বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে আমাদের দেশে বেচাকেনা বেশী হয়। যেমন ঈদ, পূজাপার্বন, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি। যেহেতু এদেশের শতকরা প্রায় ৯২ ভাগ মুসলমান সে হিসেবে ঈদের সময় বেচাকেনা বেশী হয়। বাকীটা অন্যান্য উৎসবে। ব্যবসা হয় কোটি কোটি টাকার। এছাড়া সারাবছর কমবেশী বেচাকেনা হয়। কিন্তুু আমরা বাজারে গিয়ে কতজন দেশীয় পণ্য কিনছি। অনেকে বলে থাকেন দেশীয় পণ্যের মান ভালো না। একবার ভেবে দেখেছি না, আমরা যদি দেশীয় পণ্য না কিনি তাহলে মান ভাল হবে কিভাবে? একটা কারখানার উৎপাদিত কাপড়, জুতা যাই হোক না কেন যদি মোটামুটি চলে তাহলে কারখানার মালিক চিন্তা করবে কিভাবে পণ্যটির মান বৃদ্ধি করা যায়। বাজারে যদি পণ্য না চলে শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারে তাহলে তিনি কিভাবে পণ্যের মান বৃদ্ধির দিকে নজর দেবেন? আপনি হয়ত বলবেন আমিতো এই দামে আরও ভাল মানের পণ্য পাচ্ছি। তাহলে মানহীন পণ্য কিনব কেন? অথচ ভেবে দেখা হচ্ছে না, যদি নিয়মিত ভারত ও চীনের পণ্য কেনা হচ্ছে বলেই তারা পণ্যের মান উন্নতি করতে পারছে। পণ্যের মান নিয়ে আরও একটা কথা আছে। ভারত অথবা চীনে যে সেন্ডেল/জুতা হাজার টাকায় কেনা হয়। একই মানের দেশীয় সেন্ডেল/জুতা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের পণ্যটি হয়ত একটু চকচক কম করতে পারে কিন্তু টেকসই হবে ভারত চায়নার চেয়ে বেশি। আমরা যদি নিয়মিত দেশীয় পণ্য কিনি তাহলে দেশীয় সকল পণ্যে এই চকচকে ভাবটা চলে আসবে এবং সেটা হতে বেশি দিন লাগবে না।
একটা উদাহরণ দিই। যাদের বয়স ৪৫ এর ঘরে তারা দেখেছেন আশির দশকে জাপানী বলপেন ‘রেড-লিফ’ সারা বাংলাদেশে দেদারছে চলত। ‘রেড লিফ’ বলপেন ছাড়া কোন পরীক্ষার্থীকে এস.এস.সি/ এইচ এস সি বা কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিতে দেখা যায়নি। তারপর কিছু ব্যবসায়ী এগিয়ে এলেন। তারা ৩/৪ টাকার মধ্যে বলপেন তৈরী করতে সক্ষম হন। আর রেডলিফ কলমের মূল্য ছিল ১০ টাকা। ৩ টাকা মূল্যের বলপেন ইকোনো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো। তখন থেকে ধীরে ধীরে রেডলিফ উঠে গেলো। বাজার দখল করলো দেশীয় কোম্পানীগুলো। বর্তমানে বিভিন্ন ভালো ভালো কোম্পানী উন্নতমানের কলম তৈরী করছে। এটা সম্ভব হয়েছে আমরা সবাই দেশের উৎপাদিত পণ্যটি কিনেছিলাম বলে। গত রোজার ঈদে একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়, ভৈরবের জুতার কারখানার মালিকেরা শ্রমিকের বেতন দিতে পারছে না, কারণ এই ঈদেও তেমন বেচাবিক্রি নেই। ঈদে কোটি কোটি টাকা কমিয়ে নিচ্ছে ভারতীয় ও চীনের জুতা-স্যান্ডেল। আমাদের দেশীয় ব্যবসায়ীরা মার খাচ্ছে। পত্রিকাটি লিখেছিল ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দেয়ার জন্য। বাজারে যদি পণ্য বিক্রি না হয় তাহলে প্রণোদনা দিয়ে কি সেই শিল্পকে বাচানো যায়? আপনি বাজারে যা কিছুই কিনতে যান না কেন কাপড়, জুতা, কসমেটিকস দেখবেন সেটা ভারতীয় অথবা চাইনিজ। আর যখনই দোকানী বলবে এটা বিদেশী তখনই শতকরা ৯৫% জন ক্রেতা খুশীতে টগবগ করে উঠবে ও বলবে ঠিক আছে দিয়ে দিন। অথচ একাই জিনিস তিন ভাগের এক ভাগ টাকা দিয়ে দেশীয় পণ্য কেনা যেত।
আসলে আমাদের দেশপ্রেমের অনেক অভাব রয়েছ। যদি তা না হতো তবে বিদেশী পণ্যে এভাবে বাজার সয়লাব হয়ে যেত না। যে দেশ ত্রিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে সে দেশের জনগণ আমরা দেশীয় পণ্য কিনতে লজ্জাবোধ করি। আমরা যদি একটা দেশীয় পণ্য কিনি, তাহলে সে টাকাটা কোথায় যাবে? প্রথম যাকে মালিকের নিকট। তারপর যাবে শ্রমিকের নিকট। পণ্য যদি ভাল চলে তাহলে যে কোন মালিক তার উৎপাদিত পণ্যের মান বৃদ্ধি করবে তার সুনাম বৃদ্ধি করার জন্য। আর বাংলাদেশের পণ্যের মান কি এত খারাপ? এত খারাপ হলে তৈরী পোশাক রপ্তানিতে আমরা বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে থাকি কি করে? আমাদের দেশে উৎপাদিত ফ্রিজ বিশ্বের অনেক দেশে চলে। আমাদের ঔষধ বিশ্বের ৭০টি দেশে রপ্তানি হয়। আমাদের দেশের সিমেন্ট, সাইকেল বিভিন্ন প্লাস্টিক দ্রব্যসহ অনেক কিছু বিদেশে রপ্তানি হয়। বিদেশীরা আমাদের পণ্য ব্যবহার করতে পারলে আমরা কেন পারব না? এবার দেখি বিদেশী পণ্য আমদানী করতে গিয়ে আমরা কত দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। গত কয়েক বছর ধরে প্রতিনিয়ত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এতে অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরী হচ্ছে। তবে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বাণিজ্য ঘাটতি কিছু কমেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে (জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০১৯) দেশের পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ৫৪৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে যা ছিল ১ হাজার ৮১৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান আমদানি বাড়ছে। রপ্তানি বাণিজ্য ও রেমিটেন্স কিছুটা ইতিবাচক হলেও তা আমদানি ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম। ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি থাকছেই। কারণ যে হারে আমদানী হচ্ছে সেই হারে রপ্তানি আয় হয়নি। আমদানী বেশী হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে যা চিন্তার বিষয়। যার ফলে বাণিজ্য ঘাটতি সামান্য কমলেও এর থেকে উত্তরণ হচ্ছে না। এর থেকে উত্তরণে দুটি পথ খোলা আছে, তা হলো রপ্তানি বৃদ্ধি করা অথবা আমদানি হ্রাস করা। আমরা যদি রপ্তানি বৃদ্ধি করতে নাও পারি আমদানি ব্যয় চেষ্টা করলে কমাতে পারি নিঃসন্দেহে। সঠিক নিয়মে আমদানি হলে, অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী দ্রব্য আমদানি না করলে অবশ্যই আমদানি ব্যয় কমে আসবে। তাছাড়া রপ্তানি আয় ধীরে ধীরে হলেও বাড়বে। উল্লেখ্য, রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানী ব্যয় যেটুকু বেশী, তার পার্থক্যটাই বাণিজ্য ঘাটতি। আমরা যদি অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিলাস সামগ্রী, দামী গাড়ী ইত্যাদি আমদানী না করতাম তাহলে ১৫৪৯ কোটি মার্কিন ডলার অর্থাৎ ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হত। এরচেয়ে বেশি কষ্টের কথা হলো এই টাকা পূরণ করা হয়েছে আমাদের দেশের প্রবাসী শ্রমিকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে।
আমাদের যদি বাণিজ্য ঘাটতি না হতো তাহলে বিশ্ব ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হতো না। প্রতি বছর বাজেটের সময় হাজার হাজার কোটি টাকা সুদ গুণতে হতো না। বর্তমানে খেলাপী ঋণের পরিমান প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। আপনি কি মনে করেন যারা ঋণ নিয়ে খেলাপী হয়েছে তারা সবই খারাপ? তাদের মধ্যে অনেকেই আছে ঋণ নিয়ে কারখানা গড়ে তুলেছিল লাভের আশায়। কিন্তুু তার কারখানার উৎপাদিত পণ্য বিদেশী পণ্যের সাথে মার খেয়েছে বলেই আজকে তিনি ঋণ খেলাপী। তবে এই সংখ্যা শতকরা ২৫-৩০ ভাগের বেশী হবে না। দেশীয় পণ্য কেনা এটা কোনো ছোটখাটো ব্যাপার নয়। এটা কোনো হেলাফেলার ব্যাপার নয়। আমাদের অর্থনীতির মেরুদ- সোজা রাখতে হলে দেশীয় পণ্য ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের গ্রামেগঞ্জে একটা কথা আছে যে, বিদেশী রুই থেকে দেশি পুটিমাছ ভালো। আসুন, আমরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্মিলিত হই। দোকানে গিয়ে বলি দেশীয় পণ্য দিতে। আমরা যখন সবাই অথবা শতকরা ৮০ জন দেশীয় পণ্য কিনতে চাইব, তখন দোকানদারের টনক নড়বে। দোকানে দেশীয় পণ্য রাখা শুরু করবে। দেশীয় কারখানাগুলো সচল হতে থাকবে। আমদানি ব্যয় কমে আসবে। লাখ লাখ বেকারদের কর্মসংস্থান হবে। খেলাপী ঋণ অনেক কমে যাবে। পণ্যের মান বৃদ্ধি পাবে। পণ্যের মান বৃদ্ধি পেলে রপ্তানী আয়ও বাড়বে। দেশীয় পণ্য কিনলে ধনী হবে আমাদের দেশের উদ্যোক্তরা। শ্রমিকদের বেতন বাড়বে। তাদের জীবনযাত্রার মান হবে উন্নত বিশ্বের শ্রমিকদের মতো। দেশ ধনী হলে আপনি, আমরাও ধনী হব। সেই সাথে বিলাসদ্রব্য সামগ্রী ও অধিক মূল্যমানের গাড়ী আমদানী নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। তাহলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে যাবে। সেই টাকা দিয়ে দেশের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। দেশ উন্নত হতে বেশিদিন লাগবে না। সবাই দেশি পণ্য ব্যবহার করলে ২০৪১ পর্যন্ত অপক্ষো করতে হবে না। ২০৩০/৩৫ এর মধ্যেই আমরা উন্নত দেশে পরিণত হতে পারব ইনশাআল্লাহ। জাপান আমাদের চেয়ে খুব বড় দেশ নয়। কিন্তু জাপানের অর্থনীতি বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম। তারা রপ্তানি আয়ের টাকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছে। সবাই দেশীয় পণ্য ব্যবহার করলে সেইদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরাও বিদেশে বিনিয়োগ করবে। আসুন, সবাই দেশীয় পণ্য ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান জানাই ও দেশপ্রেমের পরিচয় দেই। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।
লেখক : ক্রেডিট সুপারভাইজার, যুব উন্নয়ন অফিস, নরসিংদী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন