শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শ্রমবাজার বিকাশে পুলিশের প্রতিবন্ধকতা

| প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বিদেশে দেশের শ্রমবাজার বৃদ্ধি এবং ধরে রাখার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন অন্তরায় হয়ে উঠেছে। বিদেশ গমনেচ্ছুদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করার ক্ষেত্রে পুলিশের দীর্ঘসূত্রীতা এবং হয়রানির কারণে দেশের অর্থনীতির অন্যতম মূল স্তম্ভ এ খাতটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যেখানে সরকার রেমিট্যান্স ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং যে রেমিট্যান্স জিডিপির ১২ শতাংশ জোগান দিচ্ছে, সেখানে পুলিশের এ ধরনের শৈথিল্য ও দীর্ঘসূত্রীতা যেন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এ সার্টিফিকেট ছাড়া ভিসা পাওয়া যায় না। এ কাজটি করতে এক-দুই দিনের বেশি লাগার কথা নয়। অথচ বিদেশ গমনেচ্ছুদের এই ক্লিয়ারেন্স পেতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লেগে যাচ্ছে। এটা এ সংশ্লিষ্ট পুলিশের গাফিলতি, অনিয়ম ও দুর্নীতি ছাড়া কিছুই নয়। দেশের অর্থনীতির এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে পুলিশের এ ধরনের আচরণ মোটেও কাম্য না হলেও, তা সবসময়ই ঘটে আসছে। বিদেশ গমনেচ্ছুদের ক্ষেত্রে প্রতারণা ও প্রতিবন্ধকতা যেন তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ শ্রমবাজার সউদী আরবে গমনেচ্ছুদের ক্ষেত্রে এই প্রতিবন্ধকতা তীব্র হয়ে উঠছে। ফলে দেশটি অনেকটা বিরক্ত হয়ে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এক্ষেত্রে কিছু অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রতারণা দেশের ভাবমর্যাদা ভুলুন্ঠিত করছে। সম্প্রতি সউদী আরবে গমনেচ্ছু কয়েক হাজার কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করে পাঠানোর দায়ে দেশটির ঢাকাস্থ দূতাবাস প্রায় ২০০ অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভার ব্লক করে দিয়েছে। এছাড়া গালফ অ্যাপ্রুভড মেডিক্যাল সেন্টার অ্যাসোসিয়েশন (গামকা) সম্প্রতি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে বাংলাদেশের ১৫টি মেডিক্যাল সেন্টারকে অকার্যকর ঘোষণা করেছে। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শ্রমবাজার হারানোর উপক্রম হয়েছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সউদী আরবে প্রায় ২০ লাখের মতো বাংলাদেশি কর্মে নিয়োজিত। হাড়ভাঙা খাটুনির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এ দেশটি থেকেই আসছে। গত জুলাইয়ে এসেছে ৩৩১.২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ এ দেশটিতে শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে পুলিশসহ কিছু অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সময়মতো পুলিশ ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ায় একদিকে যেমন ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে গমনেচ্ছুরা আর্থিক ও মানসিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় কার্যাবলী সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে সউদী প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের দিকে ঝুঁকছে। এর কারণ বাংলাদেশ থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে যেখানে দেড়-দুই মাস সময় লাগে, সেখানে আফ্রিকার দেশগুলো নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে মাত্র তিন দিনে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, প্রবাসী মন্ত্রী গত ২৫ জুন সউদী শ্রমবাজারকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস স্থাপনের মাধ্যমে ২৪ ঘন্টায় বিদেশ গমনেচ্ছুদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ইস্যুর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রস্তাব দেয়ার পরও তা অদ্যাবধি বাস্তবায়ন করা হয়নি। অথচ দ্রুত সময়ে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেলে এবং সউদী দূতাবাসে পাসপোর্ট জমা দিলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ভিসা পাওয়া যায়। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে পুলিশ এ কাজটি যথাযথভাবে করছে না। এ ক্ষেত্রে তারা লোকবলের অভাবের অজুহাত দেখাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যেখানে তল্লাশির নামে সাধারণ মানুষকে এবং সড়কে গাড়ি থামিয়ে অযথা হয়রানি করতে পুলিশের অভাব হয় না, সেখানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ খাতেই কেবল তাদের লোকবলের অভাব দেখা দেয়। যেহেতু পাসপোর্ট করার সময়ই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সব ধরনের তথ্যের ভেরিফাই করা হয়েছে, তাই এক্ষেত্রে নতুন করে ভেরিফাই বা সময় ক্ষেপণ করারও কারণ থাকতে পারে না। কাজেই পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো যুক্তিই ধোপে টিকে না। বরং তাদের এ আচরণ চরম গাফিলতি ছাড়া ছাড়া কিছু নয়। অন্যদিকে কিছু অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণামূলক কর্মকান্ড ও মিথ্যা তথ্যের কারণে হাজার হাজার বিদেশ গমনেচ্ছু যেমন সর্বসান্ত হচ্ছে, তেমনি বিদেশেও দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বিদেশে যাওয়ার পর শ্রমিকদের কেউ সেখানের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আটক হলে তার বদনাম অন্যান্য লাখ লাখ বৈধ শ্রমিকের পাশাপাশি দেশের ওপর এসে পড়ে। এর ফলে সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোও তখন বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ইতোমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়ার সংখ্যা তারা কমিয়ে দিচ্ছে। তারা আফ্রিকার দেশগুলোর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে এবং সেখান থেকে শ্রমিক নিচ্ছে। এর একটাই কারণ দেশগুলো তাদের শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে খুবই আন্তরিকতার সাথে প্রয়োজনীয় সব কাজ দ্রুততম সময়ে করে দিচ্ছে। এর বিপরীত চিত্র আমাদের দেশে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, পুলিশের অসহযোগিতা ও দীর্ঘসূত্রীতা, কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির অসাধুতা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম এ স্তম্ভটিকে দিন দিন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ধরনের অপকর্মকে দেশের স্বার্থ এবং দেশবিরোধীতার শামিল।

দেশের শ্রমবাজার টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এবং এর সম্প্রসারণে পুলিশের সময়ক্ষেপণসহ কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির অপকর্ম যেভাবে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে, তা দূর করতে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে বিদেশ গমনেচ্ছুদের যাতে হয়রানির শিকার হতে না হয় এ বিষয়টি সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। প্রবাসী মন্ত্রী ২৪ ঘন্টার যে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালুর প্রস্তাব দিয়েছেন তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা কাজের জন্য বিদেশ যাচ্ছে তাদের জীবনবৃত্তান্তসহ ডাটাবেজ তৈরির যে নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, তা কার্যকর করতে হবে। যেসব অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা ও অনিয়মের কারণে শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, দেশের স্বার্থে সেসব এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের লাইসেন্স বাতিল করে দিতে হবে। দেশের বিশাল অর্থনৈতিক খাত নিয়ে একটি শ্রেণী ছিনিমিনি খেলবে, তা হতে দেয়া যায় না। এ খাতকে আরও গতিশীল এবং শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য যত ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায়, তার সব পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন