খলিফার নামে একই পত্রে দুই সাহাবীর উপদেশমূলক বক্তব্য সেযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। খলিফা হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা:) এর নামে সরাসরি উপদেশ প্রদান করার ঘটনা প্রমাণ করে যে, কেউ যত বড় ক্ষমতাশালী হোক না কেন, তাঁর কাছে সত্য কথা পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকেই অবহিত ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা:) এর অমর বাণী-উপদেশ দ্বীনের সঙ্গে অবেচ্ছেদ্য। এ বক্তব্যের ওপর আমল করার জন্য সাহাবায়ে কেরাম উপদেশ প্রদানে কার্পণ্য করতেন না এবং প্রয়োজনে খলিফার নামে পত্রের মাধ্যমে উপদেশ প্রদান করতেন। নিন্মোর ঘটনা তারই একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
হজরত উমর (রা:) মুসলিম রাষ্ট্রের দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর হজরত আবু উবায়দা (রা:) এবং হজরত মাআজ ইবনে জাবাল (রা:) খলিফার নামে একখানা যৌথ পত্র প্রেরণ করেন। পত্রে তাঁরা বলেন;
“আমরা আপনাকে এমন অবস্থায় দেখেছি, যখন আপনি নিজের সংশোধন, প্রতিপালন ও নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত থাকতেন এবং বর্তমানে আপনার উপর সমগ্র উম্মতের প্রতিপালন ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আপনার মজলিসে সকল স্তরের লোক আসা-যাওয়া করবে, বন্ধুরা আসবে, শত্রুরাও যাতায়াত করবে এবং বিচার প্রত্যেকেরই প্রাপ্য অধিকার। এমতাবস্থায় আপনাকে চিন্তা করতে হবে, অপনি তাদের সাথে কি আচরণ প্রদর্শন করবেন।
আমরা আপনাকে সেই দিনের ভয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, যে দিন সকল লোক আল্লাহর দরবারে নত শির হয়ে থাকবে, ভীত সন্ত্রস্ত হৃদয় প্রকম্পিত হয়ে উঠবে এবং আল্লাহর যুক্তিপ্রমাণের নিকট অন্য কারো যুক্তি-প্রমাণ টিকবে না। তাঁর সম্মুখে সকলকে অসহায়-অপারগ হয়ে থাকতে হবে। সে দিন সমস্ত লোক আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা করতে থাকবে এবং তাঁর শাস্তির ভয় করবে।
আমরা মহানবী (সা:) এর এই হাদীস শ্রবণ করেছি যে, ‘শেষ জামানায় লোক বাহ্যত: পরস্পরের বন্ধু সাজবে এবং গোপনে পরস্পরের শত্রু হবে।’
পরিশেষে আমরা বলতে চাই, আপনি আমাদের এই পত্র খানার সেই গুরুত্ব দিবেন যা তার বাস্তব লক্ষ্য। আমরা তো কেবল উপদেশ ও আন্তরিকতার মনোভাব নিয়ে আপনাকে লিখলাম।’
হজরত উমর (রা:), আবু উবায়দা (রা:)এবং হজরত মাআজ ইবনে জাবাল (রা:) এর যৌথপত্রের উত্তরে তাদের উক্তির পুনরাবৃত্তি করে বলেন: ‘আমি কি বলব? কেননা, আমার কাছে না আছে কোনো শক্তি, না আছে কোনো ব্যবস্থা। কেবল আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে আমি শক্তি অর্জন করতে পারি। অত:পর তোমরা আমাকে সেই পরিণতি সম্পর্কে স্মরণ করে দিয়েছো, যে পরিণতি সম্পর্কে আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে ভয় দেখান হয়েছিল।
দিবা-রাত্রির পরিবর্তন যা মানব জীবনের সাথে সম্পর্কিত, প্রত্যেক সুদূরকে নিকটতর এবং প্রত্যেক নতুনকে পুরাতন করে ফেলছে। আর প্রত্যেক ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবায়িত করে চলছে। এমনকি দুনিয়ার আয়ুষ্কাল নি:শেষ হয়ে যাবে এবং আখিরাতে বা পরকালে প্রকাশিত হবে, যেখানে প্রত্যেককেই জান্নাতে অথবা জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে।
পত্রে তোমরা আরও উল্লেখ করেছ যে, আখেরী জামানায় লোক প্রকাশ্যে পরস্পরের বন্ধু হবে এবং গোপনে শত্রু। স্মরণ রেখো, তোমরা সে সব লোক নও, যাদের সম্বন্ধে এরূপ বলা হয়েছে এবং এটা সে যুগও নয়, যাতে এরূপ মোনাফেকি প্রকাশ পাবে। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব তখনই হবে যখন লোক নিজেদের আর্থিক স্বার্থ রক্ষার মানসে পরস্পরকে ভয় করবে।
পরিশেষে তোমরা লিখেছ যে, আমি যেন তোমাদের পত্র হতে কোন রকম ভুল ধারণা পোষণ না করি। বেশ, তোমরা ঠিকই বলেছ, তোমরা নিছক সৎ উপদেশের মনোভাব নিয়ে লিখেছ। আগামীতে পত্র লেখা বন্ধ করবে না। আমি তোমাদের দুইজনের সৎ উপদেশ হতে বঞ্চিত থাকতে পারি না।’
দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে সমাজের গুণী-জ্ঞানী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সৎ উপদেশ, পরামর্শ যেমন নির্ভীকভাবে প্রদান করা উচিত, তেমনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উচ্চ আসনে যারা সমাসীন, তাদেরও উদারচিত্তে জাতীয় কল্যাণ সাধনে সৎ উপদেশ গ্রহণ করার মত আদর্শ নিহিত রয়েছে উপরোক্ত ঘটনার মধ্যে।
দুইজন বিশিষ্ট সাহাবীর পত্রের জবাবে খলিফা হজরত উমর (রা:) ভবিষ্যতেও তাদের সৎ পরামর্শ কামনা করেন। ক্ষমতাসীন সরকার ও জনগণের মধ্যে পরস্পর এরূপ কল্যাণমূলক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ থাকে না। সাহাবা ও খলিফার মধ্যে পত্র বিনিময় তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন