ইসলাম মানবিক ধর্ম। মানবের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ও মঙ্গল ইসলামের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার। অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে ইসলামের পার্থক্য এই যে, এতে জীবনের এমন কোনো দিক-বিভাগ নেই, যার সম্পর্কে আলোচনা ও বিধি-নিষেধ বিদ্যমান নেই। অন্যান্য ধর্মে মানব কল্যাণ ও মঙ্গলের দিকটি উপেক্ষিত। ইসলাম শুধুমাত্র ধর্ম নয়, এটা পরিপূর্ণ জীবন-বিধান। জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সবকিছুর বিষয়ে ইসলাম সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে। এই দিক-নির্দেশনা অনুসরণ অবশ্যই কল্যাণ ও মঙ্গল প্রদায়ক। আর এর অমান্যতাসমূহ ক্ষতির কারক।
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্য বৈধ ও হালাল করা হয়েছে। আর সুদকে করা হয়েছে সম্পূর্ণ হারাম। ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয়জীবন পর্যন্ত সুদ কী ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করে বা করতে পারে তা আমাদের কারো অজানা নেই। অনেকেই সুদী কারবারকে ব্যবসার মতোই মনে করে। আগেও মনে করতো: পবিত্র কোরআনে এই সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যারা সুদ খায়, তাদের অবস্থা সেই ব্যক্তির মতো, যাকে শয়তান তার স্পর্শ দ্বারা পাগল বানিয়ে দিয়েছে। তাদের এরূপ অবস্থার কারণ, তারা বলে ব্যবসা তো সুদের মতোই কারবার। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। যে ব্যক্তির কাছে তার রবের থেকে এই মূল্যবান উপদেশ এসে পৌঁছেছে, অত:পর সে তা পরিত্যাগ করেছে সে পূর্বে যেটুকু সুদ খেয়েছে তা তো খেয়েই ফেলেছে, সে ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা আল্লাহর কাছে সোপার্দ। আর যারা এই মহান উপদেশ জানতে পেরেও সে কাজের পুনরাবৃত্তি করবে, তারা নি:সন্দেহে জাহান্নামী হবে এবং সেখানে চিরদিন অবস্থান করবে।’ (সূরা বাকারাহ : আয়াত ২৭৫)।
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট, ব্যবসা ও সুদী কারবারকে কখনোই এক করে দেখা যাবে না। ব্যবসার নামে সুদী কারবার চালানো যাবে না। ব্যবসা হালাল বা পুণ্যের কাজ। আর সুদী কারবার হারাম বা গুনাহের কাজ। সুদ খেলে পরিণাম কী হবে, পবিত্র কোরআনে তা কঠোর ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, ব্যবসা পণ্যের কাজ তখনই হবে, যখন ব্যবসায়ীর নিজের ও ক্রেতার স্বার্থ ও কল্যাণ ন্যায়সঙ্গতভাবে সুরক্ষিত হবে। ব্যবসায়ীর বা বিক্রেতার অপরিহার্য কর্তব্য হলো, কোনো পণ্যের দাম অন্যায় বা অস্বাভাবিকভাবে না বাড়ানো, যাতে ক্রেতার পক্ষে তা কেনা অসম্ভব বা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। ক্রেতার ওপর জুলুম করার হক বিক্রেতার নেই। অতিরিক্ত লাভ নয়, ন্যূনতম লাভে পণ্য বিক্রির জন্য নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। পণ্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোকে নিষেধ করা হয়েছে। ওজনে কম দেয়াকে সম্পূর্ণ রহিত করা হয়েছে। খাদ্যদ্রব্য ৪০ দিনের বেশি মজুদ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। মহানবী সা. বলেছেন: যে ব্যক্তি কোনো খাদ্য দ্রব্য ৪০ দিনের বেশি গুদামজাত করে রাখবে, সে ওই খাদ্য সদকা করে দিলেও তার গুদামজাত করার গুনাহ মাফ হবে না। মিশকাত। অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: যে ব্যক্তি খাদ্য বস্তু গুদামজাত করে সে গুরুতর অপরাধী। খাদ্যবস্তু গুদামজাতকারী গুনাহগার হিসাবে বিবেচিত হবে। তিরমিজি।
যারা ওজনে কম দেয় তারা আসলে গোপনে চুরি ও আত্মসাৎ করে এবং হারাম খায়। আল্লাহপাক এই ধরনের ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বলেছেন: ওজনে হেরফেরকারী ব্যক্তিদের জন্য দুর্ভোগ। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়। (সূরা মুতাফফিফিন : আয়াত ১-৩)।
সৎ ব্যবসায়ীরা আল্লাহপাকের দৃষ্টিতে অপরিসীম মর্যাদার অধিকারী। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, হাবিবে খোদা সা. বলেছেন, সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথে থাকবে। এই অসাধারণ সম্মান ও মর্যাদার কথা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা বোধহয় কমই জানেন। যারা জানেন, হয়তো তাদের কম সংখ্যকই তা মানেন। তা না হলে নানা উপলক্ষ, ওসিলা ও অজুহাতে বিভিন্ন পণ্যের দাম যখন তখন বেড়ে যায় কেন? সাম্প্রতিক পেঁয়াজকান্ডের কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। এখনো এই কান্ডের শেষ হয়নি। এখনো পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মত পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও আমরা আমদানিনির্ভর। ভারত থেকে বেশিরভাগ পেঁয়াজ আমদানি হয়। কিছুদিন আগে ভারত হঠাৎ করেই পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেয়। এর কয়েকদিনের মধ্যে রফতানিও বন্ধ করে দেয়। এর ফলে ৩৫-৪০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ কয়েক দিনের ব্যবধানে ১২০ টাকায় উঠে যায়। পেঁয়াজের এই অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পেছনে ভারতের হঠাৎ দাম বাড়ানো এবং রফতানি বন্ধ করা দায়ী হলেও আমাদের ব্যবসায়ীরাও কম দায়ী নয়। চাহিদা ও সরবরাহের ওপর দাম বাড়া-কমা নির্ভর করলেও এত দ্রুত পেঁয়াজের দাম আকাশের চূড়ায় ওঠার কথা নয়। প্রতিটা পণ্য অন্তত কয়েক মাসের চাহিদার অনুপাতে মজুদ থাকে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। দুর্ভাগ্য এই যে, পেঁয়াজের আমদানিকারক ও বড় ব্যবসায়ীরা সততা ও ঈমানদারীর পরিচয় দেয়নি। তারা বরং পরিস্থিতির সুযোগে নিজেদের পেঁয়াজ মজুদ রেখে, দাম বাড়িয়ে মানুষের পকেট থেকে কয়েক গুণ বেশি অর্থ বের করে নিয়েছে, যা অন্যায় ও জুলুমের নামান্তর। আর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও নীরব থেকে দায়িত্বহীনতার প্রমাণ দিয়েছে। প্রশ্ন ওঠে, আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সততা ও ঈমানদারিত্ব এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা ও কর্মনিষ্ঠ কি আদৌ কখনো ফিরে আসবে? ব্যবসায়ীদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, অতি লাভের আশায় কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়ার অপকর্ম ও জুলুমের জন্য শেষ বিচারের দিনে আল্লাহপাকের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে এবং উপযুক্ত শান্তির সম্মুখীন হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন