বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

চামড়ার দরপতন : কপাল পুড়েছে এতিমের

মো. এমদাদ উল্যাহ | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

কাঁচামালের সহজলভ্যতার পাশাপাশি মূল্য সংযোজনের হিসেবে সবচেয়ে বেশি রফতানি আয়ের অন্যতম বড় উৎস চামড়া শিল্প। এ কথা শুধু কাগজে কলমেই। স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে হঠাৎ দরপতন হয়েছে এ শিল্পের। কোরবানীর চামড়ার দাম কমিয়ে সিন্ডিকেটের কোন উদ্দেশ্য এখন পর্যন্ত তা বের করা সম্ভব হয়নি। এতিমের হক হিসেবে খ্যাত কোরবানীর চামড়ার দরপতনে কপাল পুড়েছে এতিম ও মৌসুমী ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের। অনেক স্থানে এতিখানা ও মসজিদে দানের চামড়াও বিক্রি হয়নি। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে উপযুক্ত দাম না পাওয়া সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায় একত্রে ৯’শ চামড়া পুতে ফেলা হয়।

ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকার ও ব্যবসায়ীরা মিলে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৪৫-৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫-৪০ টাকা। গত বছর প্রতি বর্গফুটের দাম একই ছিল। ২০১৭ সালে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ঢাকায় ৪৫-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০-৪৫ টাকা। এছাড়া সারাদেশে খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকায় সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে ব্যবসায়ীদের। কিন্তু একটি গরুর চামড়া ৪৫-১০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে কোরবানীদাতাদের। অবস্থা এমন যে, কে শুনে কার কথা?

চামড়ার এমন দরপতনের বিষয়ে একে অপরকে দোষারোপ করেন। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা দোষারোপ করছেন পাইকারি ক্রেতাদের, পাইকারি ক্রেতারা বলছেন আড়তদাররা কম দামে চামড়া ক্রয় করছেন। আড়তদার বলছেন ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমাদের বকেয়া পরিশোধ করেনি। যার ফলে, অর্থ সংকটে চামড়া ক্রয় করতে পারছেন না। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বলছেন সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমানো হয়েছে। তারপরও প্রতিযোগিতা করে কোরবানির পশুর চামড়া কিনে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা। প্রতি চামড়ায় ১’শ থেকে ৩’শ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনেছেন। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রিতে একটি চেইন আছে। ট্যানারির মালিকরা দাম কম দিলে অন্যরাও কম দিতে বাধ্য হয়। তবে ট্যানারি মালিকরা বিশ্ববাজারে ভালো দামে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করলেও আড়তদার, চামড়া সংগ্রহকারীদের সে সুযোগ থাকে না।

সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে এ শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি পণ্য হওয়া সত্তে¡ও সিন্ডিকেটের কারসাজিতে শিল্পটি বিপন্ন হতে চলেছে। তৃণমূল পর্যায়ে বিক্রেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার পেছনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সঙ্গে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। এ দুইয়ের কারসাজিতে চামড়া শিল্প আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। যেমন-প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত ২২ কোটি ঘনফুট চামড়ার প্রায় অর্ধেকই ব্যবহৃত হচ্ছে না রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনে। চামড়ার আন্তর্জাতিক ক্রেতাজোট লেদার ওয়ার্কিং গ্রæপের ছাড়পত্র না থাকাই এর মূল কারণ। কিন্তু প্রতি মাসেই নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রায় ৫০ লাখ বর্গফুট চামড়া আমদানি করছে। গত ৪-৫ বছরে চামড়া এবং চামড়াজাত সব পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু চামড়ার দাম কমেছে অর্ধেক। কাঁচা চামড়ার দাম কমছে, চামড়াজাত পণ্যের দাম বাড়ছে কেন?-এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য গার্মেন্টসের পরই এখন চামড়া শিল্পের অবস্থান। জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, রাশিয়া, ব্রাজিল, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। চামড়াজাত পণ্যের প্রধান ক্রেতাদের অন্যতম চীন। এবারে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। চীন কম দামে পণ্য কেনার আল্টিমেটাম দিয়েছে। ফলে কোনোভাবেই নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কাঁচা চামড়া কেনা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয় ১১৩ কোটি ডলার। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬ কোটি ডলারে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে এই আয়ের পরিমাণ আরও বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। কিন্তু ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে রফতানি আয় অস্বাভাবিক কমে ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ওই অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১২ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ১০১ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এ ক্ষেত্রে আয় কম হয়েছে ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চামড়া খাত থেকে ৮৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। যদিও এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। এ হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ এবং আগের অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ আয় কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের কোরবানির ঈদে চামড়া সংগ্রহের জন্য দেয়া প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ঋণের বেশির ভাগই আদায় হয়নি। যদিও এবার কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক থেকে ট্যানারি মালিকদের ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। গত বছরের ঋণের অর্থ আদায় না হওয়ায় এ ঋণ বিতরণ নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়। এছাড়া নতুন ট্যানারি নির্মাণ করায় পুঁজির সংকটে আছে ট্যানারি মালিকরা। এবারে ৪২টি ট্যানারি কাঁচা চামড়া কিনতে ৬০১ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পেয়েছে। অন্যরা ঋণ পায়নি।

খবরে প্রকাশ, চামড়া শিল্পে সংকটের নেপথ্যে ২৯টি কারণ রয়েছে। কারণগুলো হচ্ছে- সঠিক পরিকল্পনার অভাব। চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন কমে যাওয়া। চামড়া শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে না তোলা। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কারখানার পরিবেশ উন্নত না করা। চাহিদার তুলনায় ব্যাংক ঋণ না পাওয়া। পুঁজি সংকট। দক্ষ শ্রমিকের সংকট। গতবারের চামড়া এখনো প্রক্রিয়াজাত করতে না পারা। আগের বছরের সংগৃহীত কাঁচা চামড়ার গুণগত মান কমে যাওয়া। নতুন চামড়া সংরক্ষণে স্থান সংকট এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। চামড়া কাটার পর বর্জ্য কোথায় ফেলা হবে সেটি নির্ধারণ করতে না পারা। সাভারে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ কাজ শেষ না করে কারখানা স্থানান্তর করা। সাভারে ট্যানারিপল্লীতে অবকাঠামোগত সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন না করা। নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ ও সময়মত গ্যাস সংযোগ দিতে না পারা। লোডশেডিং। জেনারেটর ব্যবস্থা ভালো না হওয়া। সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা। জমির দলিল হস্তান্তরসহ নানা বিষয় নিয়ে চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব। তিন বছরেও সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে প্রত্যাশা অনুযায়ী সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারা। কারখানা স্থানান্তরের পরও অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে না পারায় রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে যাওয়া। হাজারীবাগে ২০৫ টি কারখানা থাকলেও সাভারে মাত্র ১৫০টি প্লট বরাদ্দ দেয়া। প্লট না পাওয়া ৫৪টি কারখানা বন্ধ হওয়ায় এসব কারখানার শ্রমিকদের বেকার হয়ে যাওয়া। অবৈধ পথে চামড়া পাচার। বিশ্ব বাজারের দরপতনে দেশের চামড়া শিল্পের অবস্থান আন্তর্জাতিক বাজারে দুর্বল হয়ে যাওয়া। টানা কয়েক বছর ধরে চামড়া রফতানি আয় কমে যাওয়া। আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্যের আধুনিকায়নে সামঞ্জস্যতা না থাকা। চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ। বিশ্ববাজারে চামড়ার জুতার পরিবর্তে সিনথেটিক বা কাপড় জাতীয় জুতার আগ্রহ বৃদ্ধি।

আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম ও চাহিদা কমে যাচ্ছে। সেটার প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়ছে। পরিস্থিতির কারণে গতবারের চামড়াই এখনো প্রক্রিয়াজাত করতে পারিনি। এতে সংগৃহীত কাঁচা চামড়ার গুণগত মান কমে যাচ্ছে। নতুন চামড়া সংরক্ষণে স্থান সংকট রয়েছে। অনেক ট্যানারি এখনো উৎপাদনে যায়নি। এসব কারণে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে দুশ্চিন্তা অব্যাহত রয়েছে। তবে এর মধ্যেও দেশজুড়ে চামড়া কেনাবেচায় কয়েকটি হাত বদল হয়, এটার সংখ্যা কমাতে আহŸান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলে আরও সুবিধা পাওয়া যাবে। এজন্য সরকারকে নজরদারি বাড়াতে হবে।

ট্যানারি মালিকরা জানান, টেকসই পরিবেশ অনুশীলনের নির্দেশনা বজায় রাখার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রæপ চামড়া শিল্পনগরীতে প্রতিটি কারখানায় নিজস্ব ইটিপি স্থাপনসহ বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে যথাযথ মূল্য পাচ্ছেন না এখানকার উদ্যোক্তারা। ফলে চাহিদাও কমে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়। এমন পরিস্থিতিতে কাঁচা চামড়া রপ্তানির বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত এ শিল্পের ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত।

গত ১৪ আগস্ট বুধবার সকালে সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেট হয়েছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কারসাজি হয়ে থাকলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

চামড়া শিল্পকে রক্ষা করতে হলে সরকারকে এখনই সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে সিন্ডিকেটের কারসাজি। পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে চামড়া শিল্পের ঐতিহ্য ফিরে আসবে। লাভবান হবে সকলেই। রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ আয় হবে। ভবিষ্যতেও আর কোন সমস্যায় পড়তে হবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন