এক
কুরবানী শব্দের অর্থ উৎসর্গ করা, আত্মত্যাগ করা, নিবেদিত প্রাণে বিলিয়ে দেওয়া, মণ-প্রাণ উজার করে দু’জাহানের মহান মালিকের নামে কোন কিছু উৎসর্গ করা।কুরবানী কে আরবী ভাষায় “উযহিয়া” বলা হয় ।উযহিয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ঐ পশু যা কুরবানীর দিন যবেহ করা হয় । যিলহজ¦ মাসের ১০তারিখ হতে ১২ই যিলহজ¦ সন্ধা পর্যন্ত অর্থাৎ ১০,১১,ও ১২ই যিলহজ্জ এই তিন দিনের যে কোন সময়ে যে সব প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক, মুকিম ব্যক্তির কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে ঐ সকল সামর্থবান মুসলমানের পক্ষ থেকে উট,দুম্বা, ভেড়া, ছাগল, গরু, মহিষ ইত্যাদি প্রাণী মহান আল্লাহ তায়ালার নামে জবাই করার আনুষ্ঠানিকতা-ই-কুরবানী। প্রকৃত অর্থে বান্দার পক্ষ থেকে মহান মা’বুদের নামে কোন কিছু আত্বত্যাগ বা উৎসর্গ করা-ই কুরবানী। যা শরীয়তের বিধান হিসাবে ওয়াজীব।কুরবানীর বিধান শুধুমাত্র রাসুল (সা) যুগেই নয় বরং পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম আ: এর সময় থেকেই কুরবানীর প্রচলন ছিল সর্বপ্রথম কুরবানী করেন তাঁর ছেলে হাবিল।
মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতিটি বিধানের পিছনে রয়েছে অর্ন্তনিহীত তাৎপর্য। বান্দা ও মালিকের মাঝে গভীর ভালবাসা, অকৃত্রিম প্রেম প্রীতি ও নিবীড় সেতুবন্ধনের এক অনন্য উপকরন হচ্ছে কুরবানী। মালিকের দেওয়া জীবন, মালিকের দেওয়া সম্পদ থেকে মালিকের নামে কোন কিছু বিলিয়ে দেওয়ার অভ্যাসে অভ্যস্থ করানোর উত্তম নমুনা হচ্ছে কুরবানী।
চন্দ্র সূর্য্য আসমান জমীনের একচ্ছত্র অধিপতি যার ক্ষমতার কোন অন্ত নেই, যিনি অসীম ক্ষমতার মালিক, যার “কুন ফাইয়া কুন”দু’টি শব্দ-ই জল্লোচ্ছাস, সাইক্লোন,ঘূর্ণিঝড়,ভূমিকম্প,অতিবৃষ্টি খড়া সহ পৃথিবীর সকল সমস্যা বন্ধ করে দিতে পারে, আবার তিনি ইচ্ছা করলে মুহূর্তের মধ্যে গোটা দুনিয়া ধবংস করে দিতে পারেন। তাঁর হাতেই সৃষ্টি কুলের শান্তি সমৃদ্ধি উন্নতি এবং কল্যাণ, অকল্যাণের যাবতীয় চাবীকাঠি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা বুঝে না কেহ কেহ বুঝেও না বুঝার ভান করে। আবার অনেকে মহান মা’বুদের বিধি বিধান কে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও কটাক্য করে কথা বলে যা কোন মুসলমান তো দূরের কথা কোন মানুষের দ্বারাই হওয়া উচিৎ নয়। নামাজ রোজা হজ¦ যাকাত কুরবানী বিয়ে শাদী সহ ইসলামের যতগুলো বিধি বিধান রয়েছে তা নিয়ে লাভ লসের হিসাব কষে। যে বা যারা এসব বিষয়ে কোন উপকার খোঁেজ পায় না তারা মসজিদ মাদ্রাসা ইসলামী তাহযিব তামাদ্দুন ও ইসলামী সংস্কৃতিকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেন না, তারা সব সময় এসব বিষয়ে শুধু ক্ষতি দেখেন!
সভ্যতার দাবীদার আধুনিক শিক্ষিত অনেকই কুরবানী কে বার্ষিক পশু নিধনের হাতিয়ার বলে আখ্যায়িত করেন! কুরবানীর ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার গরু ছাগল মহিষ নিধন হয়ে যায় বলে যুক্তি তুলে ধরেন। কুরবানী বন্ধ করার জন্য দাবী জানান। সম্প্রতি এক দল লোক এসব দাবী জানিয়েছেন । শুধু তাই নয় তাদের সাথে সুর মিলিয়ে নামধারী কিছু মুসলমান যারা মূলত নাস্তিক তারা আরো বলেন মসজিদে আজানের ফলে শব্দ দূষণ হয়! নামাজের মত নামাজ জীবনে একবার পড়লেই হয়,মনের পর্দা বড় পর্দা কাপড়ের পর্দা লাগেনা ইত্যাদি আজে বাজে কথা বলে! অথচ আজ পর্যন্ত কোন বির্ধমী এসব আজে বাজে কথা বলার সাহস করে না । আবার নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করে! এর দ¦ারা তারা জাতীয় কোন স্বার্থ বা আয় খোঁজে পান না! আসলে কি তাই?
পৃথিবী সৃষ্টি হতে অদ্যাবধি কুরবানীর বিধান প্রচলিত।সুরা মায়িদার ২৭ নাম্বার আয়াতে পৃথিবীর সর্বপ্রথম হযরত আদম আ:এর সন্তান হাবিল কাবিলের কুরবানীর কথা উল্লেখ রয়েছে।তখনকার কুরবানীর বিধি বিধান ছিল কিছুটা ভিন্ন মুসলিম উম্মাহ মন প্রাণ উজার করে মহান মা’বুদের নামে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁরই দেওয়া জান-মাল,ধন-সম্পদ,পশু পাখি তাঁর রাস্তায় বিলিয়ে দেয় যদিও এসব কোন কিছুতেই মহান মা’বুদের কোন-ই প্রয়োজন নেই। বরং এসব কিছু-ই তাঁর অনুগ্রহ,বান্দার প্রতি করুণা। যেখানে গোটা দুনিয়ার কোন ক্ষমতা, সম্পদ,অন্যান্য সৃষ্টিরাজি এক কথায় সৃষ্টির কোন কিছুই তাঁর প্রয়োজন নেই তিনি কোন কিছুর প্রতি-ই মুখাপেক্ষী নন তাঁর সমতুল্য কেহ নাই । তাহলে এসবের আয়োজন কেন? কেন কুরবানী,দান-সদকা নামাজ রোজা হজ¦ যাকাত! কেন মানুষ পশু-পাখীর প্রতি দয়াবান হবে? কেন মানুষ মানবতা মনুষত্ব বজায় রাখবে? কেন নামাজ রোজা হজ¦ যাকাত কুরবানী? এসবের কি প্রয়োজন? এসবের জন্য কেন মানুষ অর্থ শ্রম সময় ব্যয় করবে? এর দ্বারা কে উপকৃত হয়? কাদের জন্য এসব আয়োজন?
এসব কিছুর দ্বারা একমাত্র ইলাহ-তাঁর উলুহিয়াতে কোন পরিবর্তন হয় না। এসবের দ্বারা তিনি কিছু করেন না অর্থাৎ বিষয়টি এমন নয় যে গোটা দুনিয়াবাসী আল্লাহর হুকুম মানলে তাঁর ক্ষমতা বৃদ্বি পাবে, তিনি ক্ষমতায় ঠিকে থাকবেন, না হয় তিনি ক্ষমতাচ্যুত হবেন, অথবা তাঁর সরকারের হ-য-ব-র-ল অবস্থা হবে! না না এসব কোন কিছু-ই তাঁর শা’নের সাথে প্রযোজ্য নয়! এসবের প্রয়োজন হবেই কি করে? তিনি-ই একমাত্র মালিক, তিনি একক, অদ্বিতীয় তাঁর কোন শরীক নাই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী, তিনি রাজাধিরাজ, তিনি কারো প্রতি কোন কিছুর জন্য মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী। তিনি-ই-প্রথম, তিনিই শেষ,তাঁর আগে পরে আর কেহ নাই তাঁর ক্ষমতায় কখনো কোন রদ বদল হয় না। তিনি কারো থেকে জন্ম গ্রহন করেন নি তাঁর থেকেও কেউ জন্ম নেয়নি। তাঁর সমতুল্য কেহ-ই নেই। এরশাদ হচ্ছে “হে নবী আপনী বলে দিন তিনি-ই-আল্লাহ,তিনি এক একক। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। তাঁর থেকে কেউ জন্ম নেয় নি আর তিনি ও কারো থেকে জন্ম গ্রহণ করেন নি। আর তাঁর সমতুল্য দ্বিতীয় আর কেহ নেই। সুরা ইখলাছ।
মহান রবের রবুবিয়াতে কখনো কম বেশী হয় না গোটা দুনিয়াবাসী তাঁকে রব হিসাবে মেনে নিলে ও তাঁর কোন উপকার নেই, না মানলে ও তাঁর কোন ক্ষতি নেই। বরং তাঁর প্রতি যারা ঈমান আনবে, তাঁকে-ই ভয় করবে, তাঁর দেওয়া বিধি বিধান গুলোকে যতœসহকারে গুরুত্বের সাথে পালন করবে, তারাই সফলকাম,তাদের জীবন ধন্য। তাদের জন্য জমিন থেকে তেল গ্যাস, হীরা, মানিক, খনিজ পর্দাথ এবং আসমান জমীনের যাবতীয় রহমত বরকতের দরজা সমুহ খোলে দেওয়া হতো! খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে মুলত মানুষের প্রতি করুণা করেছেন। তাঁর দেয়া জান মাল হতে তাঁরই দেখানো, শিখানো পথে সামান্য কিছু বিলিয়ে দেয়ার সুযোগ দিয়ে মূলত আমাদের নসীব খোলে দিয়েছেন। আমাদের কে ধন্য করেছেন, আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তাই কুরবানী হবে শুধু তাঁর জন্য তাঁর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য ।
যদি তিনি আমাদের কে মানুষ না বানিয়ে অন্য কোন জীব-জানোয়ার বানাতেন, বন জঙ্গলের হিং¯্র প্রাণী হিসাবে দুনিয়ায় পাঠাতেন তাহলে কার সাধ্য ছিল মানুষ হওয়ার? এখনো যদি তাঁর সৃষ্টিতে তিনি পরিবর্তন আনতে চান, যদি বিষয়টি এমন হয় যে বর্তমান বিশে^র সকল মানুষ তার বিধান কে কাঁক্য করে কথা বলেন তাদের সকল কে অন্য কোন প্রাণীতে পরিবর্তন করে দেবেন বা বানিয়ে দেবেন! আর অন্য সব প্রাণী গুলোকে মানুষ বানিয়ে দেবেন! তাহলেই বা এর প্রতিবাদ করার সামর্থ্য আছে কার? অথবা গোটা মানব জাতিকে পরিবর্তন না করে তিনি যদি ইচ্ছা করেন যে,বর্তমান বিশ^টাকে যে ক’জন মানুষ অশান্ত করে রেখেছে এবং অশান্ত করতে ইন্ধন যোগাচ্ছে,যাদের অতি মাত্রা লোভ লালসা, ক্ষমতার মোহ এবং হিংস্বার আগুনে বিশ^ব্যাপী অশান্তির অনল ক্রমবর্ধমান গতিতে বেড়ে চলছে, শুধু তাদেরকেই যদি একই দিনে একই সময়ে কাওমে আদ ও কাওমে সামুদের ন্যায় বানরে পরিনত করে দেন! অথবা ফেরাউনের ন্যায় নদীতে ডুবিয়ে মেরে মিসরের মত পিরামিড বানিয়ে আবার নজির স্থাপন করতে চান ! অথবা অতি সম্প্রতি নেপালে যে ভয়াভহ ভূমিকম্প হল ঠিক এর চেয়ে আরো কঠিন ভূমিকম্প দিয়ে ক’য়েকটি রাষ্ট্র সমূলে ধবংস করে দেন ! তাহলেই বা এর বিরুদ্বে রুখে দাড়াঁনোর ক্ষমতা কারো আছে কি? না কি জাতি সংঘের অধিবেশনে শোক সমাবেশ করে শোককে শক্তিতে পরিণত করে এর প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা কারো আছে?
অথবা যে বা যারা সকল অপকর্মের হোতা,যারা দেশ ও সমাজের শত্রæ,যারা মহান মা’বুদের বিধি বিধান গুলোকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সাথে দেখেন,তাঁর নিয়ম নীতি গুলো পালনকারীদের কে বাঁকা চোখে দেখেন,ঠাট্রা বিদ্রæপ ও মশকড়া করেন,শুধুমাত্র তাদের বাক শক্তি, দৃষ্টিশক্তি হরণ করে নেন এবং আর ফিরিয়ে না দেন তাহলেই বা কারো কিছু করার আছে কি? না না কারো কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু তিনি অতি মহান সহজে তা করেন না ।তাহলে নামাজ রোজা হজ¦ যাকাত,মানবতা মনুষত্ব,পরোপকার রোগীর সেবা ভাল কাজের আদেশ মন্দ কাজের নিষেধ কুরবানী,ইত্যাদি আমলে সলেহ এর মাধ্যমে তিনি জেনে নিতে চান সত্যিকার অর্থে তাঁর আসমান জমিনে তাঁরই দেয়া জীবন-মরনের মাঝখানে তাঁর নিয়ম নীতির প্রতি কার কতটুকু ভালবাসা, আনুগত্য আন্তরিকতা এবং একনিষ্ঠতা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন