শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থানে মন্দা

| প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বৈদেশিক শ্রমবাজার। সউদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নতুন কর্মসংস্থান নীতি ও আয়কর ব্যবস্থার আওতায় একদিকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য নতুন ভিসা ইস্যু বলতে গেলে বন্ধ রয়েছে, সেই সাথে বিদ্যমান শ্রমিকদের নতুন আয়করের আওতায় আনার কারণে তাদের সেখানে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যেই মালয়েশিয়া, দুবাই ও বাহরাইনের মতো ট্রাডিশনাল শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ নতুন নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় মূলত গত এক দশক ধরেই অচলাবস্থা চলছে। শ্রমিক রফতানিতে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, মাত্রাতিরিক্ত খরচ এবং অবৈধ প্রক্রিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর কারণে সেখানে নানা ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়ায় মালয়েশিয়া সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে জিটুজি+ পদ্ধতিতে নামমাত্র খরচে বছরে লাখ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের চুক্তি করলেও সে সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে উভয় পক্ষই। পরোক্ষভাবে পরস্পরের প্রতি দায় চাপানোর চেষ্টা করা হলেও সমস্যা নিরসন করে শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর ব্যর্থতাই ধরা পড়ছে। বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং দ্বিপাক্ষিক নীতিমালা অনুসরণ করে স্বল্প খরচে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর কথা থাকলেও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে গড়ে ওঠা একাধিক সিন্ডিকেটের অনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা যায়।
প্রতি বছর দেশে লাখ লাখ নতুন মুখ কর্মসংস্থানের জন্য লাইন দিলেও আভ্যন্তরীণ বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে তেমন কোনো ইতিবাচক তৎপরতা নেই বললেই চলে। উপরন্তু নানা কারণে প্রতি মাসে শত শত গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের বাজারও সংকুচিত হয়ে পড়ছে। শেয়ার বাজারে ধস, হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাফের কারণে ব্যাংকের তারল্য সংকটসহ নতুন বিনিয়োগের সক্ষমতাও কমে গেছে। নানাভাবে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও সম্ভাবনাকেও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই এসব নিয়ে দেশের অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ ও নানা রকম সুপারিশ থাকলেও বাস্তবে তার কোনো ইতিবাচক ফলাফল দেখা যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সংস্কার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ ও আস্থাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সউদি আরব ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে বিদ্যমান সমস্যা দূর করতে না পারায় দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ থেকে উত্তরণে বিশেষ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।
একদিকে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে ঘাটতি বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। যেখানে ২০১৭ সালে সউদি আরবে সাড়ে ৫ লক্ষাধিক বাংলাদেশির কর্মসংস্থান হয়েছিল সেখানে ২০১৮ সালে তা কমে আড়াই লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যানের হিসাবে কমেছে শতকরা ৫৩ শতাংশ। তবে সামগ্রিকভাবে গত বছর বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে ২৭ ভাগ। চলতি বছরের প্রথমার্ধেও সে ধারা অব্যাহত ছিল বলে জানা যায়। অর্থনীতি ও রেমিটেন্স প্রবাহে গতি সঞ্চারের জন্য বর্তমান অর্থমন্ত্রী বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইতোমধ্যে দেশ সে সবের সুফল পেতে শুরু করেছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নানা সংকট ও নেতিবাচক ধারা সত্ত্বেও রেমিটেন্সের উপর শতকরা ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে গত তিন মাসে বৈধ চ্যানেলে রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স এসেছে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। যা আগের বছরের এ সময়ের চাইতে শতকরা ১৬ শতাংশ বেশি। বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রেরণে নগদ প্রণোদনার সুফল পাওয়া গেলেও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকারের আরো অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ হয়নি, সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ বন্ধের কোনো সঙ্গত কারণ নেই। প্রথমতঃ বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সাথে দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে সমস্যা নিরসনে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ, দ্বিতীয়তঃ অধিক সংখ্যক অদক্ষ শ্রমিক না পাঠিয়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরির পেশাজীবী ও দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ এবং তৃতীয়তঃ প্রবাসে ভাষা, আইনকানুন এবং সামাজিক-সংস্কৃতিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমবাজারের মন্দা কাটাতে হলে জাপান, কোরিয়া এবং ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতে শ্রমবাজারের বিকল্প উৎস ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া বিদ্যমান শ্রমবাজারের দেশগুলোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলরদের বিশেষ ভূমিকা পালনের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। অবৈধভাবে বিদেশ গমন ঠেকানো গেলেই কেবল বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের আইনগত হয়রানি কমিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি দেশের আভ্যন্তরীণ সম্পদ কাজে লাগিয়ে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন