশিত! অবাক চাহনিতে তাকিয়ে থাকাবস্থায় অস্পষ্ট স্বরে অনামিকা বলে, তোমাকে মুসাফিরের মতো মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ, এত সহজে ভুলে গেছ তুমি!


উচ্ছল হাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে অনামিকা বলে, মুসাফির, তোমাকে চিনব কেমন করে? বলো, তুমি আগের চাইতে অনেকটা মোটা ও স্মার্ট হয়ে গেছো দেখছি।
পলেনের দিকে ইঙ্গিত করে অনামিকা বলে, তোমার সঙ্গে ওনি কে? তোমার স্ত্রী নিশ্চয়!
হ্যাঁ, তোমার ধারণা ঠিক; পরিচয় হয়ে নাও। আমার স্ত্রী পলেন।


হাস্যোজ্জ্বল পরিচয়ের পর, অনামিকার উদ্দেশ্যে মুসাফির বলে, অনেক বছর পর তোমার সাথে দেখা হলো, চলো না একসঙ্গে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই!
কত কী ভেবে পলেন বলে, এতদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে আমারও খুব ভালো লাগছে মুসাফির! তুমি জান কি না জানি না, আমার শ্বশুরবাড়ি এখান থেকে অল্প দূরে, লালমাই। এদিকে প্রায়ই ঘুরতে আসি আমি। বরং তোমরাই ঘুরে বেড়িয়ে এসো। তোমাদের না আসা পর্যন্ত আমি জাদুঘরের পাশে অপেক্ষা করব; দেখা না করে যেয়ো না কিন্তু।
অনামিকা চলে যাবার পর সামনে এগিয়ে গেল মুসাফির। ফ্যাকাশে চেহারায় মুখভার করে হাঁটতে দেখে মুসাফিরের হাত ধরে পলেন বলে, তোমার হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় এমন অন্ধকার এলো কোত্থেকে? ওই অনামিকা তোমার মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে বুঝি! কে এই অনামিকা?


নিঃশব্দে আনমনে হেঁটে চলেছে মুসাফির, কোনো কথা বেরুল না ওর মুখ থেকে...
ওকে কথা বলতে না দেখে পুনরায় পলেন বলে, একেবারে চুপ হয়ে কী ভাবছো? মেঘ হয়ে আকাশে ওড়ে, শকুনের তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে কি ওকেই খুঁজে বেড়াচ্ছ নাকি? এবার বুঝেছি- কার বিরহে তুমি ভেসে ভেসে কবিতা লিখে থাক। সত্যি করে বলো তো, কে এই অনামিকা?


অনামিকা ছোট্টবেলা থেকেই মামার বাড়িতে থাকতো, ওর বাবা ঘৃণ্যতম এক পরিস্থিতির শিকার হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল; ফলে স্বামীর সংসার ছেড়ে চার বছরের অনামিকাকে নিয়ে ওর মা বাপের বাড়ি চলে আসে। মামার বাড়িতেই বড় হয়ে ওঠে অনামিকা; লেখাপড়ার হাতেখড়ি শুরু হয় এখানে থেকেই।
মুসাফিরের পাশের বাড়ির তাইজুদ্দিন মোল্লা অনামিকার একমাত্র মামা। অনামিকাকে সন্তানের মতো যত্ন করে মানুষ করেছে তাইজুদ্দিন মোল্লা।
ছোটবেলা থেকেই মুসাফিরের সঙ্গে অনামিকার চলফেরা শুরু। একই সঙ্গে স্কুলে পড়ালেখা; স্কুলে যাওয়া-আসা, বইপত্র আদান-প্রদান থেকে শুরু করে, গল্প-গুজবে একে অপরের পাশাপাশি ছিল শৈশব থেকে কলেজে পর্যন্ত।
সময়ে-অসময়ে অনামিকা এসে মুসাফিরের পড়ার ঘরে বসে থাকতো, আড্ডায় মেতে থাকতো দুজনে। দুষ্টমি, রাগারাগি, হাসি-আনন্দ ও মান-অভিমানে কেউ কাউকে কখনো ছাড়েনি। তখন থেকেই অনামিকাকে নিয়ে বিচিত্র ছন্দ-কবিতা লিখতো মুসাফির। মুসাফিরের লেখা পড়ে অনামিকা খুবই আনন্দ উপভোগ করতো!


একসঙ্গে চলতে গিয়ে মুসাফিরের মন ভালোবাসার স্পর্শ জাগিয়ে কড়া নাড়ত অনামিকার মনের দরজায়। অনামিকার প্রতি ওর করুণা ও অনুরাগ মুখে বলতে না পারলেও, ওর লেখা বিভিন্ন ছন্দ-কবিতায় স্পষ্টই প্রকাশ পেতো। তার মনের এমন অতৃপ্ত অনুরাগের কথা বুঝেও না-বোঝার ভান করতো অনামিকা। অনামিকাও মনে মনে করুণা করতো মুসাফিরকে ঠিকই, কিন্তু বোঝতে দিতে চায়নি!
দুজনার অব্যক্ত অনুরাগের কথা কেবল প্রকাশ হতো একে অপরের প্রতি
তাকিয়ে থাকার মধ্য দিয়ে, চোখের নিঃশব্দ ভাষায়। মুখে না বললে,
গোপন ভালোবাসার কি বা মূল্য থাকে!


এক ফাগুন পূর্ণিমারাতে কয়েকটি গন্ধরাজ ফুল নিয়ে অনামিকা এসে দাঁড়ায় মুসাফিরের বাড়িতে; দরজায় দাঁড়িয়ে ফিস্ ফিস্ করে ডাকে মুসাফিরকে...
দরজা খুলে বের হয়ে অনামিকাকে দেখে মুসাফির বলেছিল, কি গো অনামিকা, এমন রাতে তুমি এসেছ কেন?
হাতে ডালসহ গন্ধরাজ দেখে মুসাফির বলে, ফুল চুরি করেছ কোত্থেকে, আমার বাগান থেকে নয় তো?
অনামিকা প্রায়ই এসে গোপনে মুসাফিরের বাগান থেকে ফুল চুরি করে নিয়ে যেতো। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার দুজনার মধ্যে বাকবচসা হয়েছে, হয়েছে মান-অভিমান।
(অসমাপ্ত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন