স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের সাহিত্যে একজন নতুন ও তরুণ ঔপন্যাসিকের আবির্ভাব ঘটে। তার নাম হুমায়ুন আহমেদ (জ. ১৩ই নভেম্বর, ১৯৪৮ - মৃ. ১৯ই জুলাই, ২০১২)। ১৯৭২ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাস প্রকাশের পর তার নাম আলোচনায় চলে আসে। তারপর তিনি বহু উপন্যাস লেখেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক সংখ্যক উপন্যাস লেখক। সমগ্র বাংলা সাহিত্যে আর কেউ উপন্যাস লিখে তার মত এত খ্যাতি, জনপ্রিয়তা ও অর্থ-বিত্তের অধিকারী হননি। বলা হয়, পাঠ-বিমুখতার দুর্দিনে তিনি তার উপন্যাসের অগণিত পাঠক সৃষ্টি করেন। অবশ্য সে পাঠকদের সবাই কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী যারা সম্ভবত শুধু তার উপন্যাস পড়তেই ভালোবাসেন। যুবক বয়সী ও বয়স্ক পাঠকরা তার উপন্যাসের তেমন অনুরাগী বলে শোনা যায় না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রতি বছর ঈদ সংখ্যা প্রকাশের একটি ধারা শুরু হয়। এক্ষেত্রে সদ্য প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা ছিল অগ্রগামী। বিচিত্রার কয়েক বছর পরে বাজারে আসে সচিত্র সন্ধানী ও তারপর সাপ্তাহিক রোববার। সাপ্তাহিক চিত্রালী তো ছিলই , আরো আসে সাপ্তাহিক পূর্বাণী। একটি পর্যায়ে বিচিত্রা, সন্ধানী রোববার, চিত্রালী ও পূর্বাণীর ঈদ সংখ্যাগুলো ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। সাহিত্য পাঠকদের অবশ্য সংগ্রহযোগ্য হয়ে দাঁড়ায় এগুলো। প্রতিটি পত্রিকাতেই অন্যান্য লেখার সাথে থাকত পাঁচ-ছটি করে উপন্যাস। ঈদ সংখ্যার কোনো কোনোটিতে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসও থাকত। এসব উপন্যাস থেকে বাংলাদেশের সমকালীন উপন্যাস সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যেত। উপন্যাসের প্রতি আগ্রহের কারণে আমি ১৯৯০ ও ১৯৯১ সালে বিভিন্ন ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর ভিত্তিতে পরপর দু বছর দুটি আলোচনা লিখি। ১৯৯০ সাল ভিত্তিক আলোচনাটি ‘নব্বই সালের উপন্যাস ঃ একটি পর্যালোচনা’ নামে বাংলা ৬ পৌষ, ১৩৯৭ (১৯৯০ সাল) তারিখে ‘দৈনিক জনতা’র সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হয়। ঐ লেখাটিতে আমি সে বছর তিনটি ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হুমায়ুন আহমেদের তিনটি উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করি। উপন্যাসগুলো হলঃ ‘সমুদ্র বিলাস’, ‘আমাদের শাদা বাড়ি’ এবং ‘গৌরীপুর জংশন’। হুমাযুন আহমেদ তখনো কিংবদন্তি প্রতীম খ্যাতি অর্জন করেননি। শুরু হয়নি তার বই কেনার ও অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য লাইন দেয়া। সে হিসেবে তার সে সময়ে লেখা উপন্যাসগুলোর এ মূল্যায়নের যৎকিঞ্চিৎ গুরুত্ব থাকতে পারে। সে আলোচনায় আমি লিখেছিলামঃ
হুমায়ুন আহমেদের প্রায় সব উপন্যাসেরই নায়ক-নায়িকা মনো-জটিলতার শিকার। সে কারণে তাদের আচার আচরণও অস্বাভাবিক। তার ‘সমুদ্র বিলাস’ উপন্যাসেও তার পরিচয় পাওয়া যায়। এ উপন্যাসের নায়ক তৌহিদ সরল ও উদাসীন মানুষ। ঘর-সংসারের কোনো ব্যাপারে তার যেমন আগ্রহ নেই, তেমনি আগ্রহ নেই রিমির ঘটনাবহুল অতীত নিয়েও। এ রকম নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত, আবেগহীন চরিত্র শুধু হুমায়ুন আহমেদই সৃষ্টি করতে পারেন, আর তার উপন্যাসেই শুধু এদের মানায়। সে তুলনায় রিমি অনেক বেশি রক্ত-মাংসের মানুষ, অনেক বেশি জীবন্ত, বিশ^াসযোগ্য চরিত্র। জীবনের কলংকিত অধ্যায়কে চেপে রাখা এবং প্রয়োজনে তার নিরাবরণ প্রকাশের সাহসও তার আছে। কিন্তু সে-ই কাহিনীর শেষে এসে কেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে। জামাল সাহেব ও তারস্ত্রীর সাথে সমুদ্রে এসে সাগরে নামে রিমি। হাঁটু পানিতে নামার পর এক ঘোরের মধ্যে নেমে যেতে থাকে সমুদ্রের আরো গভীরে। হঠাৎ এক প্রচন্ড ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে তার ওপর। এ ঢেউ রিমিকে তীরে ছুঁড়ে ফেলতেও পারে আবার নিজের কাছে টেনেও নিতে পারে। এই রহস্যের মধ্যে পাঠককে নিক্ষেপ করে কাহিনীর ইতি টেনেছেন হুমায়ুন আহমেদ। কিন্তু কেন রিমির এ ঘোর, কেন তার এ আচরণ, পাঠকের কাছে তা পরিষ্কার হয় না।
হুমায়ুন আহমেদের ভিন্ন স্বাদের উপন্যাস ‘আমাদের শাদা বাড়ি’। বাবা-মা, তিন ভাই, দুই বোন নিয়ে সংসার। সকলের মাথা গোঁজার ঠাঁই তাদের একতলা সাদা বাড়ি যার মালিক অন্য ব্যক্তিÑ মঈনুদ্দিন। বাড়িটি একদিন তাকে ফিরিয়ে দিতে হবেÑ বাŸার এ আশংকা সংক্রমিত হয় পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যেও। এক সময় জানা যায়, মঈনুদ্দিন সাহেব তাদেরকেই বাড়িটি দান করেছেন। এরপর শুরু হয় অন্যরকম জটিলতা। শেষ পর্যন্ত মা দুজন উকিলকে ডেকে পাঠান। মা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা পাঠকরা জানতে পারে না। স্বল্পদৈর্ঘ্য এ উপন্যাসটি সচেতন পাঠককে তেমন টানে না।
উপন্যাস লিখতে হলে বলিষ্ঠ কল্পনা শক্তির প্রয়োজন। তার সাথে প্রয়োজন প্রকাশ ক্ষমতা, ভাষার বাঁধুনি, তীক্ষè পর্যবেক্ষণ। হুমায়ুন আহমেদের এর সবই আছে। ‘গৌরীপুর জংশন’ উপন্যাস তার প্রমাণ। এ উপন্যাসের নায়ক জয়নাল এ সমাজে থেকেও সমাজের মানুষ নয়। ভিন্ন এক পৃথিবীতে তার আনাগোনা। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম, ল্যাংড়া পা, প্রতারণা তার সম্বল। এক সাদামাটা অথচ আকর্ষণীয় চরিত্র। পিঠে তিন মণী বস্তা পড়ার পর তাগদ হারায় জয়নাল, হারায় বউকে। কিন্তু তারপরও সে বেঁচে থাকে। ঘরের বউ একাধিক বিয়ে করে শেষে পতিতা হয়, তাতেও তার আফশোস নেই। অন্যকে প্রতারণা করে পাওয়া অর্থে তার হৃদয় দরাজ হয়ে যায়। কৃতজ্ঞতাবোধও আছে তার। কিন্তু কাজ করার কোনো ক্ষমতা তার নেই, এখানেই জয়নালের সীমাবদ্ধতা। হুমায়ুন আহমেদ আমাদের পরিচিত পৃথিবীর এক অপরিচিত মানুষকে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন তার এ উপন্যাসে। তার অন্যান্য উপন্যাসের মত এ উপন্যাসের জয়নালও স্বাভাবিকের মধ্যে অস্বাভাবিক। অতি সাধারণ হয়েও ভিন্নতর এক মানুষ। ব্যতিক্রমী পটভ‚মিতে এটি একটি চমৎকার উপন্যাস যা এক শক্তিমান ঔপন্যাসিকের পরিচয় বহন করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন