বিশে^র প্রথম মানব বাবা আদম (আ.) এর আবির্ভাব ঘটেছিল সূর্যোদয়ের দিগন্তে, যার মাধ্যমে মানব সভ্যতার সূচনাও হয় সে অঞ্চল থেকে! সমগ্র বিশে^র নাভী অর্থাৎ মধ্যস্থল নামে খ্যাত আল্লাহর আদি গৃহ ‘কাবা’য় গিয়ে প্রথম হজ¦ পালন করেন বাবা আদম (আ.), তাও এক বার নয়, দুই বার নয়, চল্লিশ বার এ হজ¦ করেন বলে কথিত। আর সেখান থেকেই মানব সভ্যতা দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং, সূর্যোদয়ের এ দিগন্তের মানুষদের সৌভাগ্য ও গর্বের বিষয় যে, তাদের অঞ্চল থেকেই প্রথম মানব আল্লাহর আদি গৃহ কাবায় গিয়ে হজ¦ করেন। এ বক্তব্য সম্পর্কে যুগে যুগে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যেমন: জান্নাত হতে আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-কে কোথায় নামানো হয়? তারা কোথায় জীবন যাপন করেন? কীভাবে করেন? কোন পথে মক্কা পর্যন্ত এ বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করেন? তার সমগ্র জীবনটা কী অবতরণের স্থলে কেটেছে এবং তার বংশধরেরা কি সেখানে বিস্তার লাভ করে?
কোরআনে এসব বিষয়ের বিবরণ নেই, তবে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থ ও মহানবী (সা.) এর হাদীস যারা ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ জাতীয় কাহিনী পুস্তকাদি রচনা করেছেন, তাতে আদমের জীবন বৃত্তান্ত যেমন অপ্রতুল, অপর্যাপ্ত তেমনি কোরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনাবলী ব্যতীত অনেকটাই ‘ইসরাইলীয়াত’ (ভিত্তিহীন, কাল্পনিক, অতিরঞ্জণ) বলে আখ্যায়িত করা হয়। সে সব বিষয় এখানে আমাদের প্রতিপাদ্য নয়।
প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে উপমহাদেশের বিখ্যাত মোহাদ্দেস শাইখুল ইসলাম হজরত মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) এর একটি বক্তব্যের মাধ্যমে মূল বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। তার বক্তব্যটি কোন কোন পুস্তিকায় প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়। তাতে তিনি বলেছেন, “পৃথিবীর প্রথম মানুষ হজরত আদম (আ.) স্বর্গ হতে নেমে সর্বপ্রথম পদার্পণ করেছিলেন ভ‚মÐলের ভারত ভ‚মিতেই। জায়গাটা ছিল সিংহল, যেটা তখন ভারতেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইসলাম ধর্ম বলে, আল্লাহর প্রচুর পরিমাণ ফেরেশতা আছেন, তাঁদের মধ্যে প্রধানতম হজরত জিব্রাইল (আ.)। তাঁর পৃথিবীতে প্রথম পদধূলী পড়েছিল ভারতে। যেহেতু প্রত্যেক নবীর নিকট তাকে আল্লাহর প্রত্যাদেশ পৌঁছাতে হত। এটাও বিশে^র মুসলমানদের নিকট ভারতের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য।”
হজরত মাওলানা মাদানী (রহ.), ‘সিংহল’ এ হজরত আদম (আ.) এর পদার্পণ এবং সেখানে হজরত জিবরাইল (আ.) এর পদার্পণ করাকেও ভারতের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাশাপাশি ভারতে বিখ্যাত ইসলামী ইতিহাসবিদ হজরত মওলানা হিফজুর রহমান (রহ.) তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘কাসাসুল কোরআন’ এ আদম (আ.) এর পদার্পণ সম্পর্র্কে এক অভিনব প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন এবং প্রত্মতত্ববিদদের উদ্ধৃত করে বর্তমান পৃথিবীর পূর্বের এক পৃথিবীর নতুন তথ্য তুলে ধরেছেন, যার নাম ছিল ‘মৌ’ বা ‘মাও’। তিনি বলেন “জান্নাতুল মাওয়া” হতে আদম (আ.)-কে যে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়, তা ‘জমিনি জান্নাত’ ছিল এবং তার নাম ছিল ‘মৌ’, যার উল্লেখ পূর্বেই করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তা ধ্বংস প্রাপ্ত, তিনি প্রতœতত্ববিদদের মতামত উদ্ধৃত করেছেন। যা এই রূপ: “যে সকল আলেম এ জান্নাতকে ‘জমিনি জান্নাত’ বলেন, তাদের মধ্যে প্রতœতত্ব বিশেষজ্ঞগণের দাবি ‘রুবয়ে মসকুন’ অর্থাৎ ‘চতুথাংশ বসতি’র যে অংশে জান্নাত কায়েম ছিল, উহা এখন জমিনি, ভ‚মন্ডলে বিদ্যমান নেই। এ অংশ ‘কারায়ে মৌ’/‘মাও’ (মহাদেশ) নামে এ পৃথিবীতে আবাদ ছিল, কিন্তু বিভিন্ন দুুর্যোগ ও লাগাতার ভ‚মি কম্পের দরুন তা হাজার হাজার বছর পূর্বে ভারত সাগরে বিলীন হয়ে যায় এবং এ ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন এ অংশে বসবাসকারী মানব আবাদী (জন সংখ্যা) ছিল প্রায় ৬০ মিলিয়ন (৬ কোটি) যা ধ্বংস হয়ে যায় এবং বাইবেলে ঐ স্থানের অবস্থান বলা হয়েছে, যেখান থেকে ‘দাজলা’ ও ‘ফোরাত’ নির্গত হয়েছিল। (১ম খন্ড পৃ: ৩১-৩২)
কোরআনে বর্ণিত আয়াতে উল্লেখিত ‘ইহবিতু মিনহা জামীআন’ অর্থাৎ ‘তোমরা সবাই এক সঙ্গে নেমে পড়’, বাক্যের অর্থ করতে গিয়ে বহু তফসীর ও অন্যান্য সূত্রে আদম (আ.) এর অবতরণের স্থল সরণদ্বীপ (সিংহল) বলা হয়েছে এবং সেখানে আদম (আ.) এর পদচিহ্ন ও কবর বিদ্যমান বলে ইতিহাসের বর্ণনা হতে জানা যায়। আধুনিক গবেষক লেখকদের পরিবেশিত বিভিন্ন তথ্য চিত্র তার প্রমাণ। সেখান থেকে তিনি খানা ই কাবয় গিয়ে হজ¦ করেন বলে, প্রাচীন কাল থেকে তা প্রচলিত হয়ে আসছে এবং বলা হয় তিনি এভাবে চল্লিশ বার হজ¦ পালন করেন।
বিজ্ঞ ‘কাসাসুল কোরআন’ লেখক কর্তৃক উদ্ধৃত প্রতœতত্ববিদদের অভিমতের প্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এসে যায় এবং তা এই যে, আল্লাহ তাআলা কোরআনের অনেক স্থানে সপ্ত আকাশ ও সপ্ত জমিন (পৃথিবী) সৃষ্টি করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। সপ্ত আকাশে ফেরেশতারা অবস্থান করেন এবং আম্বিয়ায়ে কেরামের আত্মাও সেখানে। কয়েকজন নবীকেও আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। ‘হাদীসুল মেরাজ’ এ রসূলুল্লাহ (সা.) যে সব নবীর সাথে সাক্ষাত করেন, তাদের নাম উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সপ্ত পৃথিবীর কথা কোরআনে থাকলেও এই বনি আদমের পৃথিবী বাদে বাকি ৬টি পৃথিবী সম্পর্কে কোরআনে সরাসরি কিছু বলা হয়নি। তবে কোরআনের ৬৫ নং সূরা ‘তালাক’ এর একটি আয়াতে বলা হয়েছে, “আল্লাহুল্লাজি খালাকা সাবআ সামাওয়াতি ওয়ামান ফিল আরদি মিছলাহুন্না” অর্থাৎ- আল্লাহ’ই সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আকাশ এবং উহাদেরই অনুরূপ পৃথিবী। (আয়াত: ১২)
অন্যান্য ‘অনুরূপ’ পৃথিবীর উল্লেখ কোরআনে নেই, ফলে সেগুলো সম্পর্কেও কিছু জানা যায় না। প্রতœতত্ববিদরা একটি ধ্বংস প্রাপ্ত পৃথিবীর কথা বলেছেন ‘কারায়ে মৌ’। এতে অনুমিত হয় বিভিন্ন নামে আরও পৃথিবী ছিল।
আয়াতটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তফসীরে ‘খাজেন’ এ বলা হয়েছে, ‘আকাশ মন্ডলির প্রত্যেক আকাশে এবং ভ‚মন্ডলসমূহের প্রত্যেক ভ‚মন্ডলে আল্লাহর সৃষ্টি আছে, তার নির্দেশাবলীর নির্দেশ আছে এবং তার কার্যবিধান বলির বিধান আছে। কাতাদাহও অনুরূপ বলেছেন। (৬ষ্ঠ খন্ড পৃ: ৯৫)
অনেকে বলেছেন, এসব পৃথিবী স্তরে স্তরে সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থাৎ ওপরটির পরে নিচেরটি এভাবে সাতটি পৃথিবী রয়েছে এবং ওপরের পৃথিবী হতে নিচের পৃথিবীর ব্যবধান ৫০০ বছরের। বছর গণনার হিসাবটা নিশ্চই এ পৃথিবীর গণনার হিসাব অনুযায়ী। কেউ কেউ বলেন, সপ্ত পৃথিবী বিক্ষিপ্ত আলাদাভাবে বিভিন্ন অঞ্চলেও হতে পারে। একই সময়-কালের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে আলাদাভাবে অস্তিত্ব ধারণও করতে পারে। ঐসব পৃথিবীকে এই পৃথিবীর নিচে অবস্থিত বলে হাদীসে যে বর্ণনা রয়েছে তা হয়তো কোন কোন অবস্থায় হয় এবং কোন অবস্থায় ঐ সব পৃথিবী এই পৃথিবীর উপরে এসে যায়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর বর্ণনা, যাতে আছে ‘আদমুহুম কা আদমিকুম’ (তাদের আদম তোমাদের আদমের ন্যায়) ইত্যাদি এর ব্যাখ্যা করার এটি স্থান নয়। ‘রুহুল মায়ানী’ গ্রন্থে এতদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কিছু কথা আছে এবং হজরত মাওলানা মোহাম্মদ কাসেম (রহ.) এর কোন কোন পুস্তিকায় উহার কোন কোন দিক স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। (তফসীরে ওসমানী, সূরা: তালাক, পৃষ্ঠা: ৭৪২)
এবার আদমের কথায় ফিরে আসা যাক। জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরণের পর আদম (আ.) সরণ দ্বীপে অবস্থান করতে থাকেন। কিন্তু সেখানে তার জীবনের বিবরণ পাওয়া যায় না। হাওয়া (আ.)-কে আরাফাতে অবতীর্ণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কাজেই ধরে নিতে হয় সরণ দ্বীপেই আদম (আ.) একক জীবন যাপন করছিলেন। তিনি হজে¦ যাওয়ার পর হজরত হাওয়া (আ.) এর সাথে তার পরিচয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর আগে তার একাকিত্ব জীবন যাপন করা অস্বাভাবিক নয়।
হজরত আদম (আ.) এর সাথে কাবা ও হজ¦ ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ায় বিষয়টি দেখা যাক, কোরআনে কী বলা হয়েছে। একটি আয়াতে কাবাকে ‘আউয়ালু বায়েত’ অর্থাৎ প্রথম বা আদি গৃহ বলা হয়েছে। এ আদি গৃহের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাদীস ও তফসীর গ্রন্থগুলোতে কাবাগৃহের প্রথম নির্মাতা হিসেবে হজরত আদম (আ.) কে বলা হয়েছে। সুতরাং, আদম (আ.)-কে পৃথিবীর কোন স্থানে অবতীর্ণ করা হয় সে বিষয়ে আলোকপাত করার আগে খানা-ই কাবা নির্মাণের বিষয়টি আলোচনা করা প্রয়োজন। একটি বর্ণনা হতে জানা যায়, আল্লাহ তাআলা আর্শের নিচে ‘বায়তুল মামূর’ নির্মাণ করেন এবং ফেরেশতাদেরকে তা তাওয়াফ করার নির্দেশ দেন এবং নির্দেশ মত তারা একটি ঘর নির্মাণ করেন এবং এর নাম রাখা হয় ‘জাররাহ’ এবং পৃথিবীতে বসবাসকারীদের তাওয়াফ করার জন্য নির্দেশ দেন।
স্বাভাবিক ভাবেই বলা যায়, হজরত আদম (আ.) যে মহাভারতের ওপর দিয়েই মক্কায় আসা যাওয়া করেছেন, তবে নৌ পথে না কি স্থল পথে এবং নাকি অলৌকিকভাবে সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। হ্যাঁ, আল্লাহ তার ‘কুন ফায়াকুন’ শক্তি বলে সব কিছুই করতে পারেন।
আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)-কে তওবা করার জন্য কিছু বাক্য শিখিয়ে দেন। তখন তিনি দোয়া করেন ও তওবা করলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। আর এই তওবা-দোয়া কী ছিল, সে সম্পর্কে কয়েকটি বর্ণনা রয়েছে। কেউ বলেন, রাব্বানা যালামনা আনফুছানা.. শেষ পর্যন্ত, কেউ বলেন, লা ইলাহা ইল্লা আনতা সোবহানাকা.. শেষ পর্যন্ত, কেউ বলেন, ইয়া রাব্বি আরাইতা.. শেষ পর্যন্ত ইত্যাদি। তবে কেউ কেউ বলেন, আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)-কে হজ¦ করার নির্দেশ দেন এবং তাকে হজে¦র আরকান শিক্ষা দেন। অতঃপর তিনি সাতবার বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করেন, দুই রাকাত নামাজ পড়েন। অতঃপর বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে তওবা করেন। (খাজেন)
কিন্তু অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, আদম (আ.) যখন হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর নামের অছিলায় দোয়া করেন, তখনই তার দোয়া কবুল হয়। আরো বর্ণিত আছে যে, জান্নাতে আদম (আ.) এর ভাষা ছিল আরবী। অবতরণের সময় তা লুপ্ত করে সুরিয়ানী ভাষা তার মুখে জারী করে দেওয়া হয় এবং তওবা কবুল হবার পর আবার আরবী ভাষা তার মুখে জারী করে দেয়া হয়। তার জীবন যাত্রার বিবরণ অজানা, তবে সেখানে তার কবর রয়েছে বলেই ইতিহাস হতে জানা যায় এবং বলা হয়ে থাকে যে, তিনি সরণদ্বীপ হতে চল্লিশ বার মক্কা শরীফে গিয়ে হজ¦ পালন করেন। বেহেশত হতে আদম (আ.) এর পৃথিবীর পূর্ব দিগন্তে পদার্পণ এবং সেখান থেকে মক্কায় গিয়ে হজ¦ পালন এতদাঞ্চলের লোকদের বিশেষত মুসলামনদের জন্য পরম সৌভাগ্য ও গর্বের বিষয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন