ইসলাম জ্ঞান অর্জনকে ফরজ করেছে। অজ্ঞতা হলো অভিশাপ। রাসূলে পাক (সা.) বলেন, জ্ঞান অর্জন প্রতিটি নরনারীর ওপর ফরজ। মহান আল্লাহ পাক জ্ঞান অর্জনের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই তিনি রাসূলে পাক (সা.)-এর নিকট অহির প্রথম শব্দটি ‘ইকরা’ দিয়ে শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন করো, জ্ঞানহীন ব্যক্তি ইসলামকে বুঝবে না। আল্লাহ পাক নিজেই বলেছেন, ‘আমি মানব জাতির জন্য যে সমস্ত দৃষ্টান্ত পেশ করি, তা একমাত্র আলেম (জ্ঞানী) ছাড়া অন্যরা বুঝতে পারে না।’ (সূরা আনকাবুত, আ. ৪৩)।
অর্থাৎ আল্লাহ পাকের তাওহিদের স্বরূপ বর্র্ণনা করে যে দৃষ্টান্তগুলো পেশ করা হয়, সেগুলো তাৎপর্য মূর্খদের পক্ষে বুঝে ওঠা কিছুতেই সম্ভব নয়। আল্লাহপাক অন্যত্র বলেছেন, ‘বলো, যারা জ্ঞান লাভ করেছে এবং যারা করে নাই, তারা কি সমমর্যাদার অধিকারী?’ (সূরা জুমার, আ. ৯)।
রাসূলে পাক (সা.) সাধারণ জ্ঞানীকে আলেম বলেননি। তিনি আলেমের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা হলো আলেম ঐ ব্যক্তিকে বলা হবে, যিনি সাধারণ জ্ঞান অর্জন করার সাথে সাথে আল্লাহ পাকের কালাম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, তার ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। এবং তার অসন্তুষ্টি কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। তার মানে কোরআন-হাদিসের কতগুলো শব্দ জেনে নিলেই তাকে আলেম বলা হবে না।
প্রকৃত আলেম হওয়ার জন্য দু’টি শর্ত- (১) কোরআন-হাদিস বুঝা, (২) এর ওপর আমল করা। কোনো আলেম যদি বা-আমল না হন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি কোরআন-হাদিস বুঝেনইনি। কারণ, বুঝলে আমল অবশ্যই করতেন। ধরুন, আপনি বুঝলেন যে, বিষপান করলে মৃত্যু অবধারিত। এখন কি আপনি বিষপান করবেন?
ওষুধ খেলে রোগ ভালো হবে, আপনি কি ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন? থাকবেন না। কারণ, এ ব্যাপারে আপনি জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছেন। কাজেই জোর করে কেউ আপনাকে বিষপান করাতে পারবে না। আর আপনার যদি সেই জ্ঞান না থাকে? তাকলে বিষকেও ওষুধ মনে করে খেয়ে ফেলতে পারেন, যা আপনার জন্য ডেকে আনবে মারাত্মক পরিণতি।
ইসলাম হলো যুক্তিপূর্ণ বিজ্ঞানময় ধর্ম। কোরআনের নাম হলো বিজ্ঞানময় কোরআন। আল্লাহপাক কোরআনকে পাঠিয়েছেন বুঝে পড়া জন্য এবং সে অনুযায়ী আমল করার জন্য। আর কোরআন বুঝতে হলে আলেম হতে হবে। আলেম হওয়ার জন্য মাদ্রাসার প্রয়োজন। কারণ, মাদ্রাসাতে কোরআন-হাদিসের প্রকৃত শিক্ষা দেয়া হয়। কাজেই একজন মুসলমানের জন্য, মুসলমানিত্ব রক্ষা করার জন্য মাদ্রাসার বিকল্প নেই। আল্লাহপাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য; অন্য কোনো কাজের জন্য সৃষ্টি করেননি।
প্রশ্ন হতে পারে, যদি সারাদিন ইবাদতেই মগ্ন থাকতে হয়, তাহলে সংসার চলবে কিভাবে? দুনিয়াবী কাজকর্মই বা চলবে কিভাবে? উত্তর হলো, হ্যাঁ, সবই চলবে। তারপরও আল্লাহপাকের হুকুমের বরখেলাপ হবে না। দুনিয়াবী কাজকর্মগুলো সবই ইবাদতে গণ্য হয়ে যাবে। তবে সেটি হতে হবে আল্লাহপাকের নির্দেশ অনুযায়ী।
এখন কোন কাজটা আল্লাহপাকের নির্দেশ অনুযায়ী হলো আর বোন কাজটা আল্লাহপাকের নির্দেশের পরিপন্থী- সেটি শিক্ষা দেয় মাদ্রাসা। মাদ্রাসা আরো যেসব বিষয় শিক্ষা দেয় তার মধ্যে রয়েছে, কারো ওপর জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতন করো না, কারো সাথে অন্যায় আচরণ করো না। কারো হক নষ্ট করো না। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মস্তানি কাজে অংশগ্রহণ করো না।
ঘুষ, সুদ থেকে দূরে থেক। অন্যায় অশ্লীলতা থেকে দূরে থেক। জিনা, ব্যভিচার এবং অন্যের সম্ভ্রমহানি করো না। হারাম পথে উপার্জন থেকে বিরত থেক। হালাল খাদ্য গ্রহণ করো। হালাল পথে চলো ইত্যাদি ইত্যাদি। উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো শিক্ষা দেয় মাদ্রাসা।
আল্লাহপাকের অহদানিয়াতের শিক্ষা দেয়া হয় মাদ্রাসায়। এই জীবনের পর আর একটি জীবন আছে। যেখানে বিচার হবে সকল প্রকারের অন্যায়ের। তারপর বিচারের ফয়সালা অনুযায়ী বেহেশত-দোজখ নির্ধারিত হবে। এটি প্রতিটি মুসলমানের বিশ্বাস, ঈমান।
আর এগুলো শিক্ষা দেয়া হয় মাদ্রাসায়। শিক্ষাই মানুষকে নৈতিকতাবিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেয়। মাদ্রাসা শিক্ষাই মানুষকে দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ সচেতন করে। দেশের জন্য জীবন দিতে উদ্বুদ্ধ করে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে, দেশের মানুষ এবং সম্পদকে রক্ষার জন্য জিহাদে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করে। মাদ্রাসা শিক্ষাই মানুষকে আত্মসচেতন করে।
সবচেয়ে বড় যে কাজটি মাদ্রাসা শিক্ষার ফলে সম্ভব হয়, সেটি হলো, আল্লাহপাকের কোরআন এবং রাসূলে পাক (সা.)-এর হাদিসের মূল তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। যার ওপর নির্ভর চিরস্থায়ী জীবনের সফলতা।
ইহজগৎ হলো ক্ষণস্থায়ী। চিরস্থায়ী জীবন হলো কিয়ামতের পর থেকে যে জীবন শুরু হবে। তবে ইহজগৎ ক্ষণস্থায়ী হলেও এর গুরুত্ব অত্যধিক। কারণ, এই জগতের কর্মফলের ওপরই নির্ভর করে পরকালীন সুখ।
কাজেই কর্মফলটা এমন হতে হবে, যাতে পরকালীন জীবনের সুখের পথে কোনো প্রকারের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়। আর এই সঠিক কর্মসম্পাদনের দিকনির্দেশনা প্রদান করে মাদ্রাসা শিক্ষা। তাই দেখা যায় মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরাই রুখে দাঁড়িয়েছিল সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হরণকারীদের বিরুদ্ধে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইত্যাদি ইত্যাদি।
যার ফলে সমস্ত আগ্রাসনকারী, অপসংস্কৃতিসেবী, বিধর্মী, নাস্তিক, দুর্নীতিবাজে দুষ্কৃতকারী, ব্যভিচারী আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের (সা.) দুশমনদের পরম শত্রু হলো মাদ্রাসা শিক্ষিত আলেমগণ। কাজেই তাদের ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আলেম সমাজকে নিশ্চিহ্ন করার প্রাথমিক কাজ মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়া।
মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেলে কোরআন-হাদিসের শিক্ষায় শিক্ষিতরা থাকবে না। মসজিদের ইমামরা থাকবে না। ওয়ায়েজিন কেরামরা থাকবে না, বিবাহবন্ধনের কাজীরা থাকবে না। সকল প্রকার অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কেউ থাকবে না।
এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে এসেছে নাস্তিক, বিধর্মী, খোদাদ্রোহী এনজিও কর্মীরা। তাদের সহায়তায় সর্বশক্তি নিয়ে সহায়তা প্রদান করছে বিশ্বের সমস্ত খোদাদ্রোহীরা। বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু অর্বাচীন এই অপশক্তির ক্রীড়নক হয়ে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক থাকলেও ধর্মীয় শিক্ষক দেয়া বন্ধ।
মাধ্যমিক স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক থাকলেও এর জন্য যে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, তাদের যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। মাদ্রাসার আলেম পাসকে এইচএসসির সমমর্যাদা দিলেও তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয় না (অর্থাৎ ভালো বিষয়ে)।
মাদ্রাসায় ইদানীং নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। নানা ছাল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, এগুলো ভুয়া মাদ্রাসা। প্রশ্ন হলো, মাদ্রাসা ভুয়া হয় কী করে? আর এগুলোর বিলই হয় কী করে? একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রায় ১৫টি ধাপ পার হতে হয়; তার মধ্যে জমি মাদ্রাসার নামে ওয়াকফ করে দেয়, মাদ্রাসার ঘর করা হয়।
(আলহাজ¦ মাওলানা এম এ মান্নান (রহ:)-এর রচনাবলি হতে সংগৃহীত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন