শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খেলাধুলা

ট্যুর‌্যাঙ্গির শান্ত ছেলেটিও হতে পারতেন নায়ক

স্পোর্টস রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

সাফল্যের প্রস্তুতি কেউ কেউ নেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। দৌড়ের একদম শুরু থেকে প্রত্যেক ধাপ, গতি বাড়ানো, আস্তে আস্তে ক্যারিয়ার গড়ে তোলা, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরণকামড় দেওয়া, প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করা- সব ছকে রাখেন তাঁরা। কিন্তু সেসবের ধার ধারেন না একজন- কেন উইলিয়মসন।
চার বছর আগে সাংঘাতিক জমেছিল অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপ ম্যাচ। ছয় মেরে উইলিয়মসন খেলা শেষ করার পর উচ্ছ¡াসে ফেটে পড়েছিল গোটা ইডেন পার্ক। উইলিয়মসনের মুখে কিন্তু ছিল লাজুক হাসি। খানিকটা ইতস্তত করেই ট্রেন্ট বোল্টের সঙ্গে মৃদু ফিস্টবাম্প - ব্যাস, ঐটুকুই। আর এতকিছুর মাঝখানে সবার সঙ্গে হাত মেলাতেই ভুলে গেছিলেন। যখন মনে পড়ল তখন দেখে মনে হচ্ছিল খানিকটা অপরাধবোধে ভুগছেন। ক্রিকেটার উইলিয়মসনকে ছাপিয়ে সেদিন চোখে পড়েছিল মানুষ উইলিয়মসনকে।
বড় ম্যাচের আগে বিতর্কিত কিছু বলে হাওয়া গরম করে দেওয়া ধাতে নেই উইলিয়মসনের। তবে তিনি এতই নিরীহগোছের মানুষ যে বক্সিং-টক্সিংয়ে না গেলেই ভাল হয়। এতটাই প্রচারবিমুখ যে ইন্টারনেট না থাকলে কেউ হয়ত জানতেই পারত না অবসর সময়ে তিনি সার্ফিং করতে ভালবাসেন!
শ্বাসরুদ্ধকর এই ফাইনালে ফাইনালে সুপার ওভারে হেরে গেছে নিউজিল্যান্ড। তবে বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের জন্য ট্রফি বরাদ্দ থাকলে উইলিয়মসনের দৌলতে নিউজিল্যান্ড সেটা জিতে যেত। কিন্তু একটি ট্রফি কিন্তু ঠিকই জিতেছেন কিউই দলনেতা। একটি মাঝারী মানের দলকে ফাইনালে টেনে তোলার পুরস্কার হিসেবে আসর সেরা খেলোয়াড়ের ট্রফিটি, সাকিব, স্টার্ক, রোহিতদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে ঠিকই জিতে নিয়েছেন উইলিয়ামসন।
কয়েক সপ্তাহ আগে লর্ডসে অস্ট্রেলিয়ার কাছে নিউজিল্যান্ডের হারের কারণ জানতে চাওয়ায় উইলিয়মসন উদাসভাবে বলেছিলেন, ‘বড্ড বড় উত্তর, জানেন তো, বলতে অনেক সময় লাগবে।’ এক ভারতীয় সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনিকে তিনি দলে নিতেন কিনা। পালটা প্রশ্ন করে বসেন উইলিয়মসন, ‘কেন, ও নিউজিল্যান্ডের নাগরিক হয়েছে বুঝি?’
ফাইনালে অনেকেই নিউজিল্যান্ডকে আন্ডারডগ মনে করছেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি চটজলদি উত্তর দেন, ‘আমরা আন্ডারডগ না কী ডগ, তা নিয়ে আপাতত না ভেবে খেলায় মন দিচ্ছি। আর ফাইনাল তো একদিনের ব্যাপার। যে ভাল খেলবে সেই জিতবে। কুকুরের জাতপাত কাজে দেবে না।’ সব মিলিয়ে তিনি মাঠে বেশি ক্ষিপ্র না প্রেস কনফারেন্সে, তা বাস্তবিকভাবেই বলা কঠিন।
ষোল বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন উইলিয়মসন। স্কুল ছাড়ার আগেই পঞ্চাশটা সেঞ্চুরি হয়ে গেছিল তাঁর। আর হেড বয়ের তালিকায় যে তাঁর নাম সবার ওপরে ছিল তা বলাই বাহুল্য। এরই মধ্যে নানান স্তরের ক্রিকেটে দেশকে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন তিনি। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও তিনিই অধিনায়ক ছিলেন। প্রথম টেস্টে তিনি শতরান করায় কেউই বিশেষ অবাক হয়নি।
এই বিশ্বকাপেও নিউজিল্যান্ডের হয়ে ৩০ শতাংশ রান করেছেন উইলিয়মসন। তাঁর অসাধারণ টাইমিং আর নিখুঁত প্লেসমেন্ট ছিল চোখে পড়ার মত। তাঁর উইকেট পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থেকেছেন বোলাররা। উইলিয়মসনের পূর্বসূরী ব্রেন্ডন ম্যাকালাম বিশ্বাস করতেন, যেভাবেই হোক জেতা দরকার, তা সে লড়ে এক রানে জয়ই হোক বা চার-ছয়ের বন্যা বইয়ে দশ উইকেটেই হোক। দরকার না পড়লে বিরাট বড় কিছু করে দেখাতে যাওয়ার মানে হয়না। উইলিয়মসন আর কোচ গ্যারি স্টেডও একই ধারণা পোষণ করেন। কিন্তু উইলিয়ামসন? ‘ছোটবেলা থেকেই বড় কিছু করে দেখাতে চায় কেন। তবে সেটা কখনওই অন্যের কষ্টের বিনিময়ে নয়।’- বলেছিলেন উইলিয়মসনের প্রথম স্কুল কোচ জশ শিমস।
আর তাছাড়া উইলিয়মসন মানুষটা এতই নরম মনের যে বিপক্ষকে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিলে হয়ত খানিকটা অপরাধবোধেই ভুগবেন। মহম্মদ আলি যেমন জর্জ ফোরম্যানকে শেষ ঘুষিটা না মেরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। অনেকটা তেমন। গত বিশ্বকাপ ফাইনালের পাঁচজন এবারে সেমিফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন। তবে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে বর্তমান দল উইলিয়মসনের চিন্তাধারায় বিশ্বাসী।
অকল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বদিকে ট্যুর‌্যাঙ্গি। গাড়িতে যেতে লাগে আড়াই ঘণ্টা। আর এখানেই প্রকৃতির বুকে ক্রিকেটজীবন শুরু হয়েছিল ছোট্ট কেনের। বাবা ব্রেট ছিলেন নামজাদা ক্লাব ক্রিকেটার। বাস্কেটবলে নিজের অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করেন মা স্যান্ড্রা। আর কেনের তিন বোন অ্যানা, সোফি, আর কেটি আঞ্চলিক স্তরে খেলেছিলেন ভলিবল। পরিবারে খেলাধুলোর এই পরিবেশ, বাইরে খোলা প্রান্তর, প্রাথমিক স্কুলে ন’টা দল আর তিনশো বাচ্চার সঙ্গে খেলার সুযোগ, আর যমজ ভাই লোগানের সঙ্গে একেবারে শুরু থেকে প্রতিদ্ব›িদ্বতা - সব মিলিয়ে মোটামুটি জন্মলগ্ন থেকেই উইলিয়মসনের উত্থান ছিল অবশ্যম্ভাবী।
পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে লর্ডসের ফাইনাল সেই ভবিষ্যতেরই চূড়ান্ত সার্থকতা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন