ঢাকা মসজিদের শহর। এই শহরে যত মসজিদ আছে, বলা হয় বিশ্বের অন্য কোনো শহরে এত মসজিদ নেই। এটা ঢাকার অত্যন্ত সম্মানজনক বিশেষ একটি পরিচিতি এবং এজন্য বাংলাদেশের মানুষ গর্ব করে থাকে। বিশ্বে অর্ধশতাধিক মুসলিম দেশ আছে। সে সব দেশে রাজধানী ছাড়াও বহু বড় বড় শহর আছে। কিন্তু কোনো শহরেই এত মসজিদ নেই। মসজিদের অধিক্য ঢাকার ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এই ঐতিহ্য, এই গৌরবময় পরিচিতি আজ ম্লান, মসিলিপ্ত। এই শহর এখন ক্যাসিনো জুয়ার শহর হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। সম্প্রতি ক্যাসিনো জুয়ার বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বিভিন্ন ক্লাব ও স্থানে অবৈধ ক্যাসিনোর সন্ধান পাওয়া গেছে। ঢাকার ৬০টি ক্লাবে ক্যাসিনো আছে বলে জানা গেছে। এক খবরে বলা হয়েছে, এই ৬০টি ক্যাসিনোতে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ গড়ে ৫০০ কোটি টাকার উপরে। ঢাকার বাইরের ক্লাবগুলোকে গণনায় আনলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। ক্লাবগুলো ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা প্রভৃতি বড় শহরে আরো বহু ক্যাসিনো জুয়ার আড্ডা বা স্থান রয়েছে। ঢাকাতে অন্তত ২৫টি ফ্ল্যাটে ক্যাসিনোর সন্ধান পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ধরনের ক্যাসিনোর আরো খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। কেমন করে মসজিদের শহর ক্যাসিনো জুয়ার শহরে পরিণত হয়ে গেল, সেটা একটা বড় বিস্ময়।
এ পর্যন্ত যেসব জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটি থেকেই ক্যাসিনো সরঞ্জাম, অস্ত্র, মদ ও টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা মূলত: সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের পরিচয়ধারী। শোনা যাচ্ছে, তাদের অনেকের সাথেই নেতৃস্থানীয় লোকদের সম্পর্ক আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার বা বদহজম কীভাবে ধরাকে সরাজ্ঞান করার দুঃসাহস যোগায়, ক্যাসিনো কান্ডে তার জাজল্যমান প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতদিনের রাজা-বাদশা-সম্রাটদের অনেকেরই এখন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকশ নাকি এর মধ্যেই দেশ ছেড়ে ভেগে গেছে। ক্ষমতা ও অর্থ-বিত্তের দৌর্দন্ড প্রতাপে যাদের মাটিতে পা পড়তো না, তারা এখন দৌঁড়ের ওপর, পালানোর জায়গা পাওয়াও তাদের জন্য অসম্ভবপ্রায়। ভাগ্যের পরিহাস বোধকরি একেই বলে।
কীভাবে ক্যাসিনো ‘কালচার’ ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লো, এর সূচনা যখনই হয়ে থাকুক, এটা সত্য, ক্ষমতাসীন দলের এক শ্রেণির নেতাকর্মী, প্রশাসন ও পুলিশের কিছু কর্মকর্তার আশ্রয়-প্রশ্রয় ও যোগসাজসেই গত ১০-১২ বছরে এই অবৈধ কারবার সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জুয়া মানে টাকার খেলা। নানা নামে বিশ্বে দেশে দেশে জুয়া চালু আছে। আামাদের দেশেও আছে। বলা হয়, জুয়ার একটি উন্নত সংস্করণ হলো ক্যাসিনো। যদিও এর উদ্ভব ইটালিতে ১৬৩৮ সালে। এরপর ইউরোপ থেকে এশিয়াসহ নানা দেশে তা বিস্তার লাভ করেছে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ক্যাসিনো জুয়ায় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, সিঙ্গাপুর পরিচিত ছিল। ভারতে এবং বাংলাদেশেও এর চর্চা চালু আছে। ব্যতিক্রম থাকলেও ক্যাসিনোতে মদ-জুয়া-নারী থাকবেই। যেহেতু জুয়া টাকার খেলা, সুতরাং এ খেলায় কেউ জিতবে কেউ হারবে। আর সবার কথা হলো, সার কথা হলো, যারা এর আয়োজক আখেরে তারাই জিতবে। জুয়ার সঙ্গে বিভিন্ন অপকর্ম ও অপরাধের ওতপ্রোত সম্পর্ক। জুয়ায়, মদে, অর্থে, নারীতে, সমাজ ও মানুষের অপকার ও ক্ষতি অবধারিত। এ কারণে সব দেশে ও সমাজেই এ সবের ওপর একটি নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্য করা যায়। ইসলামে এসবই পরিষ্কার হারাম।
হাজার হাজার বছর আগেও জুয়ার প্রচলন ছিল। কত রকমের যে প্রচলন ছিল, তার ইয়ত্তা নেই। এখনো শত শত রকমের জুয়ার প্রচলন রয়েছে। অর্থ জুয়ার প্রধান অনুষঙ্গ হলেও অন্যান্য অনুসঙ্গও যুক্ত হয়েছে। জুয়া, মদ ইত্যাদি শয়তানের নিকৃষ্ট কাজ। এতে মানুষের হিতের কিছু নেই। জুয়ায় সর্বশান্ত হওয়া অতি স্বাভাবিক ও সাধারণ ঘটনা। টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ, জমি-জিরাত খোয়ানো তো বটেই, এমনকি স্ত্রী খোয়ানোর ঘটনাও বিরল নয়। সবকিছু হারিয়ে অনেক সময় জুয়ারির আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে দেখা যায়। মদ-জুয়া মানুষের শত্রু, মানব সভ্যতার শত্রু, মানবতার শত্রু। ইসলাম মদ-জুয়াকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনের সুরা মায়েদার ৯০-৯১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : হে বিশ্বাসীরা, মদ, জুয়া, মূর্তি ও ভাগ্য পরীক্ষার তীর ঘৃণ্য বস্তুধারী, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো। শয়তান তো মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং আল্লাহর ধ্যানে ও নামাজে তোমাদের বাধা দিতে চায়।
এই আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে আল্লাহপাক অত্যন্ত দ্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, মদ, জুয়া ইত্যাদি শয়তানের কাজ। শয়তান এর দ্বারা মানুষের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ছড়াতে চায়, আল্লাহর ধ্যান ও নামাজ থেকে বিরত রাখতে চায়। সুতরাং আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ, মদ-জুয়া বর্জন করো। তাহলে সফল হতে পারো।
রাসুলুল্লাহ (স.) জুয়া খেলা তো দূরের কথা, সেদিকে আহ্বান জানালেও তার কাফফারা স্বরূপ সাদকা দেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, যে লোক তার সাথীকে আহ্বান করে ‘এসো তোমার সঙ্গে জুয়া খেলবো, এর কাফফারা স্বরূপ সদকা দেয়া উচিত। শুধু তাই নয়, তিনি জুয়ারীদের সালাম দিতেও নিষেধ করেছেন। বলেছেন- পাশা, সতরঞ্জ আর অলসতা সৃষ্টিকারী খেলায় মত্ত লোকদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের সালাম দিও না। অনুরূপভাবে মদ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, মদ থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, এটা সমস্ত অশ্লীলতার উৎস। তিনি আরো বলেছেন, মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি মূর্তি পূজকের সমান।
বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। এর ৯০ শতাংশ মানুষ ইসলামের অনুসারী। সেই দেশে জুয়া-মদের এভাবে সয়লাব বয়ে যাবে। সেটা কল্পনাও করা যায় না। অথচ অকল্পনীয় এই বাস্তবতা দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলাম থেকে কতটা বিমুখ হলে, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ থেকে কতটা দূরে সরে গেলে এমনটি হয়, সহজেই অনুমেয়। এটা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের জন্য কতটা ভয়াবহতার অশনীসংকেত, তা বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। অন্যায়, অপরাধ, অপকর্মের একটা অভয়ক্ষেত্র হয়ে উঠছে দেশ। এর খেসারাতও দিতে হচ্ছে নানাভাবে। খুন, অপহরণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নিতি-দুষকর্ম, ধর্ষণ ইত্যাদিতে মানুষ অতিষ্ট। এখনই শাসকদের, সমাজ পরিচালকদের সচেতন-শিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া না হলে আরো খেসারত দিতে হতে পারে। আর সকলকে সাবধান হতে হবে যা পরস্পরের মধ্যে বিবাদ-বৈরিতা সৃষ্টি করে। আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখে। অতএব সেই মদ জুয়ার ধারে কাছেও যাওয়া যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন